ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

আইনের কিংবদন্তি ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

প্রকাশিত: ২২:১৫, ২৬ অক্টোবর ২০২০

আইনের কিংবদন্তি ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি বেশ কিছুদিন বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগে রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে গত ২৪ অক্টোবর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আমাদের দেশে বাণিজ্যিক আইনে অত্যন্ত সফল আইনজীবী এবং এই বিষয়ে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। অবশ্য সফল ও দক্ষ আইনজীবী হিসেবে আইনের সকল ক্ষেত্রেই ছিল তার সমান পদচারণা। পেশাগত জীবনে অনেক উল্লেখযোগ্য এবং দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী আইনী লড়াই তিনি যথেষ্ট দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গেই চালিয়েছেন। আইনের সকল শাখায় সমান পারদর্শিতা থাকা সত্ত্বে¡ও তিনি সাধারণত রাজনৈতিক মামলা পরিচালনায় খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে ২০০৮ সালে এক এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, উভয়ের পক্ষে আইনী লড়াই চালিয়ে রাজনৈতিক মামলা পরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন এবং যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মূলত বাণিজ্যিক আইনেই অনেক বেশি পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দেশের এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বাণিজ্যিক আইন সম্পর্কে ছিল তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য। বাণিজ্যিক আইনে তার সুনাম ও সুখ্যাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও যথেষ্টই ছিল। নব্বইয়ের দশকে তিনি মাঝেমধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ফ্রান্সে আরবিটেটর হিসেবে যেতেন ব্যবসা বাণিজ্য সংক্রান্ত আইনী জটিলতা নিষ্পত্তিতে অংশ নিতে। কথাগুলো আমাকে জানিয়েছিলেন তার অনুজ আইনজীবী মনিরুজ্জামান। বাণিজ্যিক আইনে যে অসাধারণ সফলতার স্বাক্ষর তিনি বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে রেখে গেছেন, তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং তার অনুজদের জন্য অনুসরণ করার মতো এক অধ্যায় হয়ে থাকবে। কর্মজীবনে এই গুণী আইনজীবীর সান্নিধ্যে যাবার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলাম। ’৯০-এর দশকে আমি তখন একটি বেসরকারী ব্যাংকের ঋণ বিভাগে কর্মরত ছিলাম এবং ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সেই ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের ডকুমেন্টশনের বিষয়গুলো দেখতেন, এ সংক্রান্ত দলিলপত্রাদি ভেটিং করতেন এবং ব্যাংকের আইন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে মতামত প্রদান করতেন। আমাকে ব্যাংকের নথি নিয়ে প্রায়ই সন্ধ্যার সময় তার পুরানা পল্টনের বাগান বেষ্টিত বিশাল বাড়িতে অবস্থিত চেম্বারে যেতে হয়েছে। তিনি ছিলেন ভয়ানক রাগী এবং ব্যাংকারের কোন ভুল পেলে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় গালমন্দ করতেন। এ কারণে অন্য কোন অফিসার তার কাছে সহসা যেতে চাইত না। ফলে আমাকেই বেশিরভাগ সময় তার চেম্বারে যেতে হয়েছে এবং অন্য সহকর্মীর ভুলের কারণেও আমাকে তার কাছ থেকে অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছে। তবে তা ছিল প্রকারান্তরে আমার জন্য আশীর্বাদ। কেননা ব্যাংকিং পেশায় আইনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক কিছু তার কাছ থেকেই জেনেছি, যা আমার পেশাগত জ্ঞান অর্জনে অনেকটাই সহায়তা করেছে। অবশ্য তার এই রাগান্বিত কণ্ঠস্বরের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক মিনিট। তার পরই তিনি হয়ে উঠতেন অসাধারণ একজন ভাল মানুষ। গভীর মনোযোগ দিয়ে ফাইল স্টাডি করে ভুলের কারণে কি সমস্যা হতে পারে, কিভাবে ভাল প্রতিকার পাওয়া যাবে ইত্যাদি নানা বিষয় এত সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে, পরবর্তীতে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যেত। কিন্তু প্রথম দুই-তিন মিনিট অনেকেই তার সামনে থাকতে সাহস করত না এবং ফাইল রেখে চলে আসত যারা, তিনি সে সব অফিসারকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। উপায়ন্তর না থাকায় যেহেতু ধৈর্য ধরে বসে তার গালমন্দ এবং সব কথাই শুনতাম, তাই তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে এলএলবি পাস করার জন্য উপদেশ দিয়ে বললেন যে, এলএলবি পাস করলে তিনি আমাকে তার ফার্মে নিয়ে নেবেন। তার অনুপ্রেরণাতেই আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি পাস করি। পরবর্তীতে কানাডা চলে আসার কারণে তার ফার্মে যোগ দেয়ার সুযোগ বা বাংলাদেশের কোন আদালতে প্র্যাকটিস করার সুযোগÑএর কোনটিই হয়নি। তবে অর্জিত জ্ঞান দেশে এবং কানাডায় পেশাগত দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের অনুপ্রেরণায় সে সময় এলএলবি পাস করেছিলাম বলেই পরে কানাডার খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি এলএলএম করার সুযোগ পেয়েছি। এই কোর্স করার সময় গত কিছুদিন ধরেই ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্যারের কথা খুব বেশি মনে পড়ছিল। আমি যখন তার চেম্বারে যেতাম, তখন তিনি প্রতিটা বিষয়ে কথা বলার সময় ক্রমান্বয়ে অনেক কেস ল (আদালতের সিদ্ধান্ত এবং বিচারের রায়) উল্লেখ করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করতেন যে, কমন ল-এর ভিত্তিই হল কেস ল। এই প্রসঙ্গে তিনি আমাকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছিলেন যে, আইন পেশায় সফলতা পেতে হলে ভালভাবে কেস ল পড়া এবং ব্যাখ্যা করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কথাগুলোর গুরুত্ব তখন বুঝিনি। এমনকি দেশে এলএলবি করার সময়ও এসব কথার কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে কানাডায় এলএলএম করার সময় স্যারের এই মূল্যবান উপদেশের গুরুত্ব প্রতি মুহূর্তেই উপলব্ধি করতে পারছি। মাত্র একটি এ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতেই বিশটির অধিক কেস ল পড়তে হয়েছে। অথচ এলএলবির পুরো কোর্স শেষ করতে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কেস ল পড়তে হয়নি। খুব ইচ্ছে ছিল এবার যখন বাংলাদেশে যাব, তখন স্যারের সঙ্গে দেখা করে কথাগুলো বলে স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার দোয়া নিয়ে আসব। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে উঠল না। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এরশাদ সরকারের সময় এ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করলেও নিজেকে কখনই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করেননি। নিজেকে কখনই বিতর্কিত অবস্থায় মুখোমুখি করেননি, যা আমাদের দেশের অনেক বিজ্ঞ আইনজীবীর ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ ঘটনা। এ কারণে তিনি দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছেই ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র এবং সমানভাবে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিত্ব। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অনেক আইনজীবী তার ফার্মে অনুজ হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই তৈরি করেছেন অনেক যোগ্য উত্তরসূরি, যারা তাকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের আইন পেশায় বাণিজ্যিক আইনের উপযুক্ত প্রয়োগ অব্যাহত রাখবেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের শূন্যস্থান সহসা পূরণ হবে না। তবে তার যোগ্য অনুসারীরা তার দেখানো পথে অগ্রসর হলে কিছুটা ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। ব্যক্তি জীবনেও ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ছিলেন খুবই সাদাসিদে একজন মানুষ। খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে উপার্জনের কমতি ছিল না। তার পরও তিনি সকল প্রকার বাহুল্য বর্জন করে খুবই সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন এবং উপার্জিত অর্থ দান করেছেন অকাতরে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজস্ব অর্থায়নে একাধিক হাসপাতাল ও নার্সিং হোম প্রতিষ্ঠা করাসহ ব্যক্তিগত অনুদান দিয়েছেন বারডেমসহ একাধিক হাসপাতালে। নিজস্ব একটি চ্যারিটিও পরিচালনা করেছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এমন সময় চলে গেলেন যখন বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে তার মতো বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ আইনজীবীর খুব বেশি প্রয়োজন। বাংলাদেশে বলবত সকল আইন সবেমাত্র ডিজিটাল আইন হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের জাস্টিস ল ওয়েবসাইটে হুবহু দেয়া হয়েছে। যেখান থেকে যে কেউ ইচ্ছে করলে কোন আইন দেখতে পারে বা সংগ্রহ করতে পারে। এসব আইন যদি একটি নির্দিষ্ট সময় (কাট অব টাইম) নির্ধারণ করে সন্নিবেশিত বা কনসলিডেটেট আকারে প্রকাশ করা যায়, তাহলে সেটি হবে দেশের জন্য যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ। আর এই কাজে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ছিলেন উপযুক্ত ব্যক্তি। সফল আইনজীবী হিসেবে বর্ণাঢ্য এক জীবন শেষ করে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক পরিণত বয়সেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে, যেখানে তিনি শান্তিতেই থাকবেন। লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা [email protected]
×