ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্জয় সরকার

হাওড়ের বিস্ময় ‘অলওয়েদার সড়ক’

প্রকাশিত: ২১:০২, ২৩ অক্টোবর ২০২০

হাওড়ের বিস্ময় ‘অলওয়েদার সড়ক’

‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও- এইডাই হাওরের বাও।’ হাওড়ের বাসিন্দা হওয়ায় শৈশবকাল থেকে আমি এ প্রবাদটির সঙ্গে পরিচিত। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি- হাওড়ের দিগন্তবিস্তৃত বিশাল জলরাশি ভেদ করে একদিন পিচঢালা উঁচু সড়ক নির্মিত হবে। আর গহীন হাওড়ের নির্জনতা ভেঙ্গে সেখানে দিনরাত হন হন করে ছুটে চলবে অত্যাধুনিক যন্ত্রযান। যাতায়াত ব্যবস্থা বলতে তখন আমরা কেবল নৌপথের ওপরই নির্ভরশীল ছিলাম। চিরায়ত সে ব্যবস্থায় কিছুটা গতি এনে দিয়েছিল স্যালু ইঞ্জিন। আশির দশকে স্যালু ইঞ্জিনের বদৌলতে হাওড়ে ইঞ্জিন নৌকার প্রচলন শুরু হয়। এ ইঞ্জিন নৌকা তখন হাওড় জীবনের গতি অনেকটা পাল্টে দেয়। কিন্তু আমরা জানতাম না- আরও কত বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য! প্রায় দুই যুগ আগে হাওড়াঞ্চলের কাঠের খুঁটি দিয়ে যখন পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন স্থাপন করা হয়- তখন সেটিও আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। অথৈ জলরাশির ওপর দিয়ে একদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন স্থাপিত হবে, আর কেরোসিনের কুপিবাতিকে জাদুঘরে পাঠিয়ে গহীন রাতে হাওড়ের দ্বীপসদৃশ গ্রামগুলোতে জ্বলজ্বল করবে বৈদ্যুতিক বাতি- এটিও আমরা ভাবিনি কোনদিন। বলাবাহুল্য, হাওড়ের বেশিরভাগ উপজেলাই এখন শতভাগ বিদ্যুতের আওতায়। বিদ্যুত সুবিধার কারণে হাওড়ের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। একই সময়ে হাওড়াঞ্চলে আরও কিছুটা উন্নয়নের ছোঁয়া এনে দেয় সাব-মার্জিবল সড়ক। অপেক্ষাকৃত টেকসই ও হাওড়বান্ধব প্রযুক্তির এ সড়ক বর্ষা মৌসুমে পানির নিচে থাকে। আর শুকনো মৌসুমে জেগে ওঠে। তখন এর ওপর দিয়ে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলে। হাওড়ের গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের বহু সড়ক নির্মিত হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক সহজতর হয়েছে। এবার বৃহৎ হাওড়বাসীর সমস্ত কল্পনাকে ছাড়িয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে ‘অলওয়েদার সড়ক’। কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলায় নির্মিত এ সড়ক শুধু শুকনো মৌসুমে নয়, ব্যবহার করা যাবে সারাবছর। অর্থাৎ বছরের ছয় ঋতুতেই হাওড়ের বুকে গাড়ি চলবে। বর্ষায় পানিতে ডুববে না বলে হাওড়ের বাসিন্দারা এটিকে বলছেন- ‘আবুরা সড়ক’। আমরা জানি, উল্লিখিত ওই তিনটি উপজেলা মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদের নির্বাচনী এলাকা হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের আগে পর্যন্ত তিনি এ এলাকা থেকে বারবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। শুধু রাষ্ট্রপতি বা জনপ্রতিনিধি হিসেবেই নন, হাওড়ের সন্তান হিসেবে এ এলাকার বাসিন্দাদের দুঃখ-দুর্দশা, প্রকৃতির সঙ্গে বেঁচে থাকার লড়াই- সবকিছু সম্পর্কে তিনি অবগত। আর সে কারণেই হাওড়বাসীর দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের এ টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। এখানে বলে রাখা দরকার, হাওড়াঞ্চলে ইতিপূর্বে সাব-মার্জিবল সড়ক নির্মাণের প্রক্রিয়াটিও তিনিই শুরু করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৮ অক্টোবর সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘হাওড়ের বিস্ময়’ খ্যাত অল ওয়েদার সড়কের উদ্বোধন করেন। এ সময় সড়কের সুবিধাভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এটিকে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা তাঁর অনুপ্রেরণা ও উদ্যোগের কারণে রাস্তাটি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি।’ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর এ উপহারে হাওড়ের বাসিন্দারা কতটুকু আনন্দে উদ্বেলিত- সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ এ মহাসড়কের বদৌলতে ওই তিন উপজেলা ও আশপাশের অনুন্নত হাওড় এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন সাধনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজে বাজারজাত করতে পারছেন। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। পাশাপাশি হাওড়াঞ্চলে পর্যটন শিল্প বিকাশের এক অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। হাওড়ের সুবিশাল জলরাশি ভেদ করে কখনও সরল আবার কখনও বক্র রেখার মতো এগিয়ে চলা দৃষ্টিনন্দন সড়কটি দেখার জন্য এরই মধ্যে দূর-দূরান্তের পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে কিছুদিনেই এলাকাটি বিশাল ও আকর্ষণীয় এক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। পত্রিকার খবরে জেনেছি, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) ৮৭৪ দশমিক ০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগাম সড়কটি নির্মাণ করে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। আরও অবাক করা তথ্য হচ্ছে- হাওড় এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, দুর্গম পথে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন করে বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে এমন একটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ছিল বড় একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দেশী-বিদেশী কোন পরামর্শকের পরামর্শ-সহায়তা ছাড়াই সব বাধা অতিক্রম করে প্রকল্পটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে শেষ করতে পেরেছেন সংশ্লিষ্টজনরা। কাজেই এ মাইলফলক অর্জনে প্রকল্পটির উদ্যোক্তা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, প্রকল্পটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও নির্মাণকর্মীরা ব্যাপকভাবে নন্দিত হয়েছেন। প্রত্যন্ত হাওড়ের বাসিন্দারা তাদের অবদানের কথা সুদীর্ঘকাল মনে রাখবেন। বহু কাক্সিক্ষত এ সড়কটি নির্মিত হওয়ায় একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করে মিঠামইন উপজেলার সঙ্গে করিমগঞ্জ উপজেলা এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলাকে যুক্ত করে সিলেট ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আশাবাদী- অদূর ভবিষ্যতে হাওড়বাসীর সে স্বপ্নও বাস্তবায়িত হবে। পাশাপাশি এও জেনেছি, বৃহত্তর সিলেটের হাওড়াঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও সহজীকরণ করতে সুনামগঞ্জের সঙ্গে নেত্রকোনার সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের বিশাল পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান ইতোমধ্যে গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ সড়কে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ নয় কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ফ্লাইওভার থাকবে- যা প্রধানমন্ত্রীর নামে ‘শেখ হাসিনা ফ্লাইওভার হাইওয়ে’ নামে প্রস্তাব করা হচ্ছে। এছাড়াও উন্নত বিশে^র আদলে প্রস্তাবিত এ সড়কটি হবে দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ও মনোরম সড়ক। আমরা মনে করি, হাওড় এলাকার উন্নয়নে এটিও হবে আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কারণ এ সড়কটি নির্মিত হলে সুনামগঞ্জসহ বৃহত্তর সিলেটের যাত্রীরা অনেক কম সময়ে সড়কপথে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করতে পারবেন। একই সঙ্গে নেত্রকোনার মদন উপজেলার উচিতপুর থেকে হাওড়দ্বীপ খ্যাত খালিয়াজুরী উপজেলা হয়ে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্যামারচর বাজার পর্যন্ত আরেকটি অল ওয়েদার সড়ক নির্মাণ করা যেতে পারে। নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের কয়েকটি উপজেলার যাতায়াত ব্যবস্থাকে সহজ করতে এটিও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। এ সড়কগুলো শুধু হাওড়াঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থাকেই সহজ করবে না, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও পাল্টে দেবে। অন্যদিকে অপার সৌন্দর্যের হাওড় হয়ে উঠবে দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। আমরা জানি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে হাওড় উন্নয়ন বোর্ড গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর এ নির্দেশে হাওড়বাসী তখন ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘৃণ্য ঘাতকদের নির্মম বুলেটে জাতির পিতার শাহাদাত বরণের পর গোটা দেশবাসীর সঙ্গে হাওড়বাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লালিত স্বপ্নও বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর সুদীর্ঘকাল কেটে গেলেও হাওড় এলাকা বলতে গেলে অবহেলিতই থেকে যায়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাওড় উন্নয়নে বেশকিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার হাওড় উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করায় হাওড়বাসীর সামগ্রিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। আমরা আশা রাখি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনারবাংলা বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৃদৃষ্টি হাওড়বাসীর প্রতি আরও প্রসারিত হবে। অব্যাহত থাকবে হাওড় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা। তাঁর নেতৃত্বে হাওড়বাসী অচিরেই তাদের স্বপ্নের দিনগুলোয় ফিরে যাবে। অবসান হবে উন্নয়ন-বঞ্চনার। ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও’- এ জাতীয় প্রবাদগুলো চিরদিনের জন্য ভুলে যাব আমরা। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×