ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ মর্ত্যভূমির প্রত্যাশায় শেষ হলো শারদোৎসব

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ২৬ অক্টোবর ২০২০

সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ মর্ত্যভূমির প্রত্যাশায় শেষ হলো শারদোৎসব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দশমি বিহিত পূজা, দর্পণ বিসর্জন, দেবীকে মিষ্টিমুখ করানো, ভালো থাকার আশীষ চাওয়া, রঙ আর সিঁদুর খেলা শেষে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটলো পাঁচদিনব্যাপী শারদীয় উৎসবের। শেষ দিনে হাসি আনন্দের সঙ্গে ভক্তদের চোখে ছিল জল। বিদায় বেলা অনেকে অঝোরে কেঁদেছেন। তাইতো প্রকৃতিও যেন ছিল অনেকটাই বিষন্ন। সকালের পর থেকেই আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। নবমীর মতো মেঘ ফুড়িয়ে রোদের খুব একটা দেখা মিলেনি। করোনার কারণে এবার বিজয়া শোভাযাত্রার কোন আয়োজন ছিল না। তাই দুপুরের পর থেকে মন্দির কমিটির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সদরঘাটের ওয়াইজঘাট সহ আশপাশের এলাকায় প্রতিমা বিসর্জন শুরু হয়। সন্ধ্যার পর পর্যন্ত চলে বিসর্জন হর্ব। ভক্তরা বলছেন, মহামারীর দিনে শোভাযাত্রার কোন সমারোহ এবার ছিল না। তারপরও তো বিজয়া দশমী; ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবীর দেবালয়ে ফেরার দিন। ঢাকের বাদ্য আর অশ্রুভেজা ভালোবাসায় তাকে বিদায় জানিয়েছেন মর্ত্যের বাসিন্দারা। উৎসবকে পরিপূর্ণ করতে সনাতন সম্প্রদায়ের লোকজন বাড়ি বাড়ি যাত্রা পেতেছেন। মিষ্টির দোকানগুলোতে এবার কমবেশি লাড্ডু কেনার ধুম চোখে পড়ে। সেইসঙ্গে একটু ভালোমন্দ খাওয়ার আয়োজন ছিল কমবেশি সব পরিবারেই। ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় ‘আনন্দময়ীর’ নিদ্রাভঙ্গের বন্দনায় যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল, সোমবার দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনে তার সাঙ্গ হল। বাবার বাড়ি বেড়ানো শেষে দেবী দুর্গা এক বছরের জন্য ফিরে গেলেন ‘কৈলাসের শ্বশুরালয়ে’; সমাপ্তি হল বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় পার্বণ শারদীয় দুর্গোৎসবের। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেলা দেড়টায় বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটের বীণাস্মৃতি স্নানঘাটে বনানী জাকের পার্টির হিন্দু ফ্রণ্ট পূজাম-পের প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে দেবীকে বিদায় জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এ বছর শোভাযাত্রা হবে না, তা আগেই জানানো হয়েছিল। এ বছর ঢাকা মহানগরে দুইশর বেশি ম-পে পূজা হয়েছে। সবাইকে বলে দেয়া হয়েছে, যার যার মত করে এসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিমা বিসর্জন দেবে। কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিমা বিসর্জন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়। পুলিশের পাশাপাশি নৌ-পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা নদীবন্দরে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, প্রতিমা বিসর্জন যাতে সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়, বিআইডব্লিউটি থেকে প্রয়োজনীয় সব রকমের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিআইডব্লিটিএ-এর ডুবুরি দল ছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলকে বুড়িগঙ্গার তীরে রাখা হয়েছে জরুরি প্রয়োজনে মাঠে নামার জন্য। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবীপক্ষের শুরু হয় যে অমাবস্যায়, সেদিন হয় মহালয়া; আর মহালয়ার প্রাক সন্ধ্যায় ‘কাত্যায়নী মুনির কন্যা’ রূপে মহিষাসুর বধের জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। সে কারণে ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়া হলেও দেবীর পূজা এবার হয়েছে কার্তিক মাসে। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে বৃহস্পতিবার বিকালে দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পেরিয়ে সোমবার সকালে বিজয়া দশমীর ‘বিহিত পূজায়’ ষোড়শপ্রচার পূজার পাশাপাশি দেবী প্রতিমার হাতে জরা, পান, শাপলা ডালা দিয়ে আরাধনা করা হয়। সবশেষে দর্পণ বিসর্জনের সময় প্রতিমার সামনে একটি আয়না রেখে তাতে দেবীকে দেখে তার কাছ থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বিদায় নেন ভক্তরা। মহামারীর মধ্যে কড়াকাড়ি থাকলেও অন্যবছরের মত এবারও প্রতিমা বিসর্জনের আগে কোনো কোনো ম-পে আবির খেলায় মেতে উঠেছেন ভক্তরা। ঢাকেশ^রী মন্দির, পুরনো ঢাকার শাখারীবাজার, তাঁতি বাজার, রমনা কালী মন্দির, সিদ্ধেশ^রী কালীমাতা মন্দির, বরদেশ^রী কালী মন্দির, বনানী ও কলাবাগার পূজা ম-প, বাসাবো বালুর মাঠ, খিলক্ষেত রেলগেইট সংলগ্ন পূজা ম-প, লেকসিটি পূজা ম-প, ফার্মগেট সহ বিভিন্ন এলাকায় সনাতন সম্প্রদায়ের নারীরা একে অন্যকে সিঁদুর পরিয়ে দিতে দেখা যায়। ভক্তরা বলছেন, একে অন্যের মঙ্গল কামনায় তারা সিঁদুর পরান। যেন আগামী বছর একই বেশে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আবারো উৎসবে যোগ দিতে পারেন। বিবাহিত নারীরা সিঁদুর, পান ও মিষ্টি নিয়ে দুর্গাকে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর একে-অপরকে সিঁদুর মাখিয়ে দেন। তারা এই সিঁদুর মাখিয়ে দুর্গা মাকে বিদায় জানান। দুর্গাকে নিয়ে যাওয়ার আগে সিঁথিতে সিঁদুর মাখানোর পর আঙুলে লেগে থাকা বাকি সিঁদুরটুকু তারা একে-অপরের মুখে মাখেন। একে অনেকে সিঁদুর খেলাও বলে থাকেন। মুখ রঙিন করে হাসি মুখে মাকে বিদায় জানানোর জন্যই এই সিঁদুর খেলা। তাই মাকে বিসর্জনের আগ পর্যন্ত তারা একে অপরকে সিঁদুর লাগিয়ে মিষ্টিমুখ করেন, নাচ, গান করেন, যেন সারাটা বছর এমন আনন্দেই কাটে। আয়োজকরা জানান, ঢাকায় ওয়াইজঘাট ছাড়াও বসিলায় তুরাগে, সবুজবাগ ও শীতলক্ষায় প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। দুপুরের পরপরই বিভিন্ন এলাকার ম-প থেকে ট্রাকে করে প্রতিমা নিয়ে ঘাটের পথে রওনা হন ভক্তরা। শঙ্খ আর উলুধ্বনির সঙ্গে চলে খোল-করতাল-ঢাক-ঢোলের সনাতনি বাদ্য। প্রতিমা ঘাটে নেয়ার পর ভক্তরা শেষবারের মতো ধূপধুনো নিয়ে আরতি করেন। শেষে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে নৌকায় তুলে বিসর্জন দেয়া হয়। বিসর্জন শেষে মন্দিরে শান্তির জল নিয়ে আসা হয়; সন্ধ্যায় ম-পে করা হয় আশীর্বাদ। এবার সপ্তমী শুক্রবার হওয়ায় হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী দুর্গা এবার এসেছিলেন দোলায় চেপে। আর সোমবার দশমীতে দেবালয়ে ফিরলেন হাতির পিঠে চড়ে। দোলায় আগমন নিয়ে শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘দোলায় মরকং ভবেৎ’; অর্থাৎ মহামারী, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মন্বন্তর, খরার প্রভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু তো ঘটাবেই, আবার সেই সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতিও হবে। আর হাতিতে চড়ে দেবী বিদায়ের ফল হয়- ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’। অর্থাৎ তাতে পৃথিবীতে জলের সমতা বজায় থাকে এবং শস্য ফলন ভালো হয়। সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয় মর্ত্যভূমি। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, এক বছর পর নতুন শরতে আবার দেবী আসবেন ‘পিতৃগৃহ’ এই ধরণীতে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সর্বশেষ দেয়া তথ্য অনুসারে, এ বছর সারাদেশে ৩০ হাজার ২শ ২৩টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর সারাদেশে দুর্গাপূজার মন্ডপের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৩৯৮টি। গতবছরের তুলনায় এবার ১হাজার ১শ ৭৫ টি মন্ডপে পূজা কম হচ্ছে। অন্য দিকে ঢাকা মহানগরে এ বছর পূজা মন্ডপের সংখ্যা ২শ ৩৩টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিলো ২শ ৩৭টি। আর ঢাকা জেলায় পুজা হচ্ছে ৭শ ৪০টি। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলেন, এ বছর করোনা পরিস্থিতির জন্য সিঁদুর খেলাটা আনুষ্ঠানিকভাবেই বাদ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সিঁদুর খেলাকে কেন্দ্র করে সাধারণ দর্শনার্থীরাও যারা এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন তাদের কেউ এ ধরনের কর্মকা- যেন না করেন বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তবুও শেষ পর্যন্ত স্বল্প পরিসরে সিঁদুর খেলা হয়েছে। আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিমা বিসর্জন হয়।
×