ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এইচএসসি পরীক্ষা না নেয়ার বিকল্প কি?

প্রকাশিত: ২১:০২, ২২ অক্টোবর ২০২০

এইচএসসি পরীক্ষা না নেয়ার বিকল্প কি?

করোনাভাইরাস সারা বিশ্বজুড়ে তা-ব চালাচ্ছে। এরই মধ্যেই কিছু কিছু খাত- উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, দোকানপাট খোলা হয়েছে। সীমিতভাবে আমদানি-রফতানি শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও, বিদেশেও। বর্তমানে দেশে একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমসহ যাত্রাপালাও বন্ধ আছে। যার ফলে দরিদ্র যাত্রা অভিনেতা-অভিনেত্রী, যন্ত্রীদল খুবই অভাব অনটনে আছেন। এদিকে বেসরকারী বন্ধ হয়ে পড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরা বেতন না পেয়ে কেউ রাজমিস্ত্রীর জোগালি কাজে পর্যন্ত নেমেছেন। কেউ নৌকার মাঝি হয়েছেন, কেউ ছোট দোকানি হয়েছেন, কেউ বা ফল বিক্রি করছেন। হাজার কয়েক স্কুল চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল বাড়ির ভাড়া দিতে না পারার কারণে! কিন্তু, সব স্কুলেই যথেষ্ট সংখ্যক শিশু বিভিন্ন শ্রেণীতে পড়াশোনা করত- তাদের কি হবে? এটিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিবেচনায় নিতে হবে এবং এসব বেসরকারী ছোট, বড় স্কুলের শিক্ষক ও শিশুদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানের বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে- এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি থাকার পরও এপ্রিলে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার কারণে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। পরীক্ষার হলে অনেক শিক্ষার্থীর অন্তত তিন ঘণ্টা কাছাকাছি বসার রীতি মেনে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি কোভিড-১৯ রোগের স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ করে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলার প্রেক্ষিতে সরকারকে পরীক্ষা বেশ ক’বার পিছিয়ে দিতে হয়েছে। পরীক্ষা গ্রহণ করার মতো পরিস্থিতি এখনও না আসার কারণে পরীক্ষা বাতিল করতে হয়। এখন আমাদের দেখতে হবে- অন্যান্য দেশ পরীক্ষার ক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমরা জানি- গত ‘এ লেভেলে’ পরীক্ষা, যেটি যুক্তরাজ্য কর্তৃক পুরো বিশ্বে পরিচালিত হয়, সেটি বাতিল করা হয়। শেষ পর্যন্ত ‘এ লেভেল’ পরীক্ষার আগে স্কুল দ্বারা গৃহীত সর্বশেষ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরকে ‘এ লেভেলে’র চূড়ান্ত ফল হিসেবে গণ্য করার কথা ঘোষণা করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ঐ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সুতরাং আমাদের দেশের ভেতরে এই উদাহরণ তৈরি হয়েছে যে- ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের স্কুল ফাইনাল ‘ও-লেভেল’ ও স্কুল কর্তৃক গৃহীত দ্বাদশ শ্রেণীর সর্বশেষ পরীক্ষার নম্বর দেখে, এ দুই পরীক্ষার গড় নম্বর অথবা গ্রেড পয়েন্ট বিবেচনা করে তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি করবে। এদের সিংহভাগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। কিন্তু একটা ছোট অংশ বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আইইউবি ও অন্যান্য বিভাগে পরীক্ষা দিয়ে অথবা গ্রেড পয়েন্টের ভিত্তিতে ভর্তি হবে। এখন, আমাদের বাংলা মাধ্যম স্কুল-কলেজ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী শেষ করে ‘এ লেভেল’- শিক্ষার্থীদের মতই একই রকম ফাইনাল পরীক্ষা দিতে না পারার অবস্থানে আছে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা। দেখা যাচ্ছে- এরা এসএসসি পাস করে এর ফল, নম্বর বা গ্রেড পয়েন্ট নিয়ে একটা অবস্থানে আছে। তারা ঠিক ‘এ লেভেলে’র পরিক্ষার্থীদের মতই দ্বাদশ-শ্রেণী অন্তে এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেনি। কথা হচ্ছে- দুই দলই কিন্তু একই অবস্থানে আছে। অথচ এক দল- ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা নির্ভাবনায় বিষয় পছন্দ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনলাইনে কোচিং গহণ করছে। আর