ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনার ভয় উপেক্ষা করে পূজা মণ্ডপে ভক্তদের ঢল আজ বিজয়া দশমী

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ২৬ অক্টোবর ২০২০

করোনার ভয় উপেক্ষা করে পূজা মণ্ডপে ভক্তদের ঢল আজ বিজয়া দশমী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাবার বাড়ি থেকে চলে যাবার সময় হয়েছে মেয়ের। ফিরবেন স্বামীর গৃহে। বিদায়ের ঠিক আগ মুহূর্তে মেঘলা আকাশের ফাঁকে মাঝে মধ্যে দেখা দিয়েছে রোদের ঝিলিক। তাইতো করোনার ভয় উপেক্ষা করে বিপুল উৎসাহ নিয়ে ভক্তরাও ছুটে এসেছেন মণ্ডপে মণ্ডপে। প্রাণ ভরে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে দর্শন করেছেন। অংশ নিয়েছেন অঞ্জলিতে। ভক্তি জানিয়েছেন। জগতের সব দুঃখ কষ্ট আর জরা থেকে মুক্তির প্রার্থনা জানিয়েছেন দশভূজা দেবীর কাছে। নবমীর সকাল মানে অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি। শারদীয় দুর্গা উৎসবের নবমীর এ দিনটিতে দেবী দুর্গা অসুরকে বধ করেছিলেন। সে প্রত্যয়েই এদিন নিজেদের মনের ভেতর ও বাইরের অসুর বধের আশায় মায়ের কৃপা প্রার্থনা করেছেন ভক্তরা। দিন শেষে মণ্ডপে মণ্ডপে যেন নেমে আসে বিষাদের সুর। রাত পোহালেই বিজয়া দশমী। সকাল সাতটা ৪৭ মিনিটের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে দশমী বিহিত পূজা। এর পরই সমাপনান্তে বিসর্জন পর্ব। তাইতো কারও মন ভাল নেই। আজ প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাঁচদিনব্যাপী দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটবে। চণ্ডীপাঠ, বোধন এবং দেবীর অধিবাসের মধ্য দিয়ে ২২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার থেকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে শুরু হয় বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এবার দেবী এসেছেন দোলায়, যাবেন গজে চড়ে। যদিও করোনা মহামারীর কারণে সংক্রমণ এড়াতে এ বছর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয়। উৎসব সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরিহার করে সাত্ত্বিক পূজায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে বিধায় এবারের দুর্গোৎসবকে শুধু ‘দুর্গাপূজা’ হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ। মণ্ডপে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি সীমিত করা ও সন্ধ্যায় আরতির পরই বন্ধ করে দেয়া হয় পূজামণ্ডপ। ছিল না সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা। জনসমাগমের কারণে স্বাস্থ্যবিধি যাতে ভঙ্গ না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেই প্রসাদ বিতরণ ও বিজয়া দশমীর শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়। পূজার সময় বেশিরভাগ ভক্তরা এবার অঞ্জলি নিয়েছেন ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে। তবে রবিবারে মণ্ডপগুলোর দৃশ্যছিল একেবারেই ভিন্ন রকম। অন্যদিনের তুলনায় নবমীতে যেন ভক্তদের ঢল নামে। রাত অবধি কমবেশি ভিড় ছিল সবক’টি পূজা প্রাঙ্গণ। ছোট্ট পরিসরে হয়েছে গান ও নাচের আয়োজনও। এদিকে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকানুযায়ী ভোর ৫টা ১৭ মিনিট থেকে সকাল ৭টার মধ্যে দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা প্রশস্ত সম্পন্ন হয়। অনেকের বিশ্বাস মহানবমীর দিন হচ্ছে দেবী দুর্গাকে প্রাণ ভরে দেখে নেয়ারক্ষণ। এই দিন অগ্নিকে প্রতীক করে সব দেবদেবীকে আহুতি দেয়া হয়। অগ্নি সব দেবতার যজ্ঞভাগ বহন করে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। নবমী পূজা হচ্ছে দুর্গাপূজার অন্তিম দিন। পরের দিন কেবল বিজয়া ও বিসর্জনের পর্ব। নবমী রাত তাই বিদায়ের অমোঘ পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়। আজ দশমী পূজা শেষে দর্পণ বিসর্জনের পর বিকেলে দেবী দুর্গা ও অন্যান্য দেবদেবীর বিসর্জন দেয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে দেবী মর্ত্য ছেড়ে স্বর্গে ফিরবেন। শ্রী সমীরেশ্বর ব্রহ্মচারীর কথায়, বিজয়া দশমীর দিন সংক্ষিপ্ত পূজার পর দর্পণ বিসর্জন হয়। কোন কোন জায়গায় দেবীর অপরাজিতা পূজাও হয়। এই দিনেই রাবণ বধের জন্য দশেরা উৎসবও পালিত হয়। এই দিনটিতে