ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

শারদীয় দুর্গোৎসব হোক সর্বজনীন

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ২৩ অক্টোবর ২০২০

শারদীয় দুর্গোৎসব হোক সর্বজনীন

প্রতি বছরের মতো এবারও দুর্গোৎসবকে ঘিরে দেশব্যাপী আনন্দ-উৎসবের ফল্গুধারা থাকলেও দেশব্যাপী করোনায় (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছে দেশের অনেক মানুষ এবং এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে ৫ হাজার ৫ শ’র বেশি। তারপরও জীবন তো আর থেমে নেই। থেমে থাকবেও না। শরতের শুভ্র আকাশ, কাশফুলে হাওয়ার নাচন আর আগমনী ঢাক-শাঁখের আওয়াজ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গ্রাম-নগরে ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবাই মিলিত হন শরতের মিলনোৎসবে। এবারের দুর্গাপূজা পড়েছে কার্তিকে, যা মলমাস নামে পরিচিত। নোভেল করোনার কারণে অনেক সাদাসিধেভাবে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। থাকবে না কোন মেলা কিংবা শোভাযাত্রা। যার ফলে সাশ্রয়ী অর্থ মানবতার সেবায় গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হবে বলে সর্বজনীন পূজা উদ্যাপন কমিটি জানিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে এটি হিন্দু ধর্মের প্রধান অনুষ্ঠান উৎসব হিসেবে বিবেচিত। শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালী সনাতন হিন্দু ধর্র্মাবলম্বীদের সবচাইতে বড় উৎসব হলেও এখন সেটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। কথায় বলে ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এই ধারণায় বাংলাদেশের সকল বাঙালী ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে এর আমেজ আনন্দ উপভোগ করে আসছে কালান্তরে। ওপার বাংলার বারো ইয়ার মানে বারোজন বন্ধুর অপার উৎসাহে যে পূজার শুরু তার নামেই চালু হয়ে গেল বারোয়াড়ি তথা সর্বজনীন শারদ উৎসব। বাংলাদেশ ও উভয় বাংলার সীমানা পেরিয়ে এই উৎসব এখন এমন এক রূপ ধারণ করেছে, যার সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে না। সমগ্র আয়োজনের পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে খ্যাত। পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন দেবীপক্ষের সূচনা হয়; দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। এই পূজা দশদিনের পর্বÑযা শুরু হয় শুভ মহালয়া দিয়ে, যা এই বছর পড়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২ আশ্বিন ১৪২৭ বৃহস্পতিবার আমবস্যা রাত ১২/৫৩/১৪ সে: পর্যন্ত। সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের জল ও খাদ্য দিয়ে তর্পণ করে এবং এই দিনে দুর্গাদেবী তারা স্বামীর বাড়ি কৈলাস থেকে মর্তে রওনা হন। মহালয়ার দিন অতি প্রত্যুষে চ-ীপাঠ করার রীতি রয়েছে। মহাদেবীর আবির্ভাব ঘটে মহালয়ার পবিত্র মুহূর্তে। দুর্গাপূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো মহাযষ্ঠী ০৬ কার্তিক ১৪২৭, ২২ অক্টোবর ২০২০ বৃহস্পতিবার দুপুর ০২/৫৪ পর্যন্ত, যেদিন ভক্ত পূজারীবৃন্দ দেবীকে সংবর্ধনা জানায়, যার মধ্য দিয়ে শারদীয় উৎসবের শুভ উদ্বোধন হয়। তার পর পর্যায়ক্রমে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী; যার মাধ্যমে দেবীকে বিদায় জানানো হয় তার স্বামীসহ সকলকে নিয়ে শ্বশুরালয় কৈলাসে গমন। দেবীপক্ষের সমাপ্তি হয় পঞ্চদশ দিনে অর্থাৎ, পূর্ণিমায়। এই পঞ্চদশ দিনটিতে বার্ষিক লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বজনীন এই দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও বাস্তবে মহালয়া থেকে উৎসবের সূচনা এবং লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। দুর্গাপূজায় দুর্গার সঙ্গে বাহনে থাকেন তার সন্তানগণ যেমন-লক্ষ্মী (ধন সম্পদের প্রতীক), সরস্বতী (জ্ঞানের প্রতীক), গণেশ (শুভ সূচনার প্রতীক) এবং কার্তিক (যুদ্ধ বিদ্যার প্রতীক)। এটা ধরে নেয়া হয় যে দুর্গাদেবী তার সন্তানদের নিয়ে কৈলাস থেকে মর্ত্যে আসেন, আবার দশদিন শেষে নিজের ঘরে ফিরে যান। দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে বোধন (welcome the goddess), অধিবাস (symbolic offerings to Durga), নবপঞ্জিকা স্থান (bathing with holy water), সন্ধি পূজা ও অষ্টমী পূজা (celebrate with puspanjhali),ওঁম ও ভোগ (fire oblation) কুমারী পূজা, সিঁদুর খেলা ও ইমারশান (দশম দিনে বিজয়া দশমীতে মহিলাদের দুর্গার কপালে সিঁদুর পরানো, নিজেদের মধ্যে সিঁদুর পরানো ও বিদায়) ও ধুনচি নাচ ইত্যাদি। দেবী দুর্গা বিভিন্নরূপে এ মর্তের পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে থাকেন এবং আমাদের সার্বিক মঙ্গল নিশ্চিত করেন বিধায় তিনি সর্বমঙ্গলা। মায়ের দুইরূপ-একটি ভয়ঙ্করী অপরটি ক্ষমেংকরী। আবার শিবের শক্তি বলেও তিনি শিবা। তিনি সব প্রার্থনা এবং আরাধনা মঞ্জুর করেন এবং অসাধ্যকে সাধন করেন। তাই তিনি শরণ্য, তিনি গৌরী। দুর্গা দশভুজ নামেও পূজিত এবং আরাধিত হয়ে থাকেন। নিয়ম আছে নদীরপাড় এবং পতিতালয়ের দরজা থেকে মাটি সংগ্রহ করে প্রতিমা তৈরি করা, যার সঙ্গে খড় পাটসহ আরও নানা উপকরণ মিশিয়ে কাঠামোটিকে শক্তিশালী করা হয়। এই প্রতিমা তৈরির কাজটি করে একটি দল, যাদেরকে বলা হয় থাকে কুমার, তারাই বিশেষভাবে পারদর্শী। যদিও বর্তমান সময় আর্ট কলেজ /ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা অনেক আর্টিস্ট প্রতিমা তৈরিতে আগ্রহী হচ্ছেন, যেখানে ধর্ম কোন বিষয় নয়। দুর্গাপূজা প্রথমে রাজাদের অনুদানে শুরু হয়েছিল। যেমন-ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা দুর্গাবাড়ি মন্দিরে রাজা রাধা কিশোর মাণিক্য বাহাদুর কর্তৃক প্রথম শুরু হয়েছিল দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল নিয়মসিদ্ধ (complicated rituals) একটি ধর্মীয় কার্যক্রম, যা সম্পদশালী ধনী ব্যক্তিদের দ্বারাই আয়োজন সম্ভব ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯ শতকের শেষভাগে কলকাতা ও পূর্ববঙ্গের মধ্যশ্রেণীর সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ এই প্রথার একটি রূপান্তর আনয়ন করেছিলেন, যাকে বলা হয় কমিউনিটিভিত্তিক সর্বজনীন পূজা। অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন পূজা কমিটি ভঁহফ পড়ষষবপঃরড়হ করে পূজার বিশাল ব্যয়ভার বহর করার জন্য বিশেষত প্যান্ডেল তৈরি, আলোকসজ্জা, প্রতিমা তৈরি, পূজা অর্চনা, প্রতিমা সাজসজ্জা, ভক্তসহ অতিথি আপ্যায়ন, ঢাকঢোল বায়না, ধর্মীয় পালাগান আয়োজন ইত্যাদি করে থাকে। দুর্গাপূজা একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও সময়ের আবর্তে বর্তমানে তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তুু এর একটি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে : দেশের রাজনৈতিক দল ও সরকার শারদীয় দুর্গোৎসবে মোটা অঙ্কের টাকা অনুদান হিসেবে দিয়ে থাকে। আবার বারোয়ারি পূজা মণ্ডপগুলোর আয়োজকদের চাল ,চিনি, ডাল ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকে। সরকারপ্রধান প্রতি বছর হিন্দু কল্যাণ ট্রাষ্টের মাধ্যমে অনেক অনুদান দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের মতে, এবার সারা দেশে প্রায় একত্রিশ হাজারের মতো স্থায়ী ও অস্থায়ী পূজা ম-প স্থাপিত হতে পারে। যার মধ্যে রাজধানী ঢাকায় মণ্ডপের সংখ্যা প্রায় দুইশত চৌত্রিশটির মতো হবে। পুরাতন ঢাকার লালবাগ থানার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কর্তৃপক্ষ করোনা মহামারীর কারণে সকল স্বাস্থ্য বিধি মেনে পাঁচদিন সীমিত আকারে কর্মসূচী ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ভক্তিমূলক গান পরিবেশন, গরিবদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আরতী প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী ও বিজয়া দশমীর পর্ব। বাংলাদেশের পূজার জগৎ অনেকটা পারিবারিক গণ্ডি পেড়িয়ে এখন দেশে ও বিদেশে বিস্তৃতি ঘটেছে, বিশেষত যেখানে বাঙলা ভাষাভাষীরা আছে, যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত। উংসবের আমেজ যত বাড়ে ততই ব্যাপ্ত হয় আনন্দের সীমানা। পূজার মৌসুমে অনেকেই দেশে আসেন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে পূজা উদ্যাপন করতে। আশা করা যায়, আগামীতে এক অসাম্প্রদািয়ক বাংলাদেশ গড়তে শারদীয় দুর্গোৎসব বিশেষ ভূমিকা রাখবে। লেখক : অধ্যাপক,ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, সিটি ইউনিভার্সিটি
×