ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অরূপ তালুকদার

যেমন ছিলেন রশীদ হায়দার

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ২৩ অক্টোবর ২০২০

যেমন ছিলেন রশীদ হায়দার

চলে গেলেন প্রিয় মানুষ রশীদ হায়দার। অনেকদিন ধরেই নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছিলেন। এবারে সবকিছু ছেড়ে চলে গেলেন। কিছুদিন আগে ঠিক এমনিভাবেই পার্থিব জগতের মায়া ত্যাগ করে হঠাৎ করে চলে গিয়েছেন আমাদের অতি শ্রদ্ধেয় দুজন মানুষ কামাল লোহানী এবং আনিসুজ্জামান। তাদের জন্য যে শ্রদ্ধার আসন ছিল আমাদের সবার মনের ভেতরে, মনে হয় না, সে আসন আর কোনদিন পূর্ণ হবে। করোনাকালে সবকিছুই অন্যরকম মনে হয়, যাকে আমরা বলছি নিউ নর্মাল। এই সময় কেমন করে ঘরবন্দী জীবন কাটছে, সেটা বেশি বয়সী মানুষ যারা তারা ঠিক টের পেয়ে যাচ্ছেন। রশীদ হায়দার আমার চাইতে বয়সে বছর তিনেকের বড় ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, তার জন্মদিন ছিল ১৫ জুলাই, আমার ১৭। কিন্তু সেটা তিনি মানতে চাইতেন না। হেসে বলতেন, এটা এমন কিছু না।’ দীর্ঘদিন আগে থেকে আলাপ পরিচয়ও যখন জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন থেকে। তারপর কখনও ঢাকা, কখনও বরিশাল, এভাবে কেটেছে বছরের পর বছর। কিন্তু আমাদের মধ্যের যোগাযোগ কখনো একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়নি। মাঝেমধ্যে সামনাসামনি, কখনো বা ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগটা বহাল ছিল। তবে লম্বা বিরতি গেছে অসুস্থ হওয়ার পর, অনেক সময় কথা বলতে পারতেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, ইত্তেফাকে কাজ শুরু করার আগে, বেশ কিছুদিন বরিশালে থাকতে হয়েছিল ও সেই সময়ে হঠাৎ একদিন রশিদ ভাইয়ের ফোন, স্মৃতি: ৭১ -এর জন্য লেখা চাই।’ বাংলা একাডেমি থেকে তখন তার সম্পাদনায় খ-ে খ-ে প্রকাশিত হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষদের স্মৃতিচারণমূলক রচনা স্মৃতি : ৭১ শীর্ষক সিরিজ গ্রন্থমালা। আমি তখন বরিশালের কৃতী সন্তান কবি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের জীবনভিত্তিক একটি লেখা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম রশিদ ভাইয়ের কাছে। পরবর্তীকালে সে লেখাটি স্মৃতি: ৭১-এর একটি খ-ে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে রশিদ ভাইকে একটি কারণে সবচাইতে বেশি করে মনে পড়ে আমার ও কারণ সেই ঘটনাটি ছিল অন্যরকম একটি ঘটনা। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের অযোধ্যায় ঘটেছিল চাঞ্চল্যকর বাবরী মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ও তার ফলশ্রুতিতে দুই দেশেই দেখা দিয়েছিল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, ঘটেছিল বেশকিছু গোলযোগের ঘটনাও। এরকম সময়ে হঠাৎ একদিন সকালবেলা রশিদ ভাইয়ের ফোন পেলাম। কণ্ঠস্বরে বেশ উৎকণ্ঠা, অরূপ, আপনি এখন কোথায়? কেমন আছেন আপনারা? বললাম, এক রকম আছি, ভাল না খারাপ বুঝতে পারছি না ও এখন বরিশালে আছি ও কয়েক দিন পরে ঢাকায় আসব ভাবছি। বললেন, বাবরী মসজিদ ভাঙার পরের ঘটনাগুলো জানেন তো! ঢাকায় তো কিছু গোলযোগ হচ্ছে, মিছিল টিছিল নেমেছে, নবাবপুর আর পুরনো ঢাকায় কিছু দোকানপাটে ভাঙচুর লুটপাট হয়েছে ও আপনাদের ওদিকের খবর কি? বললাম, আমাদের এদিকে এখন পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি, তবে কোথাও কোথাও এসব নিয়ে বেশ গরম আলোচনা চলছে যাই হোক, সাবধানে থাকবেন, গলায় সেই উৎকণ্ঠা, বললেন, খোঁজ খবর নিয়ে অবস্থা বুঝে সময় থাকতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এই ছিলেন রশিদ ভাই। সবার থেকে আলাদা। তার মতো প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা, নরম মনের অসাম্প্রদায়িক ভাল মানুষ আমার জীবনে আর দেখিনি। ওই সময়ে ঢাকা থেকে যতটা উৎকণ্ঠা নিয়ে তিনি আমাকে ফোন করে আমার এবং আমার পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছিলেন তেমন আর একটি মানুষের কথাও আমার মনে পড়ে না। লেখার বিশাল সাহিত্য ভা-ার বলতে যা বুঝায় তেমন কিছু ছিল না রশিদ ভাইয়ের, তবে যা-ই তিনি লিখেছেন তার সব কিছুতেই তিনি যা বিশ্বাস করতেন, যা ভাল বলে মনে করতেন, জানতেন বা মানতেন তার ছাপ ছিল পরিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস এ কোন অরণ্য ও নষ্ট জ্যোৎস্না, নানকুর বোধি, কিশোরদের জন্য শোভনের স্বাধীনতা, যুদ্ধ ও জীবন, জীবনীগ্রন্থ শেখ ফজিলাতুন্নেছা, নাটক তৈল সঙ্কটসহ আরও বেশ কিছু গবেষণাগ্রন্থ আছে রশিদ হায়দ্রারের, কিন্তু এসবের খবর তেমন করে কে আর রেখেছে এতদিন! সবকিছুই তো একদিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। তবে একটু হলেও সান্ত¡না আছে, লেখার জন্য একসময় পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং পরে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক। একশতভাগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ ছিলেন রশিদ ভাই। তাই তার বিভিন্ন লেখায় বার বার উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা, যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদেরকে নিশ্চিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ করবে। হায়দার পরিবারের অনেকের সঙ্গেই আমার আলাপ পরিচয় ছিল, এখনও কিছু কিছু আছে। সবার বড় জিয়াভাইকেও আমি চিনতাম। তারপরেই রশিদ ভাই। তারপরে দাউদ, সে তো ছিল আমার একেবারে তুই তোকারির বন্ধু। এরপরে মাকিদ আর জাহিদ, এই দুজনও পরিচিত। এখনো মাকিদের সঙ্গে কখনও দেখা হলে গল্পগুজব হাসি ঠাট্টায় চমৎকার সময় কাটে। জানি না, এভাবে আর কতদিন চলবে। কেননা, যত দিন যাচ্ছে ততই যেন মনে হচ্ছে, আমাদের সময়ের পরিচিত মানুষ আর আপনজনরা কেন যেন আর সময় দিতে চাইছেন না। কেমন করে যেন ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছেন।
×