উল্টোদিকে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা যেন নিজেরাই পরীক্ষা না দিতে পেরে বড় এক দোষ করে মানসিক অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছে! এদিকে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নানা উপায়, নানা বিকল্প আলোচনা করে ওদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রশাসক, পরিচালকদের অনুরোধ করব- দেশের ভেতরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যে উপায় ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহার হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই বাংলা-মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাও একই রকম উপায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না কেন? ওদের এসএসসির ফল এবং স্কুল-কলেজে দ্বাদশ শ্রেণী অন্তে গৃহীত শেষ পরীক্ষার ফল রয়েছে, এ দু’টোর প্রাপ্ত নম্বরকে গড় করে অথবা গ্রেড- পয়েন্টকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই শিক্ষার্থীদের ভর্তি করতে পারে। এদের জন্য বিশাল ভর্তি পরীক্ষা সম্ভব হলে হবে, নতুবা এর প্রয়োজন নেই। তাদের আরও একটা কথা মাথায় রাখতে হবে- পৃথিবীর কোন দেশে ক্লাস এইটের পর কোন রকম পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় না। সুতরাং ক্লাস এইট পাসের পরীক্ষার স্কোরের আন্তর্জাতিকভাবে কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না এবং নেই। তাই জেএসসি পরীক্ষার ফলকে বিবেচনায় আনার সুযোগ নেই। সুতরাং আপনাদের খোঁজ নিতে হবে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যেসব দেশে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পড়াশোনা করতে যায়, প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত- এসব দেশে দ্বাদশ শ্রেণী শেষের পড়াশোনা কোভিড-সময়কালে তারা কিভাবে পরিচালনা করছে? ‘এ- লেভেলে’র পরীক্ষা যখন বাতিল করা হয়েছে, তখন এসব দেশ কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করছে? খুব কাছের দেশ, ভারতের শিক্ষা দফতরগুলো এমন ক্ষেত্রে কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা জানা প্রয়োজন। সব দেশেই দ্বাদশ শ্রেণী অন্তে যে পরীক্ষা হবার কথা, সেটি হতে পারেনি। কিন্তু যেসব দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে স্কুল খুলে দিয়েছিল, যার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিপুল হারে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়। তখন আবার দ্রুত স্কুল বন্ধ করা হয়। ইউরোপের অনেক দেশে ক্লাব, পাব, রেস্তোরাঁ খুলে দিয়ে আবার সম্প্রতি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগমনে জনগণের মধ্যে সংক্রমণের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সব জনসমাগম হবার স্থানসহ পুরো শহরগুলোতে লকডাউন বা কারফিউ দিতে বাধ্য হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোর সরকার। এমন বিশ্ব পরিস্থিতিতে শিক্ষার আগে অর্থনীতি, খাদ্য, উৎপাদন, খাদ্য সংগ্রহ অনেক বেশি জরুরী হয়ে পড়েছে। বর্তমানে অনলাইনে সব দেশে লেখাপড়ার কাজ চালানো হচ্ছে। আমাদের দেশেও অনলাইনে লেখাপড়া চালু হয়েছে। এতে বিজ্ঞানের পরীক্ষণ হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু এর তত্ত্বীয় জ্ঞান, অন্যান্য মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর পাঠদান মোটামুটি নিয়মিত হচ্ছে। এমন কি, আমাদের কাজের বুয়ার মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করে কোন এক কলেজে অনলাইনে ক্লাস করছে। তবে, আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে টেলিভিশনে ও বেতারে শিক্ষক পাঠদান করলে, সেই পাঠগুলো একসঙ্গে একদল ছাত্র-ছাত্রী খাতা, কলম, বই নিয়ে শুনে, দেখে নিজেদের খাতায় নোট করে নিতে পারে। এতে কোন বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক পড়াচ্ছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে পাঠ সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী না হয়েও অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও সমানভাবে গ্রহণ করতে পারে। আশপাশে একটি টিভি ও রেডিও থাকলেই এটি সম্ভব হবে। বিটিভির সংসদ চ্যানেল এ কাজে ব্যবহার করা হবে সবচাইতে উত্তম ও সহজ পন্থা। বেতারেও নির্দিষ্ট সময়ে সহজ বিষয়গুলোর ওপর পাঠদান করতে পারেন নির্দিষ্ট শিক্ষক। দূর শিক্ষণের এই ব্যবস্থাগুলোকে আরও উন্নত ও কার্যকর করা সম্ভব। ‘মোহনা’ টিভির কয়েকটি পাঠ দেখে শিক্ষক-শিক্ষিকার মান খুব ভাল মনে হলো। সম্প্রতি দেখলাম দ্বাদশ শ্রেণীর এইচএসসি পরীক্ষার আগের স্কুল বা কলেজ কর্তৃক গৃহীত টেস্ট পরীক্ষার ফলকে বিশেষজ্ঞ কমিটি নানা দোষে দুষ্ট হিসেবে অগ্রহণযোগ্য গণ্য করেছেন। আমাদের দেশে একটি দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারণা চালু আছে যে, স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসএসসি ফাইনাল পরীক্ষা গ্রহণের স্বাধীনতা দিলে স্কুলগুলো তাদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীকে অনেক বেশি নম্বর দিয়ে পাস করিয়ে স্কুলের খ্যাতি-সুনাম বাড়ানোর কাজ করবে। এই চিন্তা-ধারণা যে অমূলক, তা নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিক্ষকেরাই শিক্ষার্থীদের মান যাচাই করেন এবং প্রত্যেক শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার ফল তারাই দেন এবং দীর্ঘ দশ বছর শিক্ষার্থীদের মান তারাই, স্ব স্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই যাচাই করেন। দশ বছর নিজ শিক্ষার্থীদের মান যাচাই করতে পারলে দশ বছর পরের পাবলিক পরীক্ষার বদলে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার মান যাচাই এর জন্য অনুপযুক্ত গণ্য করা কি ঠিক? প্রত্যেক স্কুলের শিক্ষকেরা যদি স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বেশি নম্বর দেয়, তাহলে এ কাজটি ধরে নেয়া যায়, সব স্কুলের শিক্ষকেরাই করবে। অর্থাৎ, প্রথম কয়েক বছর স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় সব স্কুলের সব শিক্ষার্থী বেশি বেশি নম্বর পাবে। সম্ভবত এ ধারাটি ধীরে ধীরে কমে আসত এবং একসময় সব স্কুল একটি যৌক্তিক অবস্থানে আসত। এটি খুব দ্রুত ঘটত, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাগুলো চালু থাকে। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মান ধরা পরে। বুয়েট, মেডিকেলে ভর্তিতেও এ মানটি যাচাই হয়। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অহেতুক অযৌক্তিক বেশি নম্বর দেয়ার কারণে বরং লজ্জিত হন, হবেন। বিশ্ববিদ্যালয় বা গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হতে পারাটাই তো শিক্ষার্থীদের এবং তাদের শিক্ষকদের জন্য চ্যালেঞ্জ। এ জন্য এন্ট্রি পরীক্ষাগুলো হতে হবে কঠোরভাবে স্বচ্ছ এবং নকল-দুর্নীতি-মুক্ত। তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে এটি করা সম্ভব। বর্তমানে যে স্কুলের পাঁচ বছর পর একবার, আবার আট বছর পর আরেকটি, মোট যে দুটি পাবলিক পরীক্ষা চালু রয়েছে, তাতে জিপিএ-৫, গোল্ডেন জিপিএ- এসব প্রাপ্তি অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের কাছে অনেক বড় হয়ে উঠেছে, যা প্রকৃত মান যাচ্ইা করতে পারে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন না। কেননা, দেখা গেছে এদের অনেকে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারে না। তখন প্রশ্ন ওঠে, জিপিএ-৫ এর প্রকৃত মান কি? স্কুল, শিক্ষক, শিক্ষার্থীÑ সবাইকে এ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। জানলাম, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। এটি হলে একটা সমস্যার সমাধান হবে। তবে, শিক্ষার্থীরা এসএসসির ফল, স্কোর, গ্রেড পয়েন্ট পেয়েছে, এইচএসসি পরীক্ষা হতে না পারার জন্য স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীর শেষ পরীক্ষার নম্বর, গ্রেড-পয়েন্টই বিবেচনা যোগ্য বলে মনে হয়। তবু, অন্যান্য দেশে এ সমস্যা কিভাবে সমাধান করা হচ্ছে, এটি জানা একান্ত দরকার। ভারত, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাজ্য- এ সমস্যার সমাধান কিভাবে করছে, তা আমাদের পথ দেখাতে পারে। অন্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে সমাধান গ্রহণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থেরই দরকার। লেখক : শিক্ষাবিদ
×