ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আইন পেশার আইকন

প্রকাশিত: ২২:০৯, ২৬ অক্টোবর ২০২০

আইন পেশার আইকন

পরিণত বয়সে চলে গেলেন সুপ্রীমকোর্টের জ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ ও প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। প্রায় এক সপ্তাহ যাবত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শেষের দিকে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক নানা সুপরামর্শ দিতেন। ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে মিথ্যা মামলায় বন্দী করে। সেই দুঃসময়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তাঁকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে আইনী লড়াইয়ে এগিয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রী গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সে কথা স্মরণ করেন। পেশাজীবনে অত্যন্ত সফল আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। সমপেশার সিনিয়র জুনিয়র বহুজনের চোখে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। অনেকেই তাকে আইন পেশার আইকন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সাধারণ সমাজে সুপরিচিত ছিলেন তিনি সততা ও লড়াকু মনোভাব এবং অনমনীয় স্বচ্ছ নির্মোহ নির্লোভ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। প্রতিটি পেশারই নিজস্ব ছন্দ ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, রয়েছে সৌন্দর্য এবং আপাত নেতিবাচক দিকও। বিশেষ করে ওকালতি পেশা সম্পর্কে সমাজে এক ধরনের ভয়মিশ্রিত এড়িয়ে চলার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। একান্ত বাধ্য না হলে কেউ আইনজীবীর দ্বারস্থ হন না। এমন একটি পেশায় সাধারণ মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠা কম কথা নয়। একই সঙ্গে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ ব্যক্তির পক্ষে আইনী লড়াই দাপটের সঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার নজির এদেশে দ্বিতীয়টি নেই। এই জায়গাটিতে তিনি এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আইনী ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি জাতীয় পর্যায়ে। এখানেই রয়েছে পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখার মহিমা। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে ১৯৩৫ সালের ২ নবেম্বর। তার শৈশব থেকে শুরু করে শিক্ষা জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে কলকাতায়। আইনজীবী হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। পরে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি লন্ডনে আইনজীবীদের অভিজাত সংস্থা ‘লিংকনস ইন’-এ ডাক পান। অভিজাত্যের হাতছানি থাকলেও তিনি দেশের টানে ওই বছরই ঢাকায় ফেরেন। ১৯৬৫ সালে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী এবং ১৯৭৩ সালে আপীল বিভাগে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের এ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। কিন্তু কোন বেতন ভাতা নেননি। অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার দিকে তার মনোযোগ ছিল না। মানুষের কল্যাণে কিছু করার কথাই ভেবেছেন চিরকাল। আর সেই দর্শন থেকে রফিক-উল হক প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ ও মেডিক্যাল কলেজ। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল বর্তমানে নির্মাণাধীন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করেছেন সুবর্ণ ক্লিনিক; ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা ছিল এ আইনজীবীর। বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও নূরজাহান ওয়ার্ড, আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল এবং আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলেন রফিক-উল হক। অন্তত ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। এমন উদাহরণ সমাজে বিরল। একজন সফল আইনজীবী হয়েও তিনি জাতির জন্য এক পর্যায়ে একজন অভিভাবক স্থানীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। আইনের ছাত্রদের যেমন তার কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার রয়েছে, তেমনি সমাজের বিত্তবান মানুষরাও অনুসরণীয় বৈশিষ্ট্য পাবেন রফিক-উল হকের জীবন ও কর্ম থেকে। এমন একজন মান্যজনের বিদায়ে আমরা আমাদের অন্তিম শৃদ্ধা ও শোকজ্ঞাপন করছি।
×