মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে ভূমিদস্যুদের পক্ষ নিয়ে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসে মদদ দিচ্ছে বিভিন্ন নন গবর্মেন্ট অর্গানাইজেশন (এনজিও)। পাহাড়ে থাকাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইকে পুঁজি করে আবাসের ঋণ দিয়ে ভূমিদস্যুদের পক্ষে এনজিওগুলো কাজ করছে বলে অভিযোগ গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। দ্বিগুণ সুদের একচেটিয়া ব্যবসায় মেতে উঠেছে এনজিওগুলো। পাহাড়ে বসতি গড়ার বিষয়ে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে থাকা পরিবেশ বিভাগের যেন কোন মাথাব্যথা নেই। মেট্রো ও জেলা পরিচালকরা কেন প্রাকৃতিক স্পট ফয়’স লেক, লালখানবাজার, খুলশী ও ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোডের দুপাশে থাকা নগরীর অর্ধশত পাহাড় কাটা বন্ধে চুপসে আছেন তা নিয়ে সচেতনদের সমালোচনার ঝড় ও জেলা প্রশাসনের কৌতূহল তুঙ্গে।
এদিকে এসব পাহাড় ঘিরে বিভিন্ন এনজিও মোটা সুদে নানা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এই পাহাড়কে ঘিরেই নানামুখী প্রজেক্ট। ব্র্যাক, জাইকা, ডিএফআইডি, ইউকে এইড, এলআইইউপিসি, ইউএসএইডের মতো দেশী-বিদেশী এনজিও, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণের নামে গড়ে ওঠা সমিতিগুলো পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ আবাসনে থাকাদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও স্যানিটেশন, স্কুল প্রজেক্ট, বেবি-মাদার হেলথ কেয়ারের নামে নানামুখী প্রজেক্ট রয়েছে। সব প্রজেক্টের পেছনে রয়েছে দ্বিগুণ সুদের ঋণ। এ সুযোগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, দুস্থ সেবা কেন্দ্র (ডিএসকে), ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিও ওই এলাকায় পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হলেও শেষ পর্যন্ত অবৈধরা পুনরায় গেঁড়ে বসছে পাহাড়সহ সরকারী পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে।
অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরী এলাকায় ১৭টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বসবাস করছে স্থানীয় কাউন্সিলরদের নিয়ন্ত্রণে। এসব পাহাড়ে দখল বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন সেবা সংস্থার পক্ষ থেকেও বসবাস উপযোগী বিদ্যুত, গ্যাস ও ওয়াসার লাইনও প্রতিস্থাপন হচ্ছে। লালখান বাজার এলাকায় বাটালি হিল অবৈধ স্থাপনার দখলদারিত্ব বজায় রেখেছেন সাবেক কাউন্সিলর মানিক। মতিঝর্না এলাকার ওয়াসার টাঙ্কির পাহাড়, রেলওয়ে পাহাড় নিয়ে গড়ে তোলা স্থাপনায় ভাড়া বাণিজ্য ও দখল বাণিজ্য চালাচ্ছেন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা নেতাকর্মীরা। মহানগর মহিলা বিএনপির সভানেত্রী ও সাবেক কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম মনি ও আবুল হাসনাত বেলালসহ চারটি গ্রুপের মধ্যে প্রায়শ দখলদারিত্ব নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। খুলশীর জালালাবাদ এলাকায় পাহাড় কাটা ও দখলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সাবেক কাউন্সিলর মানিক, জাহিদুল ইসলাম ও খসরু নিয়ন্ত্রণ করছে।
আরও অভিযোগ উঠেছে, চউক অনুমোদন দেয়ার পর পরিবেশ অধিদফতরের ইন্সপেক্টরদের অবৈধ লেনদেনের কারণে এবং পুলিশের পকেট বাণিজ্যর কারণে পাহাড়ে ভূমিদস্যুরা প্রথমে আগুন লাগিয়ে গাছ নিধন, গাছের গোড়া উপড়ে ফেলে দেয়া ও পাম্পের মাধ্যমে পানি ঢেলে মাটি নরম করে বর্ষাকালে পাহাড়ের মাটি ধসে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। খুলশী থানাধীন মুরগিফার্ম এলাকার সড়ক দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে হাইরাইজ বিল্ডিংসহ ছোট বড় স্থাপনা। এসব হাউজিং সোসাইটিকে প্রাধান্য দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিররা কাঠাপ্রতি চাঁদা বাণিজ্য করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ সিডিএর নক্সা এবং সিটি কর্পোরেশনের রোডম্যাপ অনুমোদন করে পাহাড়ী জায়গার পরিবেশহানি করা হলেও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর।
জানা গেছে, ফয়’স লেক ও আশপাশের এলাকার ৩২৫ একর জমি নিয়ে ২০০৪ সালে কনকর্ড গ্রুপের সঙ্গে রেলওয়ের চুক্তি হয়। শতাধিক একর পাহাড়ী জমি এখনও রেলের দখলে নেই। এসব পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে ঝিল-১, ঝিল-২ ও ঝিল-৩ এলাকা। ফয়’স লেকের উত্তর পশ্চিম কোণে সী-ওয়ার্ল্ডের পেছনে জিয়ানগর, শান্তিনগর ও মধ্যমনগরের মতো পাহাড়ী এলাকা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের লেকসিটি আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এ এলাকায়ও বেশকিছু পাহাড় কাটা হয়েছে দীর্ঘ ১৫ বছর আগে। জয়ন্তিকা আবাসিক এলাকা বাস্তবায়নেও পিছিয়ে নেই পাহাড় কাটা।
পাহাড়ী জমি কর্তন করে রিসোর্ট এবং কনকর্ড এ্যামিউজমেন্ট পার্ক তৈরি করায় লিজ চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে। ফলে কনকর্ডের সঙ্গে লিজ চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে রেলওয়ে। কিন্তু কনকর্ডের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশনের মাধ্যমে স্থগিতাদেশ আদায় করা হয়েছে রেলের বিরুদ্ধে। ফলে রেল কোন ধরনের উচ্ছেদ অভিযান করতে পারছে না ওই এলাকায়।
আরও অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও চউকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেট ভূমি অফিসের সঙ্গে কোন ধরনের যোগাযোগ না করেই নক্সা অনুমোদন দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে খতিয়ানে উল্লিখিত এবং বিএস রেকর্ডেও টিলা শ্রেণীকে সমতল দেখিয়ে নীলাচল হাউজিং সোসাইটি, কৃষ্ণচূড়া হাউজিং সোসাইটি, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি, লোহাগাড়া হাউজিং সোসাইটিসহ কয়েকটি হাউজিং সোসাইটির অনুমোদন দিয়েছে চউক। অথচ পাহাড় কাটা ছাড়া এসব হাউজিং সোসাইটি গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: