ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কয়েক জঙ্গীর জবানবন্দী

ইন্টারনেটেই জঙ্গী ফাঁদ, সদস্য সংগ্রহ প্রশিক্ষণ সবই চলছে

প্রকাশিত: ২২:২০, ২৭ অক্টোবর ২০২০

ইন্টারনেটেই জঙ্গী ফাঁদ, সদস্য সংগ্রহ প্রশিক্ষণ সবই চলছে

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সংগঠনের সদস্য সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ ও প্রশিক্ষণ দানের জন্য ইন্টারনেটে এক ধরনের ফাঁদ পেতে বসে আছে জঙ্গীবাদে নিয়োগকারী হোতারা। এখন ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে জঙ্গী হওয়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। জঙ্গীবাদের অন্ধকার জগতের প্রসার ঘটাতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট, ইউটিউব ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। উন্নত ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের নাম, ইফেক্টিভ রেঞ্জ, ওজন, কার্টিজ সাইজ সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে জানছে জঙ্গীরা। ইউটিউব থেকে শিখছে তারা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র চালনা। বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে জঙ্গীরা। ইন্টারনেট থেকে শিখছে মার্শাল আর্ট। অনলাইনে জঙ্গীবাদ ও জিহাদে যোগদানের জন্য জঙ্গীবাদের বিরত্বগাথায় জীবনীতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আছে বিভিন্ন নামের ওয়েবসাইট। বর্তমান সময়ের যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে জঙ্গী গোষ্ঠীতে যোদ দিতে কিশোর-তরুণ-যুবকদের এভাবেই উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিয়ে জঙ্গীরা নিয়মিত অনলাইনে নিজেদের প্রচারণা চালাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা ও সিলেট থেকে কয়েক জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে বলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের-সিটিটিসি’র দাবি। সিটিটিসি তদন্তে উঠে এসেছে, অনলাইনে মুসলিম বীরযোদ্ধা উমর ইবনে খাত্তাব, কাকা বিন আমর, খালিদ বিন ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাশেম, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, সালাউদ্দিন আইয়ুবি, শাহিদ আব্দুর রহমান, আলী ইবনে সুফিয়ান, আল্প আরসালান, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীদের জীবনী ও তাদের জিহাদের বীরত্বগাথার বই পড়ে জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে কিশোর ও যুবকরা। ইন্টারনেটের মাধ্যমেই জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে মার্শাল আর্ট শিখছে তারা। ইন্টারনেট থেকে সাফফাত যেসব অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছে সেই তালিকায় উল্লেখযোগ্য একে-৪৭, এম-১৬, একে-১২, এয়ার-৫০, মারকফ, গ্লোক-১৮, গ্লোক-১৫, এসআর-২৫, তুর্কিশ টি-৫০০০ স্নাইপার রাইফেল, ব্যারেট এম-৮২ এ১, সাব মেশিনগান, এমপিএস এমপি-৫, আরপিজি-৭, আরপিজি-২২, এসএসডি ড্রাগলাভ, হিকলার এ্যান্ড কোচ, এম-৮ কারবিনর, ডেজার্ট ঈগল, একে-৭৪ ও গ্লোক-৩৪ সি। এসব অস্ত্রের নাম, ইফেক্টিভ রেঞ্জ, ওজন, কার্টিজ সাইজ সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে জেনে নিচ্ছে জঙ্গীরা। এসব অস্ত্রের ম্যানুফেকচারার সম্পর্কেও তথ্য চলে যাচ্ছে জঙ্গী গোষ্ঠর হাতে। ভুয়া ফেসবুক আইডি বানিয়ে জঙ্গীরা ইন্টারনেট থেকে এসব তথ্য জেনে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এমন জঙ্গী সদস্যদের গ্রেফতারের পর তাদের দেয়া জবানবন্দীতে এই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে সিটিটিসি। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি একাধিক জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমেই অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে বোমা তৈরি পর্যন্ত শেখানো হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা ও সিলেট থেকে সাম্প্রতিক কয়েক জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে এই চিত্র উঠে আসে। এছাড়া ঘরে বসেই অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে বোমা তৈরির সব ম্যানুয়াল বাংলায় অনুবাদ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গীরা। জঙ্গীরা নিয়মিত অনলাইনে নিজেদের প্রচারণা চালায়। ইন্টারনেটে জঙ্গীবাদের হোতারা এক ধরনের ফাঁদ পেতে বসে আছে। কিশোর-তরুণদের তারা লক্ষ্য বানিয়ে উদ্বুদ্ধ করছে। একপর্যায়ে তাদের ঘর ছাড়তে উস্কানি দেয়া হচ্ছে। জঙ্গীবাদের ফাঁদে পড়ে অনেকেই সাফফাতের মতো কথিত জিহাদের জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, জিহাদ করতে মরিয়া হয়ে ঘর