ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ কায়সারের মৃত্যু পরোয়ানা জারি, পড়ে শোনানো হয়েছে

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ২৩ অক্টোবর ২০২০

সৈয়দ কায়সারের মৃত্যু পরোয়ানা জারি, পড়ে শোনানো হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিগঞ্জে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সাবেক কৃষিপ্রতিমন্ত্রী ও কায়সার বাহিনীর প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুপরোয়ানা জারি করা হয়েছে। মৃত্যুপরোয়া কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে পড়ে শোনানো হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, আপীলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করবেন। কাদের মোল্লার মামলার রায় অনুসারে, রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করার সুযোগ পাবেন আসামি পক্ষ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে নিষ্পত্তি হওয়া এটি নবম মামলা। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউয়ের আবেদন করে সাজা কমানোর নজিরবিহীন। এর আগে ফাঁসি কার্যকর হওয়া সব যুদ্ধাপরাধী রিভিউ আবেদন করেও সর্বোচ্চ সাজার রায় বদলাতে পারেনি। রিভিউ আবেদন খারিজ হলেও অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন সৈয়দ কায়সার। তিনি যদি প্রাণভিক্ষা না চান এবং চেয়েও যদি ক্ষমা না পান, তাহলে রায় কার্যকরের ক্ষণগণনা শুরু হবে। রায় কার্যকরের আগে তিনি শেষবারের মতো পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন। কায়সারের আইনজীবী তানভীর আহমেদ আলামিন সাংবাদিকদের বলেছেন, রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি পেলে তারা রিভিউ আবেদন করবেন। রিভিউ পিটিশন করার জন্য আমার মাক্কেল আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার জন্য দরখাস্ত করা আছে। হয়ত কয়েকদিনের মধ্যেই পেয়ে যাব। এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্র্রার অমিত কুমার দে জনকণ্ঠকে বলেন, বুধবার বিকেলে সুপ্রীমকোর্ট থেকে পাঠানো রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি তারা হাতে পান। বৃহস্পতিবার সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুপরোয়ানা কারা কর্তৃপক্ষ, ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠানো হয়েছে। লাল সালু কাপড়ে মোড়ানো সেই মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পৌঁছানোর পর তা কায়সারকে পড়ে শোনানো হয়েছে। কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সুভাস কুমার ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, কারাগারে মৃত্যুপরোয়ানা কায়সারকে পড়ে শোনানো হয়েছে। এ সময় তিনি আমাদেরকে জানিয়েছেন,আপীল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করবেন। উল্লেখ্য, বুধবার আপীল বিভাগের দেয়া ২৬২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি এ্যাডভোকেট অন রেকর্ড গ্রহণ করেন। পরে সুপ্রীমকোর্ট থেকে রায়ের কপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যায়। ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি হবিগঞ্জে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সাবেক কৃষিপ্রতিমন্ত্রী ও কায়সার বাহিনীর প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদ-ের আদেশ বহাল রাখে আপীল বিভাগ। ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের অভিযোগে দেয়া মৃত্যুদণ্ড আপীল বিভাগে সর্বসম্মতভাবে বহাল রাখা হয়। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে ধর্ষণে সহযোগিতায় মৃত্যুদ- সাজার এটাই প্রথম নজির। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্য বিশিষ্ট আপীল বেঞ্চ ওই দিন এ রায় ঘোষণা করেন। এই আপীল বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা এবং বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান। রায় ঘোষণার পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ে আমাদের দেশে ধর্ষণে সহযোগিতা করার দায়ে প্রথম কোন আসামিকে মৃত্যুদ- দেয়া হলো। ওই অভিযোগের যে ভিকটিম, সে নিজে কোর্টে এসে সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তার মেয়েও আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছে দুর্দশার কথা। এই ১২ নম্বর অভিযোগটিতে চার বিচারপতিই একমত হয়ে মৃত্যুদ- বহাল রেখেছেন। আর ৫ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মৃত্যুদ- দিয়েছেন। ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, মুক্তিপণ আদায়, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন এবং ষড়যন্ত্রের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ট্রাইব্যুনাল কায়সারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, মুক্তিপণ আদায়, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন এবং ষড়যন্ত্রের ১৪টি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি অভিযোগে ফাঁসি, ৪টিতে আমৃত্যু কারাদ- , ৩টিতে ২২ বছরের কারাদ- ও দুটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আপীল করা হয়। সৈয়দ কায়সারের পক্ষে এ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন আপীলটি করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর থেকে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার কেন্দ্রীয় কারাগারে কনডেম সেলে রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, বুলেটের আঘাতের চেয়েও ধর্ষণের আঘাত অনেক যন্ত্রণাদায়ক, ভয়ঙ্কর। একাত্তর সালে শত্রুর গুলিতে যারা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন তাদের থেকেও যন্ত্রণাদায়ক হলো যারা একাত্তর সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের যন্ত্রণা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। সামাজিকভাবেও এ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। একাত্তরে যুদ্ধ শিশু, ধর্ষিত নারী ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের তালিকা করে পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যে যুদ্ধ শিশু জন্ম থেকে সামাজিক নিগ্রহ ধিক্কারের বা গঞ্জনা নিয়ে বড় হচ্ছে তারা সবাই সাহসী নারী। তাদের আমরা স্যালুট জানাই। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে অভিযোগ ৩,৫,৬,৮,১০,১২ ও ১৬ এই ৭টি অভিযোগে ফাঁসি, অভিযোগ ১,৯,১৩,১৪ এই ৪টিতে আমৃত্যু কারাদ- ,অভিযোগ ২ এ ১০ বছর ,অভিযোগ ৭ এ ৭ বছর ও অভিযোগ ১১ তে ৫ বছর করে মোট ২২ বছরের কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। অভিযোগ ৪ ও ১৫ প্রমাণিত না হওয়াতে আসামিকে অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। অভিযোগ-১১ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে আরও বলেছে, যে যুদ্ধশিশু জন্ম থেকে সামাজিক নিগ্রহ ধিক্কারের বা গঞ্জনা বঞ্চনা নিয়ে বড় হচ্ছে তারা সবাই সাহসী নারী। তাদেরকে আমরা স্যালুট জানাই। বুলেটের আঘাতের চেয়েও ধর্ষণের আঘাত অনেক যন্ত্রণাদায়ক, ভয়ঙ্কর । একাত্তর সালে শত্রু গুলিতে যারা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন তাদের থেকেও যন্ত্রণাদায়ক হলো যারা একাত্তর সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের যন্ত্রণা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। সামাজিকভাবেও এ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
×