অসুর নিধনের পর অসুরের রক্ত দিয়ে দেবতারা বিজয় উৎসব পালন করেছিলেন। পুরাণ মতে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত যুদ্ধের পর দশম দিনে জয়ী হন দেবী দুর্গা। এজন্যই বিজয়া। সেই লোকাচার বাংলার ঘরে ঘরে সিঁদুর খেলা হিসেবে পরিণত হয়েছে। সিঁদুর খেলার পাশাপাশি চলবে কোলাকুলিও। তবে করোনা মহামারীর কারণে এবার কোলাকুলি হবে না। একইভাবে এবার দুর্গাপূজায় শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিমা বিসর্জন হবে না। বিসর্জনের জন্য একটি ট্রাকে একসঙ্গে অনেক মানুষ গেলেও এবার একটি ট্রাকে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য ১০ জন যেতে পারবেন। এর বাইরে অতিরিক্ত যাওয়া যাবে না বলে এর আগে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটারর্জী বলেন, ‘আগামীকাল বিজয়া দশমীর দিন শোভাযাত্রা পরিহার করে প্রতিমা বিসর্জনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মণ্ডপ বা মন্দির কর্তৃপক্ষ স্বউদ্যোগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা নেবেন।’ বিজয়া দশমী উপলক্ষে আজ সরকারী ছুটির দিন। পূজা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। বিজয়া উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারী টিভি চ্যানেল ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে। এছাড়া জাতীয় দৈনিকগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করবে। করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের পক্ষ থেকে এবার সরাসরি টেলিভিশনে এবং ফেসবুকে অঞ্জলি দেয়ার ব্যবস্থার কথা আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। ভক্তদের বাসায় বসেও অঞ্জলি নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এবার অনেক ভক্তই বাসায় বসে প্রতিদিন পূজার অঞ্জলি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সর্বশেষ দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারাদেশে ৩০ হাজার ২শ’ ২৩টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর সারাদেশে দুর্গাপূজার মণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৩৯৮টি। গতবছরের তুলনায় এবার ১হাজার ১শ’ ৭৫টি মণ্ডপে পূজা কম হচ্ছে। অন্য দিকে ঢাকা মহানগরে এ বছর পূজা মণ্ডপের সংখ্যা ২শ’ ৩৩টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিলো ২শ’ ৩৭টি। আর ঢাকা জেলায় পূজা হচ্ছে ৭শ’ ৪০টি। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পূজা উদ্যাপন পরিষদের পক্ষ থেকে বিজয়া দশমী উপলক্ষে দেশের সকল মানুষকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। পরিষদ শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদ্যাপনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করায় সকল রাজনৈতিক দল, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে অষ্টমীর আনন্দ শেষে নবমীতে দুর্গোৎসবের শেষ দিনে গা ভাসিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তাইতো ঢাকের বাদ্য, পূজার আমেজ আর প্রতিমা বন্দনায় মাতোয়ারা সবাই। মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলার মধ্যেই মণ্ডপে মণ্ডপে সকল ধর্মের মানুষের ঢল নামে। সকাল ১১টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি, রমনা কালী মন্দির, জগন্নাথ হল কাওরানবাজারে মিডিয়াপাড়া পূজা মণ্ডপ, পুরান ঢাকা, বনানী পূজা মণ্ডপ, বরদেশ্বরী কালী মন্দির, বাসাবো বালুর মাঠ, খিলক্ষেত রেল গেটসহ বিভিন্ন এলাকার মণ্ডপে দেখা গেছে অঞ্জলি নিতে ভক্তদের ভিড়। আয়োজনকরা জানিয়েছেন, রবিবার প্রতিমা দর্শন ও অঞ্জলিতে সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী হয়েছে। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী বলেন, রামচন্দ্রের অকাল বোধনই আজ শারদীয় দুর্গোৎসব। সেদিন রামচন্দ্র অশুভের প্রতীক রাবণ বধের নিমিত্তে দেবী দুর্গাকে আহ্বান করেছিলেন। ঠিক তেমনিভাবে আমরাও মনের ভেতর ও বাইরের অসুর বধের আশায় মায়ের কৃপা প্রার্থনা করব। তিনি বলেন, গোটা পৃথিবীতে অস্থিরতা। আজ বাদে কাল আমরা মায়ের প্রতিমা বিসর্জন দেব। তারপর করব বিজয় উৎসব। অশুভোর বিপরীতে শুভোর বিজয় সূচিত করতে আমরা মায়ের কাছে প্রার্থনা করছি।
×