ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজ রাজনীতির লাভ-ক্ষতি

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২৩ অক্টোবর ২০২০

পেঁয়াজ রাজনীতির লাভ-ক্ষতি

গত সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করেই সব ধরনের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত। আগাম কোন ঘোষণা ছাড়াই ১৪ সেস্টেম্বর রফতানি বন্ধের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই অস্থির হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার। প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় দাম বৃদ্ধির। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লাফিয়ে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বাজার। কোথাও ১০০ টাকা, আবার কোথাও ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়ে যায়। ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়েন পেঁয়াজের বাজারে। কেউ পাঁচ কেজি, কেউবা ১০ কেজি করে যে যেভাবে পারেন মজুত করেন। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা তো ভাল নয়। গত বছরও (২০১৯ সালে) এই সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকেই (২৯ সেপ্টেম্বর) হঠাৎ করেই আগাম ঘোষণা ছাড়া পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত। তখনও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে ৩০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে পেঁয়াজের কেজি। তাই যদি এবারও একই অবস্থা হয়, তাই পড়ি কি মরি করে ক্রেতারা পেঁয়াজের বাজারে ছোটেন। ব্যাগ ভর্তি করে পেঁয়াজ এনে ঘরে রেখে দেন। যদিও এবার সঙ্গে সঙ্গেই সরকার সক্রিয় হয়ে ওঠে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং বিকল্প বাজার থেকে দ্রুত পেঁয়াজ আনার নির্দেশ দেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মাঠে নামে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের চারটি টিমসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিনটি মনিটরিং টিম অভিযান পরিচালনা করে। পেঁয়াজের বড় পাইকারি আড়তে অভিযান পরিচালনা করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিরও উদ্যোগ নেয়। সেই সঙ্গে বাজারে যোগান বাড়ানো এবং মূল্য কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পেঁয়াজ আমদানিতে আরোপিত ৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশ বিকল্প ১৩ দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে বেসরকারী ব্যবসায়ীরা সাড়ে সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে। পাশাপাশি চীন, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডসসহ অন্যান্য দেশ থেকেও পেঁয়াজ দেশে চলে আসবে। ফলে ভারত পেঁয়াজ না দিলেও দেশের বাজারে দাম ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে পেঁয়াজ নিয়ে এই কেলেঙ্কারিটুকুও হতো না যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সক্রিয় থাকত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গাফিলতিই এই মূল্য বৃদ্ধির বড় কারণ। সব সময় বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম ভারতের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু রফতানি বন্ধের আগে কয়েক দিন ধরেই সীমান্তের স্থলবন্দরগুলোতে এ নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা হচ্ছিল, সেহেতু আগে থেকেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। তাছাড়া গত বছর এই সেপ্টেম্বর মাসেই ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল আগে থেকেই এ বিষয়টি ফলোআপ করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া। সেটি করা হলে বাজার এত অল্প সময়ের মধ্যে নাগালের বাইরে চলে যেত না। এতেই বোঝা যায়, বাজার ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একদমই নির্বিকার। মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম শুধু হম্বিতম্বি ও লোকদেখানো কিছু অভিযানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাজার ব্যবস্থাপনা নেই বলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারকে একেবারেই তোয়াক্কা করছে না। এখন সরকারের উচিত হবে সমস্যা কেটে গেলেই তালিকা ধরে ধরে যারা পেঁয়াজের বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। বিদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য সে দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কূটনৈতিকভাবে যেমন বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে নোট পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তেমনি ভারতের ভেতরেও পেঁয়াজ চাষী ও ব্যবসায়ীরা সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাষীরা লাসালগাঁওতে জাতীয় সড়ক তিনদিন ধরে অবরোধ করেছে। বস্তুত পেঁয়াজ নিয়ে ভারতের চাষীদের রাস্তায় নামার এমন ঘটনা স্মরণকালের মধ্যে ঘটেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, দুর্গাপূজার উপহার হিসেবে যেদিন ইলিশের প্রথম চালান আটটি ট্রাকে করে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে, ঠিক সেদিনই ভারত সরকারের হুকুমে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সিদ্ধান্তের পর দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার পরবর্তী তিন-চারদিন একপ্রকার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে চেষ্টা চালান অন্তত এলসির পেঁয়াজগুলো যাতে বাংলাদেশে যায়। তিনি কথা বলতে শুরু করেন ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে, বিশেষত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। কোন আগাম হুঁশিয়ারি না দিয়ে ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় তার দেশ যে প্রবল অসুবিধায় পড়েছে এবং ভারত সরকারও তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, সেটাই তিনি মনে করিয়ে দেন তাদের। মূলত ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিজিএফটি (ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড) বা বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের ওই বিজ্ঞপ্তিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও কম অবাক হয়নি। বিদেশে রফতানি বন্ধ করার আগে ডিজিএফটি তাদের সঙ্গে পরামর্শ দূরে থাক, এমন একটা সিদ্ধান্ত যে নেয়া হচ্ছে সেটাও সাউথ ব্লককে (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) জানায়নি। ডিজিএফটি এরপর অনানুষ্ঠানিকভাবে যে ব্যাখ্যা দেয় সেটা খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়। ডিজিএফটির ব্যাখ্যা হচ্ছে, তাদের ওপর নির্দেশ আছে দেশের প্রধান কয়েকটি পাইকারি বাজারে ও দশ-বারোটি মেট্রো শহরের খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলেই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রফতানি বন্ধ করতে হবে। তাদের মনিটরিং শাখা যখন পেঁয়াজের দামে সেই উর্ধগতি রিপোর্ট করেছে, তখনই নিয়মমাফিক তারা সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একবারও সাউথ ব্লকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল না। যেখানে আগের বছর (২০১৯ সালে) এই পেঁয়াজ নিয়েই দুই দেশের মধ্যে লঙ্কাকা- ঘটে গেছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বৈঠকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে উভয় দেশ আগে থেকে একে অপরকে জানানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। একইভাবে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও ভারত সম্মত হয় যে, পণ্য বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগে বাংলাদেশকে জানাবে। অথচ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ডিজিএফটি সেই প্রতিশ্রুতির কথা একবারও স্মরণ করল না। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়। সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ঢাকার কূটনৈতিক চাপ, ১৬ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘কূটনৈতিক নোট’ পাঠিয়ে ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বক্তব্য- এই সম্মিলিত চাপের মুখে ভারতকে যে একটা কিছু করতেই হবে, অন্তত বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা ছাড় দিতে হবে, সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এই পটভূমিতে ১৮ সেপ্টেম্বর দিল্লীর উদ্যোগে সেদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সদর দফতরে ডিজিএফটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আলোচনা হয় ভারতের ‘ফেস সেভিং’ বা কূটনৈতিক মুখরক্ষা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, হিলি বা বেনাপোল বন্দরে পেঁয়াজের যেসব ট্রাক ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কাস্টমসের ইন্সপেকশনের জন্য দেয়া হয়েছে সেগুলো এই নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় পাবে। ফলে বাংলাদেশ আশাবাদী ছিল, বেশ কিছু পেঁয়াজের চালান ভারত থেকে আসবে। কিন্তু এত ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘটনার পাঁচদিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর টেন্ডার সম্পন্ন হওয়া ১১টি ট্রাকে ২৪৬ টন পেঁয়াজ ১৯ সেপ্টেম্বর রফতানি করে ভারত সরকার। যদিও কয়েকদিন ট্রাকে আটকা থাকায় রফতানিকৃত এসব পেঁয়াজের বেশিরভাগই পচা ও নষ্ট হওয়ায় ফেলে দিতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। অথচ ১৪ সেপ্টেম্বর রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তের ওপারে ২৫০টি পেঁয়াজবাহী ট্রাক আটকা পড়ে। বেনাপোলে ট্রেনের ওয়াগনেও আটকা পড়ে কয়েক হাজার টন। বন্ধের আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে আমদানির জন্য খোলা এলসির পেঁয়াজের পরিমাণ ছিল প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার টন বলে ভারতীয় রফতানিকারকরাই জানিয়েছেন। যার সমস্ত পেঁয়াজই নষ্ট হয়ে গেছে এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তা ফেলে দিয়েছে বলে সেদেশের পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কোন ঘোষণা ছাড়াই হুট করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়ে এদেশের পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির কি পাঁয়তারা হয়েছিল? কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এ ঘোষণায় বাংলাদেশ সাময়িক বেকায়দায় পড়লেও সরকার দ্রুত তা সামলে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এতে যে আর্থিকভাবে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের একক ক্ষতি হয়েছে তা নয়, বরং বিশাল অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়েছেন ভারতীয় রফতানিকারকরাও। শত শত ট্রাক পেঁয়াজ রফতানির জন্য পাঠিয়েও তা সীমান্ত পার করতে না পারায় নষ্ট পেঁয়াজ নিয়ে অনেকেরই পুঁজি খুইয়ে বসার ও দেউলিয়া হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এসব ক্ষোভ থেকে ভারতের একটি আদালতে পেঁয়াজ রফতানির বিষয়ে সেদেশের ব্যবসায়ীরা একটি রিটও দায়ের করেন। ওই রিটের পর ১৪ সেপ্টেম্বরের আগে খোলা এলসিগুলোর সংখ্যা ও পরিমাণ জানাতে ভারতীয় রফতানিকারকদের নির্দেশ দেয় দেশটির বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। সংস্থাটি নতুন করে চেন্নাই সমুদ্রবন্দর দিয়ে নেয়াসহ বিভিন্ন শর্ত দিয়ে পেঁয়াজ রফতানির অনুমতি দেয়। রফতানি অনুমতি পাওয়া পেঁয়াজের পরিমাণ (বেঙ্গালুরু রোজ ও কৃষ্ণপুরাম নামক দুই জাতের পেঁয়াজ) ১০ হাজার টন করে মাত্র ২০ হাজার টন। শর্তসাপেক্ষে পেঁয়াজ রফতানির অনুমতি দেয়া হয় যাতে বাংলাদেশ এই সুবিধা না পায়। এ সুবিধায় পেঁয়াজ শুধু সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কায় রফতানি হবে। কারণ ভারত থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানি হয় সব সময় স্থলবন্দর দিয়ে। সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি কখনও হয়নি। গত বছরও ভারত রফতানি নিষেধাজ্ঞার পর শর্তসাপেক্ষে এমন রফতানির অনুমতি দিয়েছিল। তখনও বাংলাদেশে পেঁয়াজ আসেনি। পরপর দুই বছর পেঁয়াজ নিয়ে ভারতের অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্ত থেকে বাংলাদেশ অবশ্য ভালই শিক্ষা নিয়েছে। বাংলাদেশ এখন পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কৃষি মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগটি গত বছরই শুরু করেছে। সেই উদ্যোগটি হচ্ছে তিন বছরের মধ্যে দেশকে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। সেই উদ্যোগে প্রথম বছরেই বাংলাদেশের ভাল অগ্রগতিও হয়েছে। লক্ষ্যের প্রথম বছরেই দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ টন। এবার এই উদ্যোগের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও সম্পৃক্ত হয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে যেখানে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৩১ হাজার টন, সেখানে ২০১৯-২০ সালে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৫৮ হাজার টন। কৃষি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। আর পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৮ হাজার টন। আমাদের সমস্যা হলো উৎপাদন থেকে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশে মোট পেঁয়াজের উৎপাদন গিয়ে দাঁড়ায় ১৮ থেকে ১৯ লাখ টনে। অথচ দেশের বাকি চাহিদা পূরণ করতে প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। কম দাম বিবেচনায় প্রধানত ভারত থেকেই বেশিরভাগ পেঁয়াজ আমদানি হয়। এখন যদি আমরা সংরক্ষণাগার তৈরি করে এই নষ্টের পরিমাণ কমাতে পারি এবং দেশেই অন্তত ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করতে পারি, তাহলে আর পেঁয়াজের জন্য কারও ওপর ধর্ণা দিতে হবে না, বরং পেঁয়াজ আমদানি বাবদ আমাদের প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেঁচে যাবে। এজন্য অবশ্য বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যাতে আগামী দুই বছরেই পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যায়। এজন্য অবশ্য ভারতকে ধন্যবাদ। ভারত এভাবে পর পর দু’বছর পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে না দিলে হয়তো সারাজীবনই এই প্রয়োজনীয় কৃষি পণ্যটির জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হতো। যেমনটি গরুর ক্ষেত্রে হয়েছে। ভারত গরু রফতানি বন্ধ করে দেয়ার কারণেই বাংলাদেশ আজ এই গৃহপালিত পশুতে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পেঁয়াজেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ধারণা করা হচ্ছে, বিহারের আসন্ন নির্বাচনকে মাথায় রেখে পুরোপুরি রাজনৈতিক কারণেই ভারত সরকার রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে সেদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দাম নাগালে রাখা যায়। এতে আমাদের কোন আপত্তি নেই, থাকবেও না। ভারত তার অভ্যন্তরীণ কারণে সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। কিন্তু ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে অন্তত একটু জানিয়ে নিলে বা অন্তত এলসির পেঁয়াজগুলো আসার পর সিদ্ধান্ত কার্যকর করলে হয়তো দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি হতো না। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের পর দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে গণমাধ্যমে। দুই পক্ষই বলেছে, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে সোনালী অধ্যায় চলছে, তা অব্যাহত থাকবে এবং সেই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং ’৭১ এর রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ। সম্পর্কের এই সেতুবন্ধ সময়ের পরিক্রমায় দিন-দিন নবতর মাত্রায় উন্নীত হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তথা মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তবও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা আসলে ঐতিহাসিক এবং সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অথচ সেই প্রতিবেশী ভারতই ২০১৯ সালের মতো একইভাবে এ বছরও বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিল। তাহলে আর সেই সম্পর্কের মর্যাদা রইল কোথায়? বরং এই কা- ঘটিয়ে বন্ধুপ্রতিম এই দেশটি মূলত এদেশের ভারত বিরোধীদের হাতে আবারও বিরোধিতার অস্ত্র তুলে দিল। তারা এখন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে, তোমরা যে তাদের এত ছাড় দিচ্ছ, তাহলে তোমাদের সেই সম্পর্কের মূল্য ভারত দিল কোথায়? বস্তুত নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দিল্লীর পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা দাঁড়িয়েছে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘সবার আগে প্রতিবেশীরা।’ এখানে সেই প্রতিবেশীর সম্মানটুকুও রাখা হলো না। এটাই নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের দুঃখ। লেখক : সাংবাদিক
×