ছেড়ে যাওয়ার পর ধরা পড়েছে নব্য জেএমবির একটি সেলের সামরিক উপদেষ্টা। নব্য জেএমবির জঙ্গী সেলের সদস্যদের কাছে সে পরিচিত ছিল একাধিক নামে। কেউ তাকে চিনত আব্দুল্লাহ নামে। কেউবা উইলিয়াম, কুতুব উদ্দিন আইবেক, চেঙ্গিস খান, আলী ইবনে সুফিয়ান, আরকে খান, আল্প আরসালান কিংবা মেহমেদ চাগরী বেগ নামে। মুসলিম বীর যোদ্ধাদের নামে নিজের পরিচয় দিতে পছন্দ করত গ্রেফতারকৃত কিশোর-তরুণ ও যুবকরা। সিরিয়া বা আফগানিস্তানের খোরাসানে গিয়ে জিহাদ করার ইচ্ছায় হিজরতে বের হওয়ার পর গ্রেফতার হওয়ার পর জবানবন্দীতে তারা বলেছে, জঙ্গীবাদের দীক্ষা পেয়েই স্বেচ্ছায় ঘরও ছেড়েছিল। কিভাবে জঙ্গীবাদের দীক্ষা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে সেই বিষয়টি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে উঠে এসেছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে উঠে এসেছে, ফেসবুকে ইরাকের বোন ফাতেমার চিঠি ও নিউরো সায়েন্টিস্ট আফিয়া সিদ্দিকীর চিঠি দেখেন গ্রেফতার হওয়ার আগের জঙ্গীরা। ফেসবুকে এসব চিঠি দেখে তারা বুঝতে পারে, আমেরিকাসহ ন্যাটো জোট মুসলিম বিশ্বের ওপর এবং মুসলিম নারীদের ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। এমন অবস্থায় আমাদের উচিত ছিল পূর্বের ক্রুসেড নিধনের মতো তাদের কচুকাটা করা। সেই উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করতে থাকি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সমাজতন্ত্র, গোয়েন্দানীতি এবং যুদ্ধ কৌশলসহ মানসিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে থাকি। তখন আমার ফেসবুকে একটা এ্যাকাউন্ট খুলে ইন্টারনেট থেকে সাফফাত যেসব অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে যার তালিকায় ছিল অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও উন্নত বোমা তৈরির প্রযুক্তি। ইন্টারনেটের মাধ্যমেই জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে মার্শাল আর্ট শেখে সে। অনলাইনে মুসলিম বীরযোদ্ধা উমর ইবনে খাত্তাব, কাকা বিন আমর, খালিদ বিন ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাশেম, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, সালাউদ্দিন আইয়ুবি, শাহিদ আব্দুর রহমান, আলী ইবনে সুফিয়ান, আল্প আরসালান, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীদের জীবনী ও তাদের জিহাদের বীরত্বগাথার বই পড়ে জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হয় এরা। গ্রেফতারকৃতরা জবানবন্দীতে বলে, সশস্ত্র ও সাইবারে অর্থাৎ ইন্টারনেটভিত্তিক কাজের জন্য আলী খান, সুফিয়ান আলী, আব্দুর রহমান নামক আইডি বানাই। মুজাহিদ ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। অডিও-ভিডিওতে আমাদের কথা হয়। টেলিগ্রাম এ্যাকাউন্ট খুলি আলী ইবনে সুফিয়ান, সুলাইমান ১৪৭৫ নামে। এরপর ফাইয়াজ হোসেন নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের সঙ্গে মেসেজে কথা বলি। সম্প্রতি একাধিক জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য পেয়েছেন বলে জানান সিটিটিসি কর্মকর্তা। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীরা নিয়মিত অনলাইনে নিজেদের প্রচারণা চালায়। ইন্টারনেটে জঙ্গীবাদের হোতারা একধরনের ফাঁদ পেতে বসে আছে। ঘরে বসেই অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে বোমা তৈরির সব ম্যানুয়াল বাংলায় অনুবাদ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গীরা। ইন্টারনেটের মাধ্যমেই অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে বোমা তৈরি পর্যন্ত শেখানো হচ্ছে। একপর্যায়ে তাদের ঘর ছাড়তে উস্কানি দেয়া হচ্ছে। জঙ্গীবাদের ফাঁদে পড়ে অনেকেই সাফফাতের মতো কথিত জিহাদের জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গ্রেফতারের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেলেটি নিয়মিত জঙ্গীবাদের প্রচারণা চালাত। নব্য জেএমবির জন্য সদস্যও সংগ্রহ করেছে সে। সাফফাতের সঙ্গে ইয়াছির আরাফাত ওরফে শান্ত নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করেছিল সিটিটিসি। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে ২৩ আগস্ট সে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম সাদবীন ইয়াছির আহসান চৌধুরীর কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে ইয়াছির আরাফাত বলেছে, ২০২০ সালের মে মাসের দিকে আমার মুহাম্মদ বিন কাশিম আইডিতে আলী বিন সুফিয়ান নামক আইডি থেকে মেসেজ আসে। সে ভেবেছিল আমি কোন জিহাদি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সে যাচাই করে বুঝতে পারে আমি এমন কেউ নই এবং এ বিষয়ে সামান্য জানি।
×