ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধনের উদ্যোগ: স্বাধীনতা হারাবে বিটিআরসি

প্রকাশিত: ২০:০৬, ২১ অক্টোবর ২০২০

টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধনের উদ্যোগ: স্বাধীনতা হারাবে বিটিআরসি

অনলাইন রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। আইনের খসড়ায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বিষয়ে বিদ্যমান ‘একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা’ শব্দগুলোর পরিবর্তে লেখা হয়েছে ‘সরকারের একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা’। ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’ শব্দ দুটি বাদ দিয়ে লেখা হয়েছে ‘সরকারের একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’। এতে স্বাধীন কমিশন বিটিআরসি তার স্বাধীনতা হারাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিটিআরসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আশঙ্কা করছেন, আইন সংশোধনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হতে পারে। অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে বিটিআরসি। এ খাতে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও এক ধরনের অস্বস্তিতে রয়েছে। তাদের আশঙ্কা, আইন সংশোধন হলে তাদের বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। টেলিযোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এভাবে কর্তৃত্ব বদলের জন্য আইন সংশোধন টেলিযোগাযোগ খাতে সুফল বয়ে আনবে না বরং নতুন সীমাবদ্ধতা তৈরি করতে পারে। ২০০১ সালে প্রণীত টেলিযোগাযোগ আইনে বিটিআরসিকে একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সে অনুযায়ী বিটিআরসি সরকারের অধীন হলেও একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১০ সালে এ আইনটি সংশোধন করে বিটিআরসির সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক ক্ষমতা খর্ব করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এবার আইন সংশোধনের জন্য যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে সেখানে আইন থেকে ‘স্বাধীন কমিশন’ শব্দটি তুলে দিয়ে ‘কমিশন’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়ায় বিদ্যমান আইনে ‘একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘সরকারের একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা’ শব্দগুচ্ছ প্রতিস্থাপনের কথা বলা হয়েছে। ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’ শব্দ দুটি বাদ দিয়ে লেখা হয়েছে ‘সরকