ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওয়ার্ড কাউন্সিলর পুত্র ইরফান সেলিম গ্রেফতার, এক বছরের কারাদণ্ড

হাজী সেলিমের ছেলের বাড়িতে অভিযান ॥ নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ২৭ অক্টোবর ২০২০

হাজী সেলিমের ছেলের বাড়িতে অভিযান ॥ নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিম এবং তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে এক বছর বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে ছয় মাস ও অবৈধ মাদক রাখার দায়ে ছয় মাস করে মোট এক বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে দু’জনকে। সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে অভিযান শেষে এক ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের এসব কথা জানান। তিনি জানান, দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা পুরান ঢাকার দেবীদাস ঘাট এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফানের চাঁন সরদার দাদার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ওই দুজনকে গ্রেফতারের পর এই দণ্ড দেয়া হয়। অভিযান চালায় র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে র‌্যাবের দল। অভিযানে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফানের বাসা থেকে একটি ড্রোন, অবৈধভাবে মজুদ রাখা সাত বোতল বিদেশী মদ ও বিয়ার উদ্ধার করেছে র‌্যাব। এছাড়া তার শয়নকক্ষ থেকে ৩৮টি ওয়াকিটকি, অস্ত্রসহ একটি পিস্তল, একটি একনলা বন্দুক, একটি ব্রিফকেস, একটি হ্যান্ডকাফ, তার খাটের জাজিমের নিচ থেকে অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়। সোমবার বিকেলে অভিযানের এক পর্যায়ে হাজী সেলিমের চাঁন সরদার দাদার বাড়ির ভেতরে সাংবাদিকদের নিয়ে গেলে উদ্ধার করা এসব অস্ত্র ও মাদক দেখা যায়। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান জানিয়েছেন, এসব ওয়াকিটকির মাধ্যমে তিনি তার বাসার আশপাশের পাঁচ থেকে ১২ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা নেতাকর্মী ও অনুসারীদের সঙ্গে কথাবার্তা এবং যোগাযোগ রাখতেন। এছাড়া তার বাসার চার ও পাঁচতলার কন্ট্রোল রুম থেকে পাঁচটি ভিপিএস সেট উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ডিটেক করতে পারত না। এদিকে র‌্যাব সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, অভিযানে গুলিসহ একটি পিস্তল ও একটি একনলা বন্দুক এবং একটি ব্রিফকেস ও হ্যান্ডকাফ উদ্ধার করা হয়েছে। তার অস্ত্র দুটির কোন লাইসেন্স ছিল না। এসব অস্ত্র ও হ্যান্ডকাফের বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি ইরফান সেলিম। আমাদের ধারণা এগুলো দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখাতেন। দুপুরে হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমকে গ্রেফতার করতে তার পুরান ঢাকার দেবীদাস ঘাট এলাকার চাঁন সরদার দাদার বাড়িতে তল্লাশি শুরু হয়। বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান চালিয়ে প্রথমে তার ছেলে ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদকে র‌্যাব হেফাজতে নেয়। অভিযানের সময় বিকেলে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, ইরফান সেলিমকে এখনও গ্রেফতার দেখানো হয়নি। তিনি জানান, কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ইরফান সেলিমের বাসায় অভিযান চালানো হয়। গতকালের (রবিবার) ঘটনা নয়, মোহাম্মদ ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। ভেতরে র‌্যাবের অভিযানিক দল কাজ করছেন। এখানে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট, র‌্যাব-৩ ও ১০ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা রয়েছেন। আশিক বিল্লাহ জানান, সাধারণত কোন বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করার সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে রাখতে হয়। সে কারণে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটও উপস্থিত রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট র‌্যাবের অভিযানে সহযোগিতা করেন। পরে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার জানান, আমাদের টিমের সদস্যরা হাজী সেলিমের ছেলেকে হেফাজতে নিয়েছে। ইরফান সেলিম নিজেও একজন জনপ্রতিনিধি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তিনি। রবিবার রাতে রাজধানীর কলাবাগান সিগন্যালের পাশে এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ‘সংসদ সদস্য’ লেখা সরকারী গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধর করা হয়। রাতে এ ঘটনায় জিডি হলেও সোমবার ভোরে হাজী সেলিমের ছেলেসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তাতে ইরফান সেলিম ছাড়াও হাজী সেলিমের প্রোটকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু, মোহাম্মদ জাহিদ ও মিজানুর রহমানের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও তিনজনকে আসামি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে বেআইনীভাবে পথরোধ করে সরকারী কর্মকর্তাকে মারধর, জখম ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার অভিযোগ এনেছেন মামলার বাদী নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মোঃ ওয়াসিফ আহমেদ খান। ধানমণ্ডি থানার ওসি ইকরাম আলী জানান, মামলা হওয়ার পরপরই গাড়ির চালক মিজানুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালতে পাঠিয়ে মিজানুর রহমানকে এক দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে ॥ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ রবিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে নীলক্ষেত থেকে বই কিনে মোটরসাইকেলে করে তিনি মোহাম্মদপুরে তার বাসায় ফিরছিলেন। সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো একটি কালো রঙের ল্যান্ড রোভার গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫৭৩৬) পেছন থেকে তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। ওয়াসিফ আহমেদ মোটরসাইকেল থামিয়ে গাড়িটির গ্লাসে নক করে নিজের পরিচয় দিয়ে ধাক্কা দেয়ার কারণ জানতে চান। তখন এক ব্যক্তি বের হয়ে তাকে গালিগালাজ করে। তারা গাড়ি নিয়ে কলাবাগানের দিকে যায়। মোটরসাইকেল নিয়ে ওয়াসিফ আহমেদও তাদের পেছনে পেছনে যান। কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটি থামলে ওয়াসিফ তার মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ান। এ সময় ওই গাড়ি থেকে জাহিদ, দিপু এবং অজ্ঞাত পরিচয় আরও দুই-তিনজন ‘অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ’ করতে করতে নেমে আসে এবং মারধর শুরু করে। মামলা এজাহারে আরও বলা হয়, তারা আমাকে মারধর করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যায়। পরে আমার স্ত্রী, স্থানীয় জনতা এবং পাশে ডিউটিরত ধানম-ি থানার ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে উদ্ধার করে আনোয়ার খান মডেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। মামলায় মোট পাঁচটি ফৌজদারি অপরাধের ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অপরাধগুলো হচ্ছে- দণ্ডবিধি ১৪৩ অনুযায়ী বেআইনী সমাবেশের সদস্য হয়ে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধমূলকভাবে বল প্রয়োগ করা, ৩৪১ অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, ৩৩২ ধারা অনুযায়ী সরকারী কর্মকর্তার কাজে বাধাদানের উদ্দেশ্যে আহত করা, ৩৫৩ ধারা অনুযায়ী সরকারী কর্মকর্তার ওপর বল প্রয়োগ করা এবং ৫০৬ ধারায় প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার। হাজী সেলিমের গাড়িচালক রিমান্ডে ॥ এদিকে সোমবার দুপুর ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের গাড়িচালক গ্রেফতারকৃত মিজানুর রহমানকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান মোহাম্মদ নোমান আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধানম-ি থানার কর্মকর্তা আশফাক রাজীব হাসান। তদন্তের স্বার্থে মিজানুরের পাঁচদিনের রিমান্ডের আবেদন করেন তিনি। আসামি পক্ষের আইনজীবী আবু হাসিব টিপু রিমান্ড বাতিলের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক আবু সুফিয়ান মোহাম্মদ নোমান গ্রেফতারকৃত মিজানুর রহমানের একদিনের একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে আদালতে গ্রেফতারকৃত মিজান জানান, আমি মারধর করিনি, মারধর করেছে সিকিউরিটি গার্ড জাহিদ। আমি তো এক সপ্তাহ আগে হাজী সেলিমের গাড়িচালক হিসেবে চাকরি নেই। ঘটনার সময় দুই পক্ষই এক পক্ষ আরেক পক্ষকে মারধর করেছে। আদালতের সংশ্লিষ্ট থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মামলায় আসামিরা হচ্ছে ইরফান সেলিম, তার বডিগার্ড মোহাম্মদ জাহিদ, হাজী সেলিমের মদিনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু এবং গাড়িচালক মিজানুর রহমানসহ অজ্ঞাত আরও দুই তিনজন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জনপ্রতিনিধি হোক আর সে যেই হোক, কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তাকে আইনের মুখোমুখি হতেই হবে। ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সোমবার সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। পুলিশ জানায়, রবিবার সন্ধ্যার পর রাজধানীর কলাবাগান ক্রসিংয়ের কাছে মারধরের শিকার হন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খান। তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়েছিল সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো একটি গাড়ি। এরপর গাড়িটি থেকে কয়েক ব্যক্তি নেমে ওই কর্মকর্তাকে মারধর করেন। ধানম-ি থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল্লাহ জাহিদ জানান, ওই গাড়ি সাংসদ হাজী সেলিমের। তিনি গাড়িতে ছিলেন না। তার ছেলে ও নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। পুলিশ সাংসদের গাড়ি ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তার মোটরসাইকেল রাতেই ধানম-ি থানায় নিয়ে যায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি রাস্তায় জটলা থেকে মুঠোফোনে ভিডিও করেন। ওই ঘটনার পরে প্রত্যক্ষদর্শী মোবাইল ফোনে লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফের বক্তব্য ধারণ করেন, যা ইতোমধ্যে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে নৌবাহিনীর এই কর্মকর্তাকে রক্তাক্ত মুখে বলতে শোনা যায়, তিনি পরিচয় দেয়ার পরও তাকে মারধর করা হয়েছে, তার স্ত্রীর গায়েও হাত দিয়েছে। ধানমণ্ডির ওসি ইকরাম আলী জানান, গাড়িটি ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের হলেও ঘটনার সময় তিনি গাড়িতে ছিলেন না। গাড়িতে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম ছিলেন। অভিযোগের বিষয়ে হাজী সেলিমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
×