ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এম এ হানিফ

অপার সম্ভাবনার রুপালি ইলিশ

প্রকাশিত: ২২:১২, ২৬ অক্টোবর ২০২০

অপার সম্ভাবনার রুপালি ইলিশ

১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নবেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এই সময়ের মধ্যে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুদ করা নিষেধ। এই আইন অমান্যকারীর শাস্তি ১-২ বছরের জেল বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। গত কয়েক বছর থেকেই বছরের বিভিন্ন সময় বিশেষ করে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ রাখা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও কিছুদিন বাড়ানো গেলে হয়ত উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ইলিশ আহরণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ২০-২৫ লাখ মানুষ সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই খেয়াল রাখতে হবে নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জীবিকা যেন ব্যাহত না হয়, তারা যেন কর্মহীন হয়ে না পড়ে। এ সময় যেন তারা প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা পান। আশির দশকের আগে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ২০ শতাংশ ছিল ইলিশের অবদান। কালের পরিক্রমায় কারেন্ট জাল, ছোট ফাঁসওয়ালা জাল ও সরঞ্জাম দিয়ে নির্বিচারে জাটকা এবং মা ইলিশ নিধনের কারণে ২০০২ থেকে ২০০৩ সালে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান ৮ শতাংশে নামে এবং ২০০০-০১ সালে উৎপাদন ২.২৯ মেট্রিক টন থাকলেও ২০০১-০২ ও ২০০২-০৩ সালে কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২.২০ ও ১.৯৯ মেট্রিক টন। দেশের হাট-বাজারগুলো হয়ে পড়ে ইলিশ শূন্য, ইলিশ হয়ে ওঠে সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের খাদ্য। আশার কথা হলো বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান এখন সর্বোচ্চ ১৯ শতাংশ এবং জিডিপিতে অবদান ১ শতাংশ। বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৭৬ শতাংশ এখন বাংলাদেশের দখলে। সম্প্রতি মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ওয়ার্ল্ড ফিস, বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে দেশে ইলিশের গড় ওজন বেড়েছে প্রায় ৩০০ গ্রাম। পাঁচ বছর আগে ধরা পড়া ইলিশের অর্ধেকই ছিল ছোট ও মাঝারি আকৃতির। বড় ইলিশ পাওয়া যেত ২০-৩০ শতাংশ। চলতি বছর এ পর্যন্ত ধরা পড়া ইলিশের ৭০ শতাংশের ওজন ৫৫০ থেকে ১ হাজার ২৫০ গ্রাম, এর মধ্যে ৫৫০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ হচ্ছে ৫৫ শতাংশ। এক কেজি থেকে ১ হাজার ২৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে ১৫ শতাংশ। গেল বছর ৮৭০ গ্রাম গড় ওজন এর বিপরীতে এবার ইলিশের গড় ওজন ৯১৫ গ্রামে দাঁড়িয়েছে। ওজন ও আকৃতি বাড়ায় বেড়েছে ইলিশের মোট উৎপাদন। মৎস্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে ইলিশের উৎপাদন প্রায় তিনগুণ হয়েছে। আর প্রতিবছরই ২০-৪০ টন করে উৎপাদন বাড়ছে। গত বছরের পাঁচ লাখ ৭০ হাজার টন উৎপাদনের বিপরীতে এবার প্রায় ৬ লাখ টন উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে ইলিশের বংশবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ ও ইলিশের জীবন চক্র সম্পন্ন করতে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপের কারণে। ইলিশ রক্ষায় সরকার এ পর্যন্ত যে ক’টি পদক্ষেপ নিয়েছে তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে নিয়েছে এবং বাস্তবায়নও করেছে কঠোরভাবে। বাংলাদেশের ইলিশ এখন ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য। ২০১৭ সালে দেশ এই স্বীকৃতি লাভ করে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের জন্য একটা বড় অর্জন। ইলিশ নিয়ে দেশে গবেষণা হচ্ছে, গবেষণা ছাড়া উৎপাদন বৃদ্ধি কঠিন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চারজন শিক্ষকের গবেষণার পূর্ণ প্রতিবেদন ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে ‘প্রাইমারি প্রোডাক্টিভিটি কানেক্টস হিলশা ফিশারিজ ইন বে অব বেঙ্গল’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে গবেষকবৃন্দ বঙ্গোপসাগরের প্রাথমিক উৎপাদনশীলতার সঙ্গে ইলিশের প্রাচুর্যের সম্পর্ক চিহ্নিত করেছেন। তাদের পাওয়া তথ্য মতে, ইলিশের খাদ্য তালিকার ৯৭ থেকে ৯৮ ভাগ হচ্ছে ফাইটোপ্লাংটন বা উদ্ভিদকণা। এর উপস্থিতি বেশি রয়েছে বঙ্গোপসাগরের মেঘনা নদীর অববাহিকায়। ফলে খাবারের টানে মেঘনায় ইলিশের আনাগোনা হয় বেশি। আবার ইলিশের পোনা বা জাটকা খাদ্য হিসেবে পছন্দ করে জুপ্লাংটন বা প্রাণিকণা। এটাও সর্বোচ্চ পাওয়া যায় মেঘনা অববাহিকায়। ফলে মেঘনা অববাহিকার নদ-নদী ও উপকূলবর্তী অগভীর অঞ্চলে জাটকা বিচরণ করে এবং বেড়ে ওঠে। ফলে মেঘনাতেই ইলিশের উৎপাদন বেশি হয়। ইলিশ একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় ও পুষ্টি বিশেষ করে আমিষের চাহিদা পূরণে ইলিশের গুরুত্ব অনেক। ওয়ার্ল্ড ফিসের তথ্যমতে, ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশের পরই দ্বিতীয় স্থানে ভারত। চলতি বছরে তাদের উৎপাদন সাড়ে ১০ শতাংশে নেমেছে। তিন শতাংশ উৎপাদন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে মিয়ানমার। যথাযথ পদক্ষেপ নিলে ইলিশ হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এর জন্য ইলিশ নিয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে। ইলিশের খাদ্যের জোগান ঠিক রাখার পাশাপাশি নদীর পানিদূষণ কমাতে হবে। কারণ পানি দূষিত হলে উৎপাদনশীলতা কমবে। সেই সঙ্গে জাটকা নিধন ও মা ইলিশ ধরা বন্ধের বিকল্প নেই। ইলিশের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করতে প্রায় আড়াই’শ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের দেয়া সহায়তার পরিমাণ বাড়ে এবং তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান হয়। ইলিশে সমৃদ্ধ হোক দেশ, দেশের প্রতিটি মানুষের মুখে লেগে থাক ইলিশের স্বাদ, দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইলিশ হয়ে উঠুক অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য-এই প্রত্যাশা। লেখক : কথাসাহিত্যিক [email protected]
×