ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গেমে আসক্তি থেকে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে

ইন্টারনেট এ্যাবিউজ ॥ বিপথে যাচ্ছে কিশোররা

প্রকাশিত: ২৩:০০, ২৫ অক্টোবর ২০২০

ইন্টারনেট এ্যাবিউজ ॥ বিপথে যাচ্ছে কিশোররা

সমুদ্র হক ॥ চিত্র-১ : গৃহবধূ আসিয়া বললেন, তার কিশোর ছেলেকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। মা বাবার কথা শোনে না। কিশোর অপরাধীদের সঙ্গে ঘুরে ইন্টারনেটে ফ্র্রি ফায়ার, পাবজিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক গেম খেলা শিখেছে। বাড়িতে সারাক্ষণ স্মার্ট ফোন নিয়ে গেম খেলে। যে কোন সময় ঘর থেকে বের হয়ে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে মেশে। ইভটিজিং করে। ধমক দিলে পাল্টা হুমকি দেয়। চিত্র ২ : চাকরিজীবী আরিফা বললেন সকালে তিনি ও তার স্বামী রফিক কাজে বের হন। বাড়িতে কখনও কাজের বুয়া কখনও তার বোনের কাছে ছেলেকে রেখে যান। তার ১২ বছরের ছেলে নেটে পড়ার নাম করে গেম খেলছে। বারণ করলে শোনে না। সেও এই বয়সে মা বাবাকে কঠিন ভাষায় হুমকি দিতে শিখেছে। চিত্র ৩ : একজন অভিভাবক তার কিশোর ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে যখন পুলিশের কাছে রিপোর্ট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তখনই শোনেন তার ছেলে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে। তার ছেলে ও কয়েক কিশোর বন্ধু ইন্টারনেটে গেমে আসক্তি ছিল। তারা অপরাধের একটি গ্রুপ তৈরি করেছিল। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ দিচ্ছে নেটে প্লে-স্টোরের গেমের কিছু এ্যাপস তাদের মেধাকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। অনেক মা বাবা তাদের কিশোর সন্তানের হাতে কোন কিছু না ভেবে হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্ট ফোন। অনেক মা বাবা সন্তানের মেধা বিকাশের জন্য লেখাপড়া করতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্ট ফোন। এইসব বাড়িতে নেট সংযোগ নেয়া হচ্ছে। অনেক অভিভাবক মনে করছেন, করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তারা ঘরে বসে কি করবে। বাইরে গিয়ে ভিন্ন ধরনের ছেলেদের সঙ্গে মেশার চেয়ে ঘরে বসে স্মার্ট ফোন নিয়ে মেতে থাক। লেখাপড়া করুক। গেম খেলুক। সময় কেটে যাবে। আবার চাকরিজীবী দম্পতি ঘর ছেড়ে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন সন্তানের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিয়ে। বর্তমান সময়ে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে এ ধরনের দৃশ্য চোখ পড়বে। কোন সিনিয়র সিটিজেন উল্লিখিত শ্রেণীর অভিভাবকদের সন্তানের মঙ্গলের জন্য নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানালে পাল্টা দুই ধরনের উত্তর মেলে। ১. প্রযুক্তির বিপক্ষে কথা বলা হচ্ছে। ২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। লেখাপড়া নেই। এই কিশোররা ঘরে বসে করবে টা কী! এই বিষয়ে বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের ইংরেজী বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ওসমান গণির সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি জানালেন বিশে^ যত প্রযুক্তি আসবে ও আধুনিকায়ন হয়ে যুগোপযোগী হবে ততই মঙ্গল। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রযুক্তি বড় ভূমিকা রাখবে। তবে বড় কথা হলো : আমরা এই প্রযুক্তিকে কিভাবে ব্যবহার করব। প্রতিটি উদ্ভাবনের ভাল দিক আছে। আবার এ্যাবিউজও আছে। আমরা এ্যাবিউজকে প্রোটেক্ট করছি না। যেমন একজন কিশোর স্মার্ট ফোন হাতে পেয়ে ফ্রিফায়ার গেম খেলছে। যেখানে আছে- কিশোর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কৌশলে গুলি করে যতজনকে কুপোকাত করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে তখন তাকে বিজয়ী করা হবে। এই বিজয়ী হওয়ার জন্য সে খেলাকে নেশা হিসেবে নেবে। এমন অনেক গেম আছে যা কিশোরদের এতটাই আসক্তি করছে যে নাওয়া খাওয়া ভুলে মা বাবার অবাধ্য হচ্ছে। ওই ধরনের গেমের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মনস্তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নূর আফরোজ বলেন, যে শিশু বা কিশোর আসক্তিতে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেলছে অবচেতনেই তার কৌতূহলী মনে প্রথমে ক্ষীণভাবে বাড়ির ভেতরে ছোট খাটো অপরাধ প্রবণতার সৃষ্টি হচ্ছে। ধীরে ধীরে তা ভয়াবহ পরিণতির দিকে যায়। সে তার মা বাবা ও স্বজনদের অবাধ্য হতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে তার মধ্যে জন্ম নেয় অপরাধ প্রবণতা। সে খুঁজতে থাকে এমন সহযোগীদের। সে ঘরের বাইরে গিয়ে মা বাবা ও স্বজনদের চোখ এড়িয়ে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। এই গেমগুলো এতটাই নেশা ধরিয়ে দেয় যে সে গেমে যা দেখেছে বাস্তবেও তাই করতে চায়। এই অপরাধীরা ইভটিজিং থেকে শুরু করে হেন কোন কাজ নেই যা করতে শুরু করে। বগুড়ার একটি বাস্তব চিত্র : গত ১৩ অক্টোবর বেলা আড়াইটার দিকে রহমাননগর এলাকায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে কয়েক কিশোর খেলছিল। এ সময় শান্ত নামের এক কিশোরকে মারছিল দুতিনজন। অন্য কিশোররা এগিয়ে না গিয়ে বিকৃত মজা দেখছিল। এ সময় রাস্তার ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন এলাকার সমাজসেবক ও সজ্জন ব্যক্তি রশিদুল ইসলাম। সে কিশোরদের নিবৃত্ত করে তাদের ঘরে যেতে বললে কিশোররা ক্ষিপ্ত হয়ে রশিদুলকে ছুরিকাঘাত করে। বশির নামের এক ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করতে এলে তাকেও ছুরিকাঘাত করে কিশোররা। রশিদুলকে হাসপাতালকে নেয়ার পর মারা যায়। ঘটনার পর পুলিশ দুই কিশোরকে গ্রেফতার করে। লোকজন জানায়, কয়েকটি কিশোর গ্যাং বগুড়া শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে আছে। প্রত্যেকের কাছে স্মার্ট ফোন আছে। কোন স্থানে গিয়ে একত্রিত হয়ে তারা নানা ধরনের অপরাধ করে। শহরের কয়েক অভিভাবক জানান, সন্তানদের মানুষ করতে হলে পারিবারিক বন্ধন জরুরী। ছেলেমেয়েদের কাছে টেনে নিয়ে গল্প করা। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়া। এক সঙ্গে টিভির ভাল অনুষ্ঠান দেখা। প্রয়োজনে নেটের সৃষ্টিশীল, শিক্ষা ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখা। সন্তানদের স্মার্ট ফোন দিয়ে একাকীত্বের মধ্যে রেখে দিলে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গড়ে উঠবে। করোনাকালের এই সময়ে খুবই সাবধানে শিশু কিশোরদের সঙ্গে আচরণ করা দরকার। এই বিষয়ে বগুড়ার সোনালী ব্যাংকে কর্মরত অফিসার তানিয়া হাসান বললেন সরকারের উচিত ভাল শিক্ষামূলক এ্যাপস রেখে শিশুমনে অপরাধ রেখাপাত করে এমন এ্যাপস বন্ধ করে দেয়া। একটি বেসরকারী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক হাসনাত সাঈদ বললেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি ভাবছেন। কিশোরদের ভাল কাজে উৎসাহ দেয়া দরকার। সৃষ্টিশীল মেধার অনেক কিশোর আছে। যারা প্রযুক্তি নিয়ে ভাল কিছু করতে পারে। আবার অনেকে আছে গেমে আসক্ত হয়ে লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত কিভাবে তাদের সন্তানদের লালন করবেন। এ বিষয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কিশোরদের আপরাধ দূর করতে পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট নয়। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সাইবার ক্যাফের এক মালিক বললেন, বিটিআরসির উচিত সার্বিক বিষয় বিবেচনায় এনে এমন কিছু করা যাতে প্রজন্মের কিশোররা বিপথে না যায়।
×