ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, জিয়া তা বন্ধ করেছেন

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২৩ অক্টোবর ২০২০

বঙ্গবন্ধু ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, জিয়া তা বন্ধ করেছেন

ফিরোজ মান্না ॥ নূরুজ্জামান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম। ১৯৭১ সালের রণক্ষেত্রে বীর দর্পে পাকিদের একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করেছেন। সংসার যুদ্ধে বার বার তিনি পরাজিত সৈনিক। বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস ছাড়া তার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নিঃস্ব অসহায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা নানা রোগ শোকে বিছানায় পড়ে আছেন। তার চিকিৎসা নেয়ার মতো কোন অবস্থা নেই, যা কিছু সম্পদ ছিল তা বিক্রি করে চিকিৎসা নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে তার সহযোগিতার জন্য ৫শ’ টাকা ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্ত সেই ভাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দেয়। বঙ্গবন্ধু ’৭৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর যুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ অবদানের তাকে এই ভাতা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সই করা ভাতার ওই চিঠি ও চেক বই বুকে আগলে ধরে রেখেছেন নূরুজ্জামান। এটাই তার শেষ সম্বল বলে বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানালেন। রোগ শোকে বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুজ্জামান ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। কথা মুখে জড়িয়ে যায়। তার স্ত্রী গুলশান আরা খানম জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীর খিলগাঁও গোড়ানে ৪৫৫/এ বাসায় তারা ভাড়া থাকেন। দুই মেয়ে আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তাদের। ১১ হাজার টাকা বাসা ভাড়া যোগার করা তাদের জন্য খুবই কঠিন। বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস বদরুনেচ্ছা কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেছে। তাকে বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের আগে জান্নাতুল ফেরদৌস চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, কিন্তু কোন সংস্থাই তাকে চাকরি দেয়নি। ছোট মেয়ে রুমানা ফেরদৌস ইডেন কলেজে মাস্টার্সে পড়ছেন। তাদের ভরণপোষণ ও লেখা পড়ার খরচ যোগার করা একা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুজ্জামানের কিডনি, লিভার, হার্ট, উচ্চ ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। এতদিন নিজ বাড়ি কুষ্টিয়ার মীরপুর থানার আমলা সদরপুরে যতটুকু জমি ছিল তা বিক্রি করে তার চিকিৎসা করেছি। এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আত্মীয়-স্বজনরাও আগের মতো সাহায্য সহযোগিতা করছেন না। এখন তারাও বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। তাদেরও তো সংসার আছে। কতই বা করতে পারে আত্মীয় স্বজনরা। এত অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা কি আর মানুষের সাহায্যে হয়? এমন প্রশ্ন রেখে তিনি কেঁদে ফেলেন। মেয়েরা নির্বাক। অপলক দৃষ্টিতে মায়ের কান্না দেখছেন। তাদের কিই বা করার আছে। বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস বহু জায়গায় চাকরির আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এখন আর ক্ষোভে দুঃখে কোথায় চাকরির আবেদনও করেন না। যেখানেই তিনি চাকরির আবেদন করে পরীক্ষা দিয়েছেন সেখানেই লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্ত মৌখিক পরীক্ষায় টাকা না দেয়ার কারণে তার চাকরি হয়নি। চাকরি হয়েছে রাজাকার আলবদর আলসামসের সন্তানদের। চোখের সামনে তিনি এ দৃশ্য দেখেছেন। আর মনে মনে ভেবেছেন বাবা কি দেশ স্বাধীন করেছিলেন রাজাকার আলবদরদের সন্তানদের চাকরির জন্য। নিশ্চয়ই তা করেননি। তিনি দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির জন্য। জান্নাতুল ফেরদৌস জনকণ্ঠকে বলেন, রাজাকারের সন্তানদের যখন চাকরি হয়-তখন বাবার মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো সামনে চলে আসে। বাবা এক যুদ্ধে পাকিদের বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হন। সেই সময় ডাঃ মোহাম্মদ আলী হুসাইন তার চিকিৎসা করেছেন। কুষ্টিয়ার মজমপুর দার-উস শেফা প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ নবেম্বর ছাড়া পাওয়ার পর আবার তিনি দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ডাঃ মোহাম্মদ আলী হুসাইন ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তার ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ফিল্ড হাসপাতালের চীফ মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তার মেডিক্যাল সার্টিফিকেটে উল্লেখ করেছেন, ‘একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুজ্জামান। চিকিৎসা শেষেই আবার তিনি দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার দেশপ্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি তার সর্বপ্রকার মঙ্গল কামনা করি।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুজ্জামানের অবদানের কথা বঙ্গবন্ধু জানার পর তাকে একটি চিঠি লেখেন। বঙ্গবন্ধুর ওই চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো। ‘প্রিয় বোন/ভাই, আপনি দেশপ্রেমের সুমহান আদর্শ ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ-মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে পাক-হানাদার দস্যুবাহিনীর হাতে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। এই দুঃসাহসিক ঝুঁকি নেয়ার জন্য আপনাকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আপনার মতো নিঃস্বার্থ দেশ-প্রেমিক বীর সন্তানরাই উত্তরকালে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের এক অত্যুজ্জ্বল আদর্শ হিসেবে প্রেরণা যোগাবে।
×