ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পতীর্থকের মুখোমুখি

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২৩ অক্টোবর ২০২০

শিল্পতীর্থকের মুখোমুখি

কারও সঙ্গে সাক্ষাত মানে সংশ্লিষ্টজনের মুখোমুখি হওয়া। এই মুখোমুখি অবস্থানে উভয় পক্ষই থাকেন অকপট, খোলামেলা-আর তিনি যদি সৃজনশীল কেউ হোন, তাহলে খোলামেলা পুরোপুরি। তিনি উদার দৃষ্টিতে মেলে ধরেন আপনাকে। সরাসরি সাক্ষাতে মানুষ নিজেকে লুকোতে পারে না-যা সত্য, যা অনিবার্য তা তাকে বলে দিতে হয়; না বলে উপায় থাকে না। এতে একটি বড় প্রাপ্তি ঘটে-তা হলো, সৃজনশীল মানুষটির ব্যক্তিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার অনেক গোপন মোহনীয় কিংবা দারুণ প্রেরণার কিছু উন্মুক্ত হয়ে পড়ে-যা তিনি লিখতে পারেননি তার গল্পে উপন্যাসে কবিতায় বা নাটকে। এক সময় চিঠিলেখার রেওয়াজ ছিল-গুণীজনের সে চিঠিই পত্রসাহিত্য হিসেবে মর্যাদা পেয়ে যেত। কিন্তু এটা তো সত্যি সেখানে আবেগের প্রাবল্য থাকত; থাকত বর্ণনার বাড়াবাড়ি, মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয়ের দরদ থাকত বেশি। দিনপঞ্জি বা ডায়েরিও তথৈবচ; এখানে বর্ণিত সব কথা সত্য নয়। এক্ষেত্রে একটি সাক্ষাতকার সম্পূর্ণ ভিন্ন দাবি নিয়ে হাজির হয় পাঠকের কাছে। বলাবাহুল্য, সাক্ষাতকার এখন একটি শক্তিশালী শিল্পমাধ্যমও। এখানে লেখক ও ব্যক্তিকে একসঙ্গে খোঁজে পাওয়া যায়। লেখক নিজেকে আড়াল করার সুযোগ পান না-ব্যক্তিকে তো নয়ই এবং কেউ কেউ সাক্ষাতকারে এতই খোলামেলা হয়ে ওঠেন-জীবনের অন্য কোন মুহূর্তে সেই সাক্ষাতকারের বর্ণনা, বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলে আঁতকে ওঠেন- বলেন, ‘তাই? আমি বলেছিলাম নাকি এ রকম কিছু?’ কাজটি করাও দুঃসাধ্য। কারণ এর জন্য কাঠখড় পোড়াতে হয় অনেক, বিশেষত সাক্ষাতকার গ্রহণকারীকে। সাক্ষাত চাইলেই যেমন সবাই সাক্ষাত দিতে এক বাক্যে রাজি হয়ে যান না; আবার সময় স্বাস্থ্য বয়স প্রেক্ষাপটও অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য প্রয়োজন হয় একনিষ্ঠতা, আর অবিচল স্থৈর্য। এটি এক ধরনের অসাধ্য সাধন- সাধনলাভের পর অবশ্য পরম তৃপ্তি। এই অসাধ্য সাধন করেছেন বিশেষ আয়োজনভিত্তিক পত্রিকা ‘পাতাদের সংসার’-এর সম্পাদক হারুন পাশা। ‘পাতাদের সংসার’-এর ২৩তম সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে অসংখ্য গুণীজনের সাক্ষাত-সন্দর্শনে। শিরোনাম করেছেন ‘শিল্পতীর্থকের মুখোমুখি।’ যথানাম বটে! এখানে গ্রন্থিত হয়েছেন লেখক, কবি, সাংবাদিক, নাট্যকর্মী, সংস্কৃতিজন, শিক্ষকসহ অনেকেই। যে কোন কর্মেরই ইতিবাচক নেতিবাচক সমালোচনা থাকে; এই সংখ্যাটিও তার উর্ধে নয়। প্রবীণ বুদ্ধিজীবী, ভাষাসৈনিক ও রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিককে দিয়ে শুরু, একেবারে নবীনতম লেখক পারমিতা হিমকে দিয়ে শেষ হয়েছে। মোট আটাশজনের সাক্ষাতকার রয়েছে। গ্রন্থিত গুণীজনের মাঝে কেউ কেউ পৃথিবীতে এখন আর নেই; তাদের কথাগুলো কালের অক্ষরে অমর হয়ে আছে পাতাদের সংসারে। কিছু কথাÑমানে কয়েকজন গুণীর কথা এখানে স্মরণ করতে পারি : ‘আহমদ রফিক তাঁর কবিতা লেখার বিষয়ে বলেছেন : ‘কবিতা লেখার পেছনে কোন হঠাৎ কারণ বা গল্প নেই। নদীমাতৃক গ্রাম-বাংলার প্রাকৃত সৌন্দর্যে মুগ্ধ বাঙালী কিশোর-তরুণ রোমান্টিক আবেগে কবিতা লেখার মক্শো করে, কেউ এ পথে নিয়মিত হাঁটে, কেউ মাঝে মধ্যে, আবার কেউ অন্য পথ ধরে সমাজ-রাজনীতির বাস্তবতার টানে। আমার অবস্থা তেমনই।’ ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বইয়ে তো ধরে ধরে, বলতে গেলে হাতে-কলমে শিখিয়েছেন কবিতা কী? গল্প কী?, সৈয়দ হক এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন : ‘আমি লেখক হিসেবে কাজ করতে করতে যেগুলো জিনিস দেখেছি, কিছু কিছু জিনিস, সেগুলোই লেখার চেষ্টা করেছি, যাতে আমার পরবর্তীতে যারা আছে তাদের জন্য সময় সাশ্রয়ী হয়।’ ‘দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কি আপনাকে এখনও ব্যথাহত করে? -এই প্রশ্নের উত্তরে ড. আনিসুজ্জামান বলেন : দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিশ্চয় আমার মনে জাগে, ব্যথাহত করে কিনা বলা মুশকিল; কেননা দুটোর মধ্যেই ব্যথাহত করার মতো উপাদান আছে, আবার আশাভঙ্গের অনেক উপাদান আছে। সুতরাং কেবল ব্যথাহত করে না।’ যতীন সরকার এক প্রশ্নের উত্তরে অত্যন্ত খোলামেলাভাবে বলেন : ‘আমি বলি প্রতিভা ছাড়া প্রবন্ধের মধ্যে যাওয়া যায় এ অর্থে, প্রাইমারি স্কুল থেকেই প্রবন্ধ লিখে পরীক্ষায় পাস করেছি। কাজেই এ ধরনের প্রবন্ধই আমি লিখি। আমার মনে হয় না খুব বেশি সাহিত্যিক মূল্য আমার প্রবন্ধে আছে। আমি আসলে লেখক না। কষ্ট লেখক। কষ্ট করে লেখালেখি করি।’ কবি শেলী নাজ এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন : ‘আমি বরাবর বলি মনুষ্যজীবী হিসেবে পুরুষের যেসব চাহিদা আছে, নারীরও সেসব চাহিদা আছে। অনুভূতি আছে। নারীরা প্রকাশ করতে পারে না। এ নিয়ে লিখে না। কারণ সমাজে তাকে অন্যভাবে ট্রিট করা হয়।... কিন্তু তারও সমান যৌন চাহিদা আছে।’ এই বিশেষ সংখ্যায় মুদ্রিত লেখক কবি বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য যে কোন সময়ের দলিল হয়ে থাকবে। এটা নিঃসংশয়ে বলা যায়-এ ধরনের একটি সংখ্যা সংগ্রহের আগ্রহ শিল্পরুচিঋদ্ধ সৃজনশীল মানুষের ভেতরে তৈরি হবে এবং তৈরি হওয়া উচিতও মনে করি। আগামী সময়ের বিস্তৃত আঙিনায় এই সাক্ষাতকার সংখ্যা একটি সহায়ক গ্রন্থ হয়ে উঠবে অনেকের জন্যই।
×