ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আইন প্রয়োগে রাজনীতি বড় বাধা বছরে মৃত্যু ২০ হাজারের বেশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিশেষজ্ঞদের ১০ পরামর্শ এমন বাস্তবতায় আজ পালিত হচ্ছে নিরাপদ সড়ক দিবস

নিরাপদ হয়নি সড়ক ॥ উদ্যোগের কমতি নেই

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ২২ অক্টোবর ২০২০

নিরাপদ হয়নি সড়ক ॥ উদ্যোগের কমতি নেই

রাজন ভট্টাচার্য ॥ অগ্রাধিকার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে গত কয়েক বছরে সরকার অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সড়ক নিরাপদ করা যায়নি। অবহেলার কঠোর শাস্তির বিধান করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। চালকের যথাযথ ট্রেনিং এবং গাড়ির ফিটনেস নিশ্চিত করার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে নানামুখী সিদ্ধান্ত। ক্রটি দূর করার জন্য পুরাতন সড়কগুলোর সংস্কার সাধন করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি করা হচ্ছে নতুন সড়ক। তারপরও সড়ক নিরাপদ করার ক্ষেত্রে খুব একটি উন্নতি হয়নি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের এখন বড় দুর্ভাবনা। সড়ক নিরাপদ করার জন্য বিশেষজ্ঞদের রয়েছে বেশ কিছু পরামর্শ। ২০২১ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা-২০২০ গ্রহণ করেছে সাম্প্রতিক সময়ে। এর মাধ্যমে সরকার সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে চায়। এজন্য সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকর করার পাশাপাশি বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। বিগত ১১ বছরের বেশি সময় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা চলছে। দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ, সরকার গঠিত কমিটির সুপারিশ, পুলিশের নির্দেশনা সবই হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঙ্কট যে তিমিরে ছিল, সেখানেই আছে। উদ্যোগ হয়েছে ঠিকই, বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। এই প্রেক্ষাপটে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫৫ জনের মৃত্যু হচ্ছে। মাসে মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ৬৫০ জন ও বছরে ২০ হাজার ৭৫। বিশ^ ব্যাংক বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ায় এখন সর্বোচ্চ বাংলাদেশে। প্রতি ১০ হাজার যানে মৃত্যু হচ্ছে ১০২ জনের। সমপরিমাণ যানবাহনে ৩০ ভাগ পথচারী মারা যাচ্ছেন। সবচেয়ে ঝুঁকিতে ১৫-৪৯ বয়সী মানুষ। আর এক দশকে শহরাঞ্চলে মৃত্যু বেড়েছে ৪০ ভাগ। মোট দুর্ঘটনার মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ৩২ ভাগ। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বাসের দায় ২৬ ভাগ। সড়কে এরকম ভয়াবহ চিত্র সামনে রেখে চতুর্থ বারের মতো আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। ‘মুজিববর্ষের শপথ-সড়ক করবো নিরাপদ’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দেশব্যাপী দিবসটি পালনে সীমিত পর্যায়ে কর্মসূচী নেয়া হয়েছে বিআরটিএর পক্ষ থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তত ১০টি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, সকল হাইওয়েতে ডিভাইডার নির্মাণ, অযান্ত্রিক ও নিষিদ্ধ যান চলাচল বন্ধে কঠোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া, আইনের কঠোর প্রয়োগ, চালক ও যাত্রী সচেতনতা বৃদ্ধি, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো বন্ধ ও মাদক সেবন রোধ করতে হবে। নতুন সড়ক নির্মাণে নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া, লাইসেন্স দেয়ার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা, সার্ভিস লেন নির্মাণ, গাড়ির ফিটনেসের জন্য ভেহিকেল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) স্থাপন ও গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিড লার্নার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। চলতি মাসের প্রথম দিকে মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা আমাদের অগ্রাধিকার এবং চ্যালেঞ্জ। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের এখন বড় দুর্ভাবনা। মহাসড়কের ছোট এবং নন-মোটরাইজড যানবাহন চলাচল বন্ধের বিষয়টি কঠোরভাবে কার্যকর করা জরুরী। আজ ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবস। সড়ক নিরাপত্তায় আমাদের কাজগুলো দৃশ্যমান করতে হবে। যেনতেনভাবে এ সকল দিবস পালন করে কী লাভ। আমাদের দেশে দিবস ও সপ্তাহ পালন করতে করতেই অফিসিয়াল দিনগুলো চলে যায়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। একদিন এসব দিবস পালন না করে বরং প্রতিদিনই দিবসের যে বিষয়গুলো সেগুলো কার্যকর করতে হবে। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় শাস্তির বিধান রয়েছে আইনে। অথচ সেটা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে সেই বিষয়ে জনমনে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিআরটিএ’র চ্যালেঞ্জগুলো জানতে চাইলে বিআরটিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান বলেন, দুর্ঘটনা রোধে বিআরটিএ’র সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এক থেকে দুই মিনিট চোখে দেখে গাড়ির ফিটনেস দেয়া হয়। এটা বিজ্ঞানসম্মত কোন পদ্ধতি নয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে যানবাহনের ফিটনেস ঠিকমতো দিতে হবে। সঠিকভাবে যানবাহনের ফিটনেস দিতে হলে ভেহিকেল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) স্থাপন করতে হবে। তিনি বলেন, লার্নার্স লাইসেন্স দেয়ার সময় আইনে বলা আছে বিআরটিএ অনুমোদিত ড্রাইভিং সেন্টার থেকে গাড়ি চালানো শিখতে হবে। এখন ১০৭টি অনুমোদিত ড্রাইভিং সেন্টার রয়েছে। এ কাজটি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। হাইওয়ে পুলিশের দিক থেকে দুর্ঘটনা রোধে চ্যালেঞ্জ হলো গত প্রায় আট বছর আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্পিড গার্নার দেয়া হবে। এখন পর্যন্ত মাত্র একটি স্পিড গার্নার দেয়া হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-উত্তরাঞ্চলমুখী ঝুঁকিপূর্ণ এসব মহাসড়কে পর্যাপ্ত স্পিড গান সরবরাহ করা উচিত। এই যন্ত্রের সুবিধা হলো গাড়ি চালকের বোঝার কোন সুযোগ নেই তার গতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অথচ তাকে বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে। স্পিড গার্নার হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে। দ্রুতগতির যান ও নিষিদ্ধ যানের কারণে মহাসড়কে বেশি দুর্ঘটনা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে বারবার আলোচনা হয় সড়ক-মহাসড়কে চলা অনুমোদনহীনসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বন্ধের বিষয়ে। কিন্তু যখনই পুলিশ এসব যান চলাচল বন্ধে পদক্ষেপ নেয় তখন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বাধার মুখে পড়তে হয়। এসব যান উচ্ছেদে কড়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরী। সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র ॥ গত বছরে শুধু সড়ক দুর্ঘটনাই ঘটেছে ৪ হাজার ৭০২টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ২২৭ জন। আহত ৬ হাজার ৯৫৩ জন। সবচেয়ে বেশি ৩০৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনের করা ‘২০১৯ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে’ এসব তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ১ হাজার ৫৯৯টি বেশি হয়েছে। ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৬৪৫ জন নিহত ও ৭ হাজার ৯০৮ জন আহত হয়েছিল। করোনাকালসহ জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৪৯৫ ব্যক্তি নিহত হয়েছে এবং ৯৭৫ জনের মতো আহত হয়েছে; যদিও মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ ছিল। গত আগস্ট মাসে সারাদেশে ৩০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জন নিহত এবং ৩৬৮ জন আহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের আগস্ট মাসের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিদিন কত মৃত্যু ॥ ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর তথ্য অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন ১৮ জনের প্রাণহানি হচ্ছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এ সংখ্যা আরও বেশি। তাদের মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ ব্যক্তির প্রাণহানি হচ্ছে। আর বাংলাদেশ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষ নিহত এবং ৩৫ হাজার আহত হয়। বলাবাহুল্য, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সঠিক পরিসংখ্যান কোথাও পাওয়া যায় না। সব দুর্ঘটনা ও হতাহতের হিসাব থানায় লিপিবদ্ধ হয় না বা সংবাদপত্রেও আসে না। এ কারণেই এ বিষয়ক পরিসংখ্যানে সংগঠনভেদে পার্থক্য দেখা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, সড়ক নিরাপদ হতে হবে অন্যথায় মানুষের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঘটবে। কথা একটিই তা হলো মানুষের জন্য সড়ক নিরাপদ করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে ভাল সড়ক নেটওয়ার্ক, যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। গাড়িচালকদের সচেতন করে তোলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাড়তি গতি ও প্রতিযোগিতা করে কখনই যানবাহন চালানো যাবে না। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহার করা যাবে না। চালকদের এমন কিছু খাওয়া যা খেলে চোখে ঘুম আসে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে চালকের পাশাপাশি পথচারীদেরও দায়িত্ব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাস্তা পারাপারে ফুটপাথ, জেব্রা ক্রসিং, ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে এ রকম সুবিধা নেই সেখানে সাবধানে সড়ক পার হতে হবে। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মহাসড়কে নিষিদ্ধ যান চলাচল বন্ধের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এজন্য এনফোর্সমেন্ট বাড়াতে হবে। দুর্ঘটনার ১০ কারণ ॥ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কিছু কারণও চিহ্নিত করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন: যার মধ্যে রয়েছে- দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌপথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, মহাসড়কে সবচেয়ে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে হতাহতের সংখ্যা বাড়ে। তাই দেশের সকল মহাসড়কগুলোর মাঝখানে ডিভাইডার স্থাপন করার বিকল্প নেই। স্থানীয় যানবাহন চলাচল করার জন্য হাইওয়ের সঙ্গে সার্ভিস লেন নির্মাণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সার্ভিস লেন না থাকলে অল্পগতির যানবাহন মূল সড়কে ইচ্ছেমতো চলাচল করায় দুর্ঘটনা হয়। সড়ক নিরাপত্তার জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে দোষের বিচারের দৃষ্টান্ত না থাকলে অনেকেই বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালান, তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দৃষ্টান্ত জরুরী বলে মনে করেন তিনি। উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা কম হলেও সেখানে বছরব্যাপী দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চলে একথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে নির্দিষ্ট দিনের জন্য কোন কর্মসূচী নয়, সারা বছর দুর্ঘটনা রোধে সমানতালে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। নতুন সড়ক নির্মাণের সময় সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ডিজাইন করার তাগিদ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের কাছে সার্বিক তথ্য বিশ্লেষণে মনে হয় না সড়ক দুর্ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। বর্তমানে হাইওয়েগুলোতে যানবাহনের ৩২ভাগ মুখোমুখি সংঘর্ষে হতাহতের সংখ্যা বেশি হচ্ছে জানিয়ে এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের এই পরিচালক। কম দুর্ঘটনার দেশ ॥ বিশ্বের মধ্যে নরওয়ের সড়ক সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ সেখানে দুর্ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে কম। দেশটির সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আফটেনপোস্টেনে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে গত চার বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পেয়েছে মাত্র তিন শতাংশ। ইউরোপিয়ান ট্রান্সপোর্ট সেফটি কাউন্সিলের (ইটিএসসি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইইউ বা ইউরোপিয়ান ফ্রি ট্রেড এ্যাসোসিয়েশন (ইএসটিএ) ভুক্ত কোন দেশেই ২০১০ সালের পর এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, নরওয়ে এরই মধ্যে গ্রাফের নিচে এবং এখনও দুর্ঘটনার হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এখন বিশ্বের মধ্যে নরওয়েতে সড়কে মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম। গত বছর নরওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনায় ১০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা গড়ে প্রতি ১০ লাখে ২০ জন। সুইডেনেও সড়ক দুর্ঘটনার হার কম। সেখানে প্রতি ১০ লাখে গড়ে ২৫ জনের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডে এই হার ২৭। অথচ ফ্রান্সে এই হার ৫৩। ইইউতে গড়ে ৫০। বাংলাদেশে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ায় এখন সর্বোচ্চ বাংলাদেশে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ: লিডারশিপ প্রায়োরিটিস এ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মারা যান ১০২ জন। পাশের দেশ ভুটানে এ সংখ্যা ১৬ দশমিক ৭০, ভারতে ১৩, নেপালে ৪০ ও শ্রীলঙ্কায় সাতজন। যদিও বাংলাদেশে প্রতি হাজারে যানবাহন আছে মাত্র ১৮ জনের। ভারতে এ সংখ্যা ১৫৯, নেপালে ৮১, ভুটানে ১০৯ ও শ্রীলঙ্কায় ৩২৭। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের দুর্ঘটনায় গড়ে দুজন সাইকেল চালকের মৃত্যু হয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুই বা তিন চাকার মোটরযানের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ১১ দশমিক ২০। আর গাড়ি ও হালকা যানের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ হাজার যানের দুর্ঘটনায় ১৩ দশমিক ৩০ জন গাড়িচালক ও ২৮ দশমিক ৬০ জন যাত্রী প্রাণ হারান। ট্রাকচালকদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ছয় দশমিক ১০, বাসচালকের ক্ষেত্রে আট দশমিক ২০ ও বাসযাত্রীর সংখ্যা ২৮৬ দশমিক ৬০ জন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। ১০ হাজার দুর্ঘটনায় ৩৩ ভাগ পথচারীর মৃত্যু ॥ বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পথচারী রয়েছেন। প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে পথচারী মারা যান ৩২ দশমিক ৭০ জন। ভুটানে এ সংখ্যা শূন্য দশমিক ৫০, ভারতে এক দশমিক ২০ ও শ্রীলঙ্কায় দুই দশমিক ১০। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ২০ হাজার ৭৩৬ থেকে ২১ হাজার ৩১৬ জন। আর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে বাংলাদেশে মাথাপিছু ক্ষতির পরিমাণ উচ্চ আয়ের দেশের তুলনায় দ্বিগুণ। ঝুঁকিতে ১৫-৪৯ বয়সীরা ॥ ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মাথাপিছু ক্ষতি বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীরা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে এ ঝুঁকি ১৫ গুণ বেশি। গাড়ির লাইসেন্স দেয়ার হার দ্রুত বাড়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ না করলে ঝুঁকি কমবে না বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের মধ্যে শিশুরাও (পাঁচ থেকে ১৪ বছর) বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ১৯৯০ সালে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ছিল ৯ম স্থানে। ২০১৭ সালে তা উঠে এসেছে চতুর্থ নম্বরে। ২০১৬ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ২২০ জন স্থায়ীভাবে অক্ষম হচ্ছেন। এক দশকে শহরে মৃত্যু বেড়েছে ৪০ ভাগ ॥ বিশ্বব্যাংক বলছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে শহর এলাকায় ৪০ শতাংশ মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক দুর্ঘটনাই ঢাকা শহরে ঘটছে। আর অন্য মেট্রোপলিটন শহরগুলোয় দুর্ঘটনা ঘটছে ৩০ শতাংশ। ঢাকা শহরের সড়ক দুর্ঘটনার অর্ধেকের জন্য দায়ী বেপরোয়া গতির বাস। বিশ^ব্যাংকের চোখে দুর্ঘটনার কারণ ॥ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে জানায়, সড়ক নিরাপত্তায় গৃহীত কার্যক্রমের দুর্বলতা বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেক হ্রাস করতে বাংলাদেশকে আগামী এক দশকে অতিরিক্ত ৭৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে সাফল্য নির্ভর করছে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি এবং টেকসই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তা অর্জনে জোরদার উদ্যোগের ওপর। সড়ক নিরাপত্তায় সরকারের কিছু কার্যক্রমও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুমোদন, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ২০২০ গ্রহণ। এর মাধ্যমে সরকার সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনও অনেকটাই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সড়ক ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা কার্যক্রম ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী উদ্ধার প্রক্রিয়া উন্নীত করতে তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশনা নেই পরিকল্পনায়। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এগুলো হলো টেকসই ও নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা করা, যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শিশুদের জন্য নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা করা, শহরগুলোয় নিরাপদ গতি ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও নতুন প্রযুক্তি সংযোজন করা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসডিজির আওতায় আগামী ২৪ বছরে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমানো গেলে ২৪ বছর ধরে এ সুফল পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে মোট দেশজ উৎপাদন সাত থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত ক্ষতি হ্রাস বিবেচনা করলে জিডিপি বাড়বে সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশ। এক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যক্তিপর্যায়ে ক্ষতি কমিয়ে আনতে বীমা চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ১০ লাখে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১৭৪ জনের মৃত্যু হয়। বিশ্বে সড়কপথে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। দেশে সড়কপথে চলাচলরত প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় প্রতি বছর প্রাণহানি ঘটে ২৮৭ জনের। পুলিশের তথ্য বলছে, দেশে গতবছর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মোট প্রাণহানির মধ্যে বাসের সম্পৃক্ততা ছিল কমবেশি ২৬ শতাংশ। সড়কে প্রাণহানির সঙ্গে বাহনটির এ ব্যাপক সম্পৃক্ততার জন্য মূলত ফিটনেসের অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন দুর্ঘটনার তদন্তেও বিষয়টি উঠে এসেছে। একই কথা বলছেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞরাও। স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে যানবাহনের বডি ॥ পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে চলাচলরত বাসগুলোর সিংহভাগেরই বডি স্থানীয়ভাবে তৈরি। বিদেশ থেকে আনা হয় শুধু চেসিস। স্থানীয়ভাবে বডি বানানোর সময় এতে সিট বসানো হয় মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী। বেশি সিট বসানো হলে বাসের ভারসাম্য ঠিক থাকে না। আবার সিটগুলোর ওয়েল্ডিংও হয় নিম্নমানের। ফলে বাস যখন দুর্ঘটনায় পড়ে, তখন প্রাণহানি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এছাড়া চালকের অদক্ষতাকেও বাসসম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় এত বেশি প্রাণহানি ঘটার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্য বলছে, সারাদেশে প্রায় দুই লাখ বাস-ট্রাক চালকের প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই। অনেকটা বাধ্য হয়েই এসব অদক্ষ চালকের হাতে বাস ছেড়ে দিচ্ছেন পরিবহন মালিকরা। সড়কে বাস দুর্ঘটনার পেছনে এসব অদক্ষ চালক অনেকাংশেই দায়ী বলে মনে করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সাবেক চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার পাশাপাশি গতবছর থেকে কার্যকর হয়েছে নতুন সড়ক পরিবহন আইন। যথাযথ পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ এবং আইন প্রয়োগ করার মাধ্যমে দুর্ঘটনাসহ সড়ক খাতের নানা বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। শীঘ্রই এর সুফলগুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। বিশ্বব্যাংকের ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাসের দায় ২৬ শতাংশ হলেও বিশ্বের অন্য কোন দেশে তা ১৫ শতাংশের বেশি নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। নৌ সড়ক ও রেলপক্ষ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে নিকট অতীতে কয়েক দফা বড় ধরনের গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে বটে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে দুর্ঘটনা মোটেও কমেনি। এমনকি করোনা মহামারীর প্রথম দিকে দুই মাস যাত্রীবাহী সড়কযান বন্ধ থাকাকালেও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত পণ্যবাহী যানবাহন দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- সড়কে এখনও শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হয়নি, গণপরিবহন খাতে বিশেষ করে বাস ও ট্রাক টার্মিনাল, টেম্পু স্ট্যান্ড এবং দূরপাল্লার সড়কে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মহলকে চাঁদা দিতে হয়। নতুন আইন অর্থাৎ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর বেশ কিছু ইতিবাচক দিক ছিল। যেমন চালক বা সহকারীর কাছে দৈনিক চুক্তিভিত্তিক বাস ইজারা দেয়া যাবে না, চালক ও সহকারীদের নিয়োগপত্র প্রদান এবং দূরপাল্লার সব ধরনের গাড়িতে দুই জন চালক নিয়োগ, মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন নিষিদ্ধ ইত্যাদি। কিন্তু দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময়ে আইনটি কার্যকর করতে না পারা খুবই দুঃখজনক। চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনে আলাপ, ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা, লাইসেন্সবিহীন লাখ লাখ মোটরসাইকেল ও অযান্ত্রিক যানবাহনের বেসামাল চলাচল এবং সর্বোপরি সড়কে চলাচলের সময় সাধারণ মানুষের অসতর্কতাও দুর্ঘটনার কারণ। বিপজ্জনক মোটরসাইকেল ॥ সরকারী হিসাব অনুযায়ী দেশে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যা ৪৫ লাখ ২৩ হাজার ৬০০। এরমধ্যে ৩০ লাখ ৩২ হাজারের বেশি মোটরসাইকেল রয়েছে। আর রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহন হলো ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ৯৪৯, এরমধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সাত লাখ ৬২ হাজারের বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে দুই চাকার এই যানে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, মোটরসাইকেল বাহনটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ দুই চাকার যান। চার চাকার সঙ্গে তুলনা করলে এটি ৩০ গুণ ঝুঁকিপূর্ণ। আর এজন্যই উন্নত বিশ্বে মোটরসাইকেলকে কখনও পৃষ্ঠপোষকতা দেয় না। সেই হিসেবে না বুঝে, না জেনে মোটরসাইকেল বানানোর জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রণোদনা দিয়ে যেভাবে ফ্যাক্টরি বানাতে উৎসাহিত করছে, তাতে এবার পরিসংখ্যানে যা এসেছে তা এরপর আরও বেশি হবে। তিনি আরও বলেন, ‘মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এসব দেশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা একটি অভিশাপ। এই অভিশাপে তরুণ প্রজন্ম মারা যায় এবং যারা বেঁচে থাকে তারা পঙ্গুত্বের শেষ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার মোটরসাইকেলের উৎপাদন মূল্য কমানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখান থেকে ত্বরিত গতিতে বেরিয়ে আসতে হবে। উৎপাদন মূল্য কৌশলগতভাবে না বাড়িয়ে রাখলে, সরকার দায় এড়াতে পারবে না।
×