ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বিশ্বকে সতর্ক করল যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ২২:১৯, ২৪ অক্টোবর ২০২০

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বিশ্বকে সতর্ক করল যুক্তরাষ্ট্র

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ দীর্ঘ সময় জুড়ে থমকে আছে প্রত্যাবাসন। বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেও মিয়ানমার এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করেনি। ফলে বিষয়টি রীতিমতো প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আর্থিক অনুদানের সহায়তায় সৃষ্টি হয়েছে সঙ্কট। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের জন্য ২০২০ সালে ১০০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তার যে টার্গেট দিয়েছিল তাতে সাড়া মিলেছে অর্ধেক। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যু আর্থিক সহায়তার সঙ্কটের কবলে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সারাবিশ্বকে সতর্ক করেছে। প্রত্যাবাসনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারকে নতুন করে তাগাদা দিয়েছে। এর পাশাপাশি বলেছে, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান না হলে তাতে এ জনগোষ্ঠী ও অন্যরা বিপদে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয়ে যে ভার্চুয়াল সম্মেলন হয়েছে তার ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশসহ রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট দাতা দেশ, দাতা সংস্থা ও সহমর্মী দেশ ও সংস্থাগুলোতে নতুন করে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, বিপুল জনগোষ্ঠীর ভারে বাংলাদেশ এমনিতেই প্রতিনিয়ত বিপদ সঙ্কুল পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে চলেছে। উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য পালিয়ে আসার পর তাদের আশ্রয় দিয়ে বড় ধরনের বিপদে রয়েছে এ দেশ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের রাতের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বর্বরোচিত কায়দায় সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের পালিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় রীতিমতো ঢল নামে। মানবতার কারণে বাংলাদেশ তাদের গ্রহণ করে আশ্রয় দিয়েছে। প্রদান করেছে খাদ্য সহায়তা। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি এ দেশের বেসরকারী পর্যায়ে সহায়তার বিষয়টি বিরল একটি ঘটনায় পরিণত হয়। এরপরে আসে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন এনজিও সংস্থা এবং শক্তিশালী দেশ ও জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থা। ইতোমধ্যে নতুন করে আশ্রিত ও পুরনো মিলিয়ে এ দেশের রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখে পৌঁছেছে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ জুড়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী এবং দাতাদের সামগ্রিক সহায়তায় রোহিঙ্গারা স্বস্তি নিয়ে বসবাস করছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, বিশ্বের বিত্তশালী দেশ এবং সাহায্য সংস্থার সহায়তা ছাড়া এককভাবে বাংলাদেশের পক্ষে এত বিপুল পরিমাণ ভিনদেশীদের দিনের পর দিন আর্থিক সহায়তার যোগান চালানো অসম্ভব একটি ব্যাপার। কিন্তু শুরুতে যেভাবে ত্রাণসহ অর্থ সহায়তা এসেছে পরবর্তীতে দিনে দিনে তা কমতে শুরু করে। বর্তমানে যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ভার্চুয়াল সম্মেলন। এ সম্মেলনের আগেই যুক্তরাষ্ট্র ২শ’ মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত মানবিক সহায়তার কথা ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের ঘোষণায় এসেছে ৪৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন পাউন্ড। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণায় ৯৬ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। সবমিলে নতুন অর্থ সহায়তার ঘোষণায় এসেছে ৬শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা জাতিসংঘের ১০০ কোটি ডলারের টার্গেটের অর্ধেকের কাছাকাছি। এতে করে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তায় বড় ধরনের ঘাটতি সৃষ্টি হবে নিঃসন্দেহে। তবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এটি একটি ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সারাবিশ্বকে সতর্ক করে দিয়েছে। তাগাদা দিয়েছে মিয়ানমারকে, যেন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। তারা যেন তাদের জন্মস্থানে এবং পছন্দের জায়গায় নিরাপদে ফিরে গিয়ে টেকসইভাবে বসবাস করতে পারে। এদিকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র মতে, রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রতিবছর যে কমে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিষয়টি আগেও বলা হয়েছিল। এক্ষেত্রে মূল সমাধান প্রত্যাবাসনে নিহিত। ইতোমধ্যে বিশ^ নেতৃবৃন্দও মনে করছেন প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিতে হবে। সূত্র মতে, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় মিয়ানমার পক্ষ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করেছে। নাটকীয়ভাবে সেনা অভিযান শুরু করে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিয়েছে। হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে নারী ও যুবতীরা। এ বিষয়টি বিশ্ব দরবারে প্রমাণিত। কিন্তু মিয়ানমার পক্ষ সম্পূর্ণভাবে বিষয়টি স্বীকার করেনি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সন্ত্রাস ও বিদ্রোহী দমনে সেনা অভিযানে কিছু রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে সামরিক আইনে কিছু সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মিয়ানমারে এমন নারকীয় অভিযান সমর্থন করে না এমন দেশ ও সংস্থাগুলো এ ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে আফ্রিকার ছোট দেশ গাম্বিয়ার পক্ষে মামলাও করা হয়েছে। আদালত রোহিঙ্গাদের রক্ষার্থে প্রাথমিকভাবে কিছু নির্দেশনা প্রদান করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মিয়ানমার বিশ্ব চাপের কাছে এবং আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশনাকে এখনও ভ্রুকুচি দেখিয়ে যাচ্ছে। আগামী মাসে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তার আগে আরাকান আর্মিসহ সন্ত্রাসী দমনের নামে রাখাইন রাজ্যে আবারও সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। উদ্বুত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত হতে অনিচ্ছুক। বিভিন্ন সূত্র মতে, মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবে সে দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছ যাতে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যেতে চাইবে না। এর সঙ্গে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা জানান দিচ্ছে যে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে এখনও পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দ্রুততম সময়ে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা না গেলে রোহিঙ্গা ইস্যুটির সার্বিক পরিস্থিতি বড় ধরনের সঙ্কটে পড়তে পারে বলে সমূহ আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। কেননা, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার যে প্রত্যাবাসন চুক্তি করেছে তার দু’বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু কোন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। পরিবেশও সৃষ্টি করা হয়নি। এর ফলে সম্পাদিত চুক্তিটি স্রেফ আইওয়াশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। চুক্তির পর দু’দফায় প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া নিয়ে রীতিমতো নাটক করা হয়। যেখানে মিয়ানমারও আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মনোভাবের কারণে দু’দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভ-ুল হয়ে যায়। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র্রের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার ‘সাসটেইন ইজ সাপোর্ট ফর দ্য রোহিঙ্গা রিফিউজি রেসপন্স’ নামে রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য দাতাদের ভার্চুয়াল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ আয়োজক হিসেবে যোগ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা সঙ্কটের মূল কারণ মোকাবেলা করা এবং তাদের মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের ব্যবস্থা সম্প্রসারণের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহায়তার প্রয়োজনীয় দিকগুলো তুলে ধরা হয়। উল্লেখ্য, ইউএনইচসিআরের নিবন্ধন অনুসারে উখিয়া টেকনাফে ৮ লাখ ৬০ হাজারের বেশি আশ্রিত রোহিঙ্গা রয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধনে রয়েছে ১১ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। ভার্চুয়াল সম্মেলনে জাতিসংঘের টার্গেট অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা পাওয়া না গেলেও রোহিঙ্গা ইস্যুর সমর্থনে পদক্ষেপ জোরালো এবং মিয়ানমারের ওপর অব্যাহত চাপ সৃষ্টির বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলম এমপি। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বিশ্ব সম্প্রদায়কে আরও চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে শুক্রবার জানানো হয়েছে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফেরত নেয়া হবে বলে চীনকে আশ্বস্ত করেছে মিয়ানমার। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনিক আলাপে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিষয়টি শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোয়াং হি বলেন, চীন রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে রোহিঙ্গাদের যাতে ফেরত নেয়া যায় সে লক্ষ্যে মিয়ানমার কাজ করবে বলে চীনকে অবহিত করেছে। চীন মিয়ানমারকে জানিয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা শুরু করবে। আগামী মাসে মিয়ানমারে নির্বাচনের পর প্রথমে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে, পরে বাংলাদেশ-চীন ও মিয়ানমারের মন্ত্রী পর্যায়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেয়া হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং চীনের ভূমিকা যথাযথভাবে যদি পালিত হয় তাহলে একটি ইতিবাচক ফল আসবে বলে স্থানীয় বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশেষ করে মিয়ানমারের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন। মিয়ানমারের অর্থনীতিতে চীনা সহায়তার অবদান ব্যাপক। ফলে বিশেষ করে চীন যদি রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে আগ্রহী হয় সেক্ষেত্রে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। এছাড়া বিভিন্ন দেশ ও দাতাদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত রাখার বিপরীতে কোন সুফল আসবে না। বরঞ্চ সহায়তার পরিমাণ দিনে দিনে কমতে থাকায় বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে বিষয়টি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছাড়াও অন্যান্য দেশসমূহের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ নিয়ে সারাবিশ্বকে যুক্তরাষ্ট্র সতর্কও করে দিয়েছে।
×