ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১০৮ পদ্ম ও প্রদীপ দিয়ে অষ্টমীর আরাধনা

মহা নবমীতে দেবী দুর্গাকে প্রাণ ভরে দেখে নেয়ার ক্ষণ

প্রকাশিত: ১৭:৩৯, ২৪ অক্টোবর ২০২০

মহা নবমীতে দেবী দুর্গাকে প্রাণ ভরে দেখে নেয়ার ক্ষণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কল্পারম্ভ আর সন্ধিপূজার মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে সনাতম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার তৃতীয় দিন ‘মহাঅষ্টমী’। সকালে ষোড়শ উপাচারে অনুষ্ঠিত হয় দেবীর পূজা। ১০৮ পদ্ম এবং প্রদীপ দিয়ে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধনা করা হয়। বেশিরভাগ ভক্ত এবার অঞ্জলি নিয়েছেন ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে কিছু দর্শনার্থী অবশ্য মন্দিরে উপস্থিত হয়ে ভোগ নিবেদন আর উপবাসে অঞ্জলি গ্রহন করেছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার রাজধানীর কোন মন্দিরে কুমারী পূজার আয়োজন হয়নি। তবে চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাঁচদিনব্যাপী শুরু হওয়া সার্বজনীন উৎসবের আজ মহানবমী। মন্ডপে মন্ডপে বাজবে বিদায়ের সুর। সোমবার দশমী শেষে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে উৎসবের। করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক আর কার্তিকের নি¤œচাপের প্রভাবে বৃষ্টির কারণে এবারের উৎসবের আনন্দ অনেকটাই ম্লান করেছে। প্রাণঘাতি ভাইরাসের এবারের পূজায় বেচা কেনাও হয়েছে অনেক কম। খুব একটা ভীড় লক্ষ করা যায়নি দোকানপাট ও শপিং মল গুলোতে। অনেকেই অর্থনৈতিক টানাপোড়ের মধ্যে গত বছরের পোশাক দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ কেনাকাটা করলেও বাজেটে কাঁটছাট করতে হয়েছে। ষষ্ঠী থেকে সপ্তমী হয়ে অষ্টমীতেও ছিল বৃষ্টি। দিনভর থেমে থেমে বাদলা হাওয়া মন্ডপে যেতে বাঁধা সৃষ্টি করেছে। তবুও উৎসব বলে কথা। অনেকেই বৃষ্টির মধ্যে এসেছেন মন্ডপে। ভোগ দিয়েছেন। মায়ের পায়ে দিয়েছেন পদ্ম। করোনার কারণে এবার পদ্মা ফুলেরও আকাল। দাম বেড়েছে কয়েকগুন। তারপরও মিলছে না। প্রশ্ন হলো অষ্টমীতে নির্দিষ্ট ১০৮পদ্মা ফুল কেন। পুরোহিতরা বলছেন, সন্ধি পূজোর সময় দেবীকে চামু-া রূপে পূজা করা হয়। পুরাণে এই পূজার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। বলা হয়, অষ্টমী এবং নবমীর সন্ধিক্ষণের এই পূজায় সারা বছর বিশেষ ফল লাভ হয়। বলা হয়, রামচন্দ্রের হয়ে রাবণ বধের জন্য ব্রহ্মা দেবীর বোধন করেছিলেন আশ্বিনের কৃষ্ণা নবমী তিথিতে। ব্রহ্মা বলেছিলেন, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা নবমী তিথিতে আমরা সংকল্প করছি যতদিন পর্যন্ত না রাবণ বধ হয় ততদিন পর্যন্ত আমরা তোমার পুজো করে যাব। এরপরই দেবী তুষ্ট হন। বলেন, নবমীর অপরাহ্ণেই রাবণ বধ হবে। পুরাণ মতে দেবী দুর্গা যখন মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে রত তখন তাঁর দুই সেনা চন্ড ও মুন্ড দেবীকে আক্রমণ করে। তখন দেবী দুর্গার তৃতীয় নয়ন থেকে এক দেবীর আবির্ভাব হয় যিনি চন্ড ও মুন্ডকে বধ করেন। এই কারনে দেবীর নাম হয় চামুন্ডা। সন্ধিক্ষণে আসলে দেবী চামু-ারই পূজা হয় ১০৮ পদ্ম ও ১০৮ প্রদীপ জ্বালিয়ে। তাছাড়া পদ্মফুলের জন্ম পাঁকে। কিন্তু, তবুও পদ্মফুল পাঁক থেকে ওঠে গায়ে পাঁকের দাগ না নিয়ে। পদ্ম আসলে এই ইঙ্গিতই দেয় যে পরিবেশ শেষ কথা নয়। খারাপ পরিবেশে জন্মেও অনেক ভালো কাজ করা যায়, যেমন পাঁকে জন্মে পদ্ম পূজার আবশ্যিক অঙ্গ। হিন্দু শাস্ত্র মতে ১০৮ সংখ্যাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেবতাদের থাকে অষ্টোত্তর শতনাম। ১০৮ পদ্ম, ১০৮ প্রদীপ। যোগের ক্ষেত্রেও ১০৮ সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ। আয়ুর্বেদ মতে শরীরে ১০৮ টি ‘পয়েন্ট’ আছে। শনিবার সন্ধ্যায় নগরীর বিভিন্ন পূজা ম-প ঘুরে দেখা গেছে, ভক্তদের উপস্থিতি আগের চেয়ে অনেক কম। যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগই স্বাস্থ্যবিধি মেনে। তাছাড়া ম-প প্রাঙ্গনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন না থাকায় ভক্তরা দ্রুতই বাড়ি ফিরছেন। অন্য বছরের চেয়ে এবারের আলোকজ্জাও অনেক কম হয়েছে। কয়েকটি মন্দিরে একেবারেই সীমিত পরিসরে হয়েছে প্রসাদ বিতরণ। আরতিতেও খুব একটা ভীড় দেখা যায়নি। করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে এবার সরাসরি টেলিভিশনে এবং ফেসবুকে অঞ্জলি দেয়ার ব্যবস্থার কথা আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। ভক্তদের বাসায় বসেও অঞ্জলি নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। সেই আহবানে সাড়া দিয়ে এবার অনেক ভক্তই বাসায় বসে অঞ্জলি গ্রহন করেন। মহাঅষ্টমীর মূল আকর্ষণ হচ্ছে কুমারী পূজা। সকল নারীর মধ্যে মাতৃরূপ এই উপলব্ধি সবার মধ্যে জাগ্রত করার লক্ষ্যে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে প্রতিবছর এই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হলেও এবার নির্দেশনার কারণে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়নি। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকানুযায়ী ভোর ৫টা ১৭ মিনিট থেকে সকাল ৭ টার মধ্যে দুর্গাদেবীর মহা নবমী কল্পারম্ব ও বিহিত পূজা প্রশস্ত। অনেকের বিশ^াস মহানবমীর দিন হচ্ছে দেবী দুর্গাকে প্রাণ ভরে দেখে নেয়ার ক্ষণ। এই দিন অগ্নিকে প্রতীক করে সব দেবদেবীকে আহুতি দেয়া হয়। অগ্নি সব দেবতার যজ্ঞভাগ বহন করে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। এই দিনই দুর্গাপুজার অন্তিম দিন। পরের দিন কেবল বিজয়া ও বিসর্জনের পর্ব। নবমী নিশিথে উৎসবের রাত শেষ হয়। নবমী রাত তাই বিদায়ের অমোঘ পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়। এ সব বিবেচনা করে অনেকেই মনে করেন নবমীর দিন আধ্যাত্মিকতার চেয়েও অনেক বেশি লোকায়ত ভাবনায় ভাবিত থাকে মন। করোনা মহামারীর কারণে সংক্রমণ এড়াতে এবছর বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। উৎসব সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরিহার করে সাত্ত্বিক পূজায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে বিধায় এবারের দুর্গোৎসবকে ‘দুর্গাপূজা’ হিসেবে অভিহিত করেছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। সন্ধ্যায় আরতির পরই বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে পূজামন্ডপ। থাকছে না সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা। জনসমাগমের কারনে সাস্থ্যবিধি যাতে ভঙ্গ না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেই দুর্গা পূজায় আগেই প্রসাদ বিতরণ ও বিজয়া দশমীর শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চন্ডীপাঠ, বোধন এবং দেবীর অধিবাসের মধ্য দিয়ে ২২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে বাঙালি শারদীয় দুর্গাপূজা। এবার দেবী এসেছেন দোলায়, যাবেন হাতিতে চড়ে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সর্বশেষ দেয়া তথ্য অনুসারে, এ বছর সারাদেশে ৩০ হাজার ২শ ২৩টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর সারাদেশে দুর্গাপূজার মন্ডপের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৩৯৮টি। গতবছরের তুলনায় এবার ১হাজার ১শ ৭৫ টি মন্ডপে পূজা কম হচ্ছে। অন্য দিকে ঢাকা মহানগরে এ বছর পূজা মন্ডপের সংখ্যা ২শ ৩৩টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিলো ২শ ৩৭টি। আর ঢাকা জেলায় পুজা হচ্ছে ৭শ ৪০টি। বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ- তাপস এদিকে করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজার সব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। শনিবার দুপুরে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা ম-প পরিদর্শন শেষে এ কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ধর্মীয় কাজগুলো সম্পন্ন করবেন। মেয়র বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ সারাদেশের মন্দির, ম-পের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করে চলেছেন। সেইসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সব মন্দির, মন্ডপের উন্নয়ন কাজেও আমরা সম্পৃক্ত রয়েছি। ভবিষ্যতে এসব মন্দির, মন্ডপের আরও উন্নয়ন কিভাবে করা যায়, সে বিষয়ে আমার কাজ করবো। তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির সৃষ্ট হয়েছে, সেটি সবাই বজায়ে রাখবো। বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে সারা বিশ্বে নজির স্থাপন করবে বলেও আশা ব্যক্ত করেন ডিএসসিসির মেয়র। কোথাও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা নেই- ডিএমপি কমিশনার রাজধানীর সব পূজাম-পে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দর্শনার্থীরা সুন্দরভাবে পূজামন্ডপে আসছেন। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। শনিবার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন শেষে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এবার পূজান্ডপে দর্শনার্থীদের চলাচলে স্ট্যান্ডিং ফোর্স দেয়া সম্ভব হয়নি। পূজামন্ডপে দর্শনার্থী যারাই আসছেন, তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, তারা নিরাপত্তার বিষয়ে সন্তুষ্ট। এছাড়াও করোনা পরিস্থিতিতে রাজধানীর যেখানেই জনসমাগম বেশি দেখা যাচ্ছে, সেখানেই টহল পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। ডিএমপি কমিশনার বলেন, রাজধানীর কোনো পূজামন্ডপে এখনও পর্যন্ত কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি। আমরা মনে করি, অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটার আশংকা নেই। দর্শনার্থীরা অত্যন্ত আনন্দমুখর পরিবেশে পূজামন্ডপে আসছেন। সেই সঙ্গে আমরা প্রত্যাশা করি, সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অনুষ্ঠান পালন করুন। এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে মূল জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বিভিন্ন অপপ্রচার চালাবে এটা সবাই জানে। তাদের অপপ্রচার যদি বিশ্বাস করতে হয়, তবে ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে পারবো না। তারা যেসব আপত্তিকর অপপ্রচার চালাচ্ছে সেসবের কোনো ভিত্তি বা অস্তিত্ব নেই। ঢাকেশ^রী মন্দিরে অঞ্জলি শেষে পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, আমরা যেন একটি সুন্দর প্রভাতে আবার সবাই একত্রিত হতে পারি, আমরা যেন আবার সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। সবাই যেন ভালো থাকে। তিনি বলেন, উৎসবে মায়ের কাছে প্রার্থণা একটা অসুর শক্তি বিনাশকারী দেবী দূর্গা সবাইকে বিপদ থেকে মুক্তি দিবেন।
×