ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আরিফ বিল্লাহ মিঠু

মরহুম হাসান আব্দুল কাইয়ূম ও প্রসঙ্গ ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ২৩ অক্টোবর ২০২০

মরহুম হাসান আব্দুল কাইয়ূম ও প্রসঙ্গ ইসলাম

আমার আব্বা অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম (রাহ.) প্রতি শুক্রবার দৈনিক জনকণ্ঠে ‘প্রসঙ্গ ইসলাম’ শিরোনামে বহু বছর যাবত একটি কলাম লিখে আসছিলেন। শুক্রবার আরও বিভিন্ন দৈনিকসমূহে আব্বার লেখা প্রকাশিত হতো তবে সে সব অনিয়মিত। তার হাজার হাজার ভক্ত-পাঠকের মধ্যে আমিও ছিলাম অগ্রগণ্য। পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে প্রথমে আব্বার লেখা ‘প্রসঙ্গ ইসলাম’ পড়তাম। তার লেখার মধ্যে থাকত পবিত্র কুরআন মজিদের তাফসির, হাদিস শরীফের উদ্ধৃতি, বালাগাত মানতিকের বিভিন্ন বিষয়, ইলমে তাসাউফের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। বিশেষ করে আব্বা সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে পবিত্র গ্রন্থসমূহ থেকে যে সব দার্শনিক ইশতেহাদ করতেন তা আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করত। দৈনিক জনকণ্ঠে ‘প্রসঙ্গ ইসলাম’ প্রচারিত হলে আব্বার কাছে দেশ-বিদেশের ভক্তদের কাছ থেকে ফোন আসত। তারা লেখার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশংসা করতেন। আব্বা কখনও আমার কাছে মতামত জানতে চাইতেন। দেখতাম একটি লেখার পর তিনি আর একটি লেখার প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। প্রতিটা লেখাই সমৃদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা থাকত। সাপ্তাহিক লেখা ছাড়াও দুই ঈদের বিশেষ সংখ্যার জন্য বিভিন্ন পত্রিকা থেকে ফোন আসত। এ ছাড়াও লাইলাতুল বরাত, শব-ই-মেরাজ, মহরম, ঈদ-ই- মিলাদুন্নবী, ফাতেহা ই ইয়াজদহমসহ অলি আউলিয়াদের জীবনী, রাজনীতি, বরেণ্য ব্যক্তিদের জীবনের বিভিন্ন দিক আলোকপাত তার লেখায় স্থান পেত। লেখালেখির ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় তিনি মুরিদদের প্রয়োজনমতো সময় দিতে পারতেন না। লেখালেখির ব্যস্ততার কারণে তিনি নিজেও কখনও অনুতপ্ত হতেন। হঠাৎ এক শুক্রবার দেখি কোন পত্রিকায় তার আর কোন নতুন লেখা নেই। আব্বা আর নেই তার শয্যায়। দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফে কিংবা টিভির অনুষ্ঠানে। এই না থাকার কষ্ট বড় পীড়াদায়ক মর্ম বেদনার। অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম (রাহ.) একাধারে দ্বারিয়াপুরের পীর সাহেব, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক, বিটিভির এক সময়ের নিয়মিত ইসলামিক অনুষ্ঠানের ভাষ্যকার, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আউলিয়াদের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ছিলেন পীরদের পীর। অনেক সময় আমাদের ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন দরবার ও খানকা শরীফের পীর সাহেব এবং খলিফারা এসে আব্বার কাছে ইলমে তাসাউফের শিক্ষা গ্রহণ করতেন। তিনি তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন ধৈর্য সহকারে শুনে সে সবের উত্তর দিতেন। দেখতাম তারা আব্বার জ্ঞানগর্ভ দিকনির্দেশনাসমূহ তন্ময় হয়ে শুনছেন। প্রতি ইংরেজী মাসের প্রথম বৃহ¯পতিবার দাদা হুজুরের প্রতিষ্ঠিত ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী পীর তোয়াজ উদ্দীন (রাহ.) গার্ডেনের খানকা শরীফে সাপ্তাহিক যিকিরের মাহফিল ও প্রতি ইংরেজী মাসের প্রথম বৃহ¯পতিবার বাদ মাগরিব মাসিক মাহফিল হয়। আব্বা এই দুটো মাহফিলে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। তিনি পবিত্র কুরআন মজিদ ও সিহা সিত্তার হাদিস গ্রন্থ থেকে ইলমে তাসাউফের ওপর দীর্ঘ আলোকপাত করতেন। এসব মাহফিলে উপস্থিত থাকতেন ওলামায়ে মাশায়েখসহ রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ। লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকার কারণে অনেক সময় তার ভক্তদের সবাইকে সাক্ষাত দেয়া সম্ভব হতো না, হয়ত এতে কেউ মনোক্ষুণœœ হতেন কিন্তু আব্বা কলমি জিহাদের মাধ্যমে সমাজ সেবা ও তার কমিটমেন্ট পৌঁছে দেয়াকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। গত ৬ অক্টোবর মঙ্গলবার ২০২০ দুপুর বারোটা চল্লিশ মিনিটে তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে- তার লাখ লাখ পাঠক, মুরিদান ও ভক্তকুল রেখে আল্লাহ সুবহানতায়ালার ডাকে বরযাখ জীবনে পাড়ি জমান। ওইদিন ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী পীর তোয়াজ উদ্দীন গার্ডেনে তার প্রথম নামাজের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। বাইতুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে দ্বিতীয় জানাজার নামাজ শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার দ্বারিয়াপুর শরীফে। সেখানে বংশের অলি আউলিয়ারা শায়িত আছেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আনুষ্ঠানিকতার শেষে বাদ যোহর মরহুমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আব্বার অসিয়ত অনুযায়ী আমি জানাজার নামাজ কায়েম করাই। আমার দাদু হুজুর কিবলা হযরত শাহ সুফী তোয়াজ উদ্দীন (রাহ.) মাজারের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। আব্বার জানাজা ও দোয়া মাহফিলে দেশের বিভিন্ন জায়গার পীর মাশায়েখ, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও আত্মীয়স্বজন বক্তব্য রাখেন। আব্বার বিদায়ে আমি দারুণভাবে শোকাহত। তিনি শুধু আমার অভিভাবক ছিলেন না ছিলেন সর্বক্ষণিক বন্ধু। আমি অফিসে গেলেও কয়েকবার ফোন করতেন। তার বিস্মিত ভালবাসায় পরিপূর্ণ বাড়িটা আজ কেমন জানি শূন্য শূন্য মনে হয়। আমি যখন হাসপালের মৃত্যুশয্যা থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি আব্বা তখন বাড়ি থেকে হাসপাতালে ভর্তি। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা হয়নি। এই কষ্ট ভাষায় বর্ণনাতীত। আব্বার সঙ্গে দেশ বিদেশের বহু মাহফিলে ও পবিত্র মক্কা শরীফে হজ পালনে অংশ নিয়েছি, তার মধ্যে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দ ছিল আমার জীবনের বিশেষ স্মরণীয় বছর। আব্বাসহ অনেকবার হজ ও ওমরা পালন করেছি কিন্তু সেবার আম্মাসহ আমরা সপরিবারে হজে গিয়েছিলাম। মদিনা মনোয়ারায় পৌঁছানোর পর আব্বা আমাকে নূরে মুজাসম আখেরি নবী হযরত মুহম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা মুবারকের সামনে নিয়ে হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাক্ষী রেখে আব্বা আমাকে দ্বারিয়াপুর শরীফের পীর খিলাফতের পাগড়ি পরিয়ে দেন। তার অর্পিত এই গুরু দায়িত্ব পালনে কতটুকু যোগ্য ছিলাম সেটা আল্লাহ সুবহানতায়ালা ভাল জানেন। তখন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্বারিয়াপুর শরীফের মাহফিল পরিচালনা করে আসছি। আব্বা ছিলেন আমাদের পরিবার ও তার হাজার হাজার মুরিদানের কাছে একটি বিশাল বটবৃক্ষ। তিনি ষাটের দশকে প্রখ্যাত অলিয়ে কামিল যশোহর খড়কি দরবার শরীফের পীর সাহেব আলহাজ্ব শাহ আব্দুল মতিন (রাহ.)-র কন্যা মাহমুদা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার একমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ায় আমার প্রাপ্ত বয়সেও তিনি সর্বক্ষণিক শিশুদের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করতেন। কি খাচ্ছি কি করছি? অফিস থেকে কখন বেরুব নানাবিধ বিষয় নিয়ে দিনে অনেকবার ফোন করতেন। আব্বা শুধু আমার নয় আমার একমাত্র ছোট বোন তাসলিমা হাসান মিতা, আমার ভাগিনা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি আসিফ ফয়সাল মিম, ফারহান, রায়হান, আমার দুই মেয়ে তাসমিয়া, তাসফিয়া, জামাতা ইনকাম ট্যাক্সের কমিশনার মকবুল হোসেন পাইক তার ছোট ভাই বাংলা একাডেমি ও একুশের পদকপ্রাপ্ত ছড়াকার, সাংবাদিক আবু সালেহসহ বিভিন্ন মুরিদানদের খোঁজখবর রাখতেন। তিনি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৩০ এপ্রিল মাগুরা জেলার দ্বারিয়াপুর শরীফে পীর ও জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ মাদ্রাসা থেকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ইংরেজী সাধারণ শিক্ষা লাভের জন্য কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে স্রোতক ডিগ্রী লাভ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯৭০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্র জীবনে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গ্রেফতার হন ও ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জীবনের কৃতকর্মের জন্য জাতীয় লেখক পরিষদের নববর্ষ পুরস্কার ১৩৯৭, জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিষদের নজরুল স্বর্ণপদক ১৯৯৬, জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিষদের মওলানা ভাসানী স্বর্ণপদক ১৯৯১, আধ্যাত্মিক কবিতা পরিষদের সাহিত্য সম্মাননা ২০০০, মুসলিম সাহিত্য সমাজের শান্তি পদক ২০০৯ প্রাপ্ত হন। আব্বা দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, জনকল্যাণ ও সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বেও জড়িত ছিলেন। তার মধ্যে তামুদ্দন মজলিস, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, বাংলাদেশ রুহানী দাওয়াত অন্যতম । আজ আব্বা নেই কিন্তু তিনি রেখে গেছেন তার রচিত তিন হাজারের অধিক প্রবন্ধ বহু সংখ্যক কবিতা ও ছড়া। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে তাফসিরে তারাবিহ, অনুপম আদর্শ, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, খোকাখুকুর ছড়া, ফুরফুরার চাঁদ, জিহাদ, কাদরিয়া তরিকা, সাব্বির কাব্যে ইসলামী ভাবধারা, ইসলাম ও জীবন, প্রসঙ্গ ইসলাম ইত্যাদি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তার অধিকাংশ লেখাই এখনও গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়নি। দ্বারিয়াপুর শরীফে তার প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া এতিমখানা, দেশ বিদেশে লাখ লাখ মুরিদান ও পাঠককুল তার কর্মময় জীবনের ধারক। আপনারা তার জন্য ও আমাদের পরিবার পরিজনের জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ সুবহানতায়ালা সবারই কল্যাণ ও নেক হায়াত দান করুন। লেখক : অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম (রাহ.)-এর ছেলে, দ্বারিয়াপুর শরীফের পীর সাহেব
×