ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যশোরের ইতিহাসে নারীদের নেতৃত্বে প্রথম পূজা ॥ শিকল ভাঙ্গলো দলিত নারীরা

প্রকাশিত: ১৫:৩০, ২২ অক্টোবর ২০২০

যশোরের ইতিহাসে নারীদের নেতৃত্বে প্রথম পূজা ॥ শিকল ভাঙ্গলো দলিত নারীরা

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ যশোর সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের সুজলপুর গ্রামে যশোরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নারীদের নেতৃত্বে দূর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। শাশ্বাসী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার সদস্যদের নেতৃত্বে এই পূজা আয়োজিত হচ্ছে। যশোরের পূজার ইতিহাসে এটি নারীদের নেতৃত্বে প্রথম পূজা এটি। একইসাথে পুরোহিত সহ সংশ্লিষ্ট সকলেই দলিত যেটি সনাতন সমাজের প্রথা ভেঙ্গে নতুনের দিকে যাত্রা। নমঃশুদ্র, পৌন্ড্র ক্ষত্রিয়, ঋষি, জেলে, ডোম, হেলা, পাটনী কায়পুত্র, বাগদী, খাসি, বুনো, সরদার, কর্মকার, নানা সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া মানুষদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রভাবশালীরা তাদেরকে যেমন কোথাও স্থান দেয় না, একইসাথে সম্মানও দেয় না, আবার দলিত নারীদেরও তাদের সম্প্রদায়ের পুরুষেরা ঘরের বাইরে বের হতে দেয় না। ফলে তারা নিন্ম জাতের ও নিন্ম শ্রেণীতে অবস্থান করে। সেজন্য শাশ্বাসী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার নারীদের উদ্যোগে নারীদের নেতৃত্বে পূজা করে এই ইতিহাস তৈরির আয়োজন বলে জানালেন পূজা কমিটিতে থাকা দলিত নারীরা। পূজা উদযাপনের জন্যে গঠিন ১০ সদস্যের ১০ জনই নারী, যেটি যশোরের পূজা উদযাপনের ইতিহাসে কখনো হয়নি। শাশ্বাসী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার শারদীয় দূর্গোৎসবের সভাপতি জয়ন্তী রানী দাস ও সাধারণ সম্পাদক আয়নামতি বিশ্বাস। কোষাধাক্ষ্যের দ্বায়িত্বে আছেন আরতি দাস। পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্তী রাণী দাস বলেন, আমাদের শাশ্বাসী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার মিটিংয়ে আলোচনায় উঠে আসে দলিত নারীরা ঘর থেকে পুরষতান্ত্রিকতার চাপে বের হতে পারেন না। একে আমরা পিছিয়ে পড়া জাতি, আমাদের পুরুষদেরও শিক্ষা নেই, অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই। সেজন্য আমরা নারীরাও যেন আমাদের পরিবারের ও সন্তানের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারি, তারা যেন আমাদের মতো অবহেলিত জীবন যাপন না করে, সেজন্য আমরা নারীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও ঘর থেকে বের করে কাজে আনার জন্যে নারীদের নেতৃত্বে এই পূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেই। আমরা সমাজের অনেকের কটু কথা সহ্য করে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করেছি এবং শেষমেষ পূজা শুরু করতে পারলাম। পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও দলিত নারীদের ভিতরে প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাস আয়নামতি বিশ্বাস বলেন, আমার বয়স ৩৫ অথচ আমিই প্রথম দলিত নারী যে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি। এর পরেও অল্প কয়েকজন দলিত নারী শিক্ষিত হতে পেরেছে, অথচ এখানে ৮০০ মতো দলিত মানুষের বাস। আমাদের মেয়েরাই কেবল নয়, ছেলেরাও শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে। এজন্য আমরা নারীরা এগিয়ে এসেছি অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। এই পরিবর্তনের ধাপ হচ্ছে দূর্গা পূজা, দূর্গা মায়ের আর্শীবাদে এবার থেকে আমরা পরিবর্তন ঘটাতে পারবো আমাদের অবহেলিত জীবনের। পূজা কমিটির কোষাধ্যাক্ষ্য আরতি দাস বলেন, আমার মাত্র ৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। শিক্ষা পাইনি, এখনও আমি কোন অর্থনৈতিক বা অন্যকোন অধিকার পাইনা। এজন্য আমি চাই আমার সন্তান শিক্ষিত হোক। সেজন্য ছেলেকে কলেজে ভর্তি করতে পেরেছি। মেয়ে এসএসসি দিবে। আমরা যেন সমাজের প্রতিটি জায়গাতেই পরিবর্তন ঘটাতে পারি, সেজন্য আমরা নারীরাই উদ্যোগ নিলাম এই পরিবর্তন ঘটানোর। দূর্গা মা’কে সামনে নিয়েই আমরা এগিয়ে যাবো। শাশ্বা্সী দলিত নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার পূজা আয়োজনে পুরোহিতের দ্বায়িত্ব পালন করা নীলরতন দাস বলেন, আমি নিজেও দলিত সম্প্রদায়ের। আমি পূজা যখন প্রথম শুরু করি, তখন দেখি ব্রাহ্মণেরা বাঁধা দিতো, অবজ্ঞা করতো। সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দলিত নারীরা সমাজের আরও নীচের স্তরে আছে, তাদের নেতৃত্বে এই পূজা তাদেরকে মর্যাদার আসনে বসাবে। আমি এই পূজার দ্বায়িত্ব পেয়ে গর্বিত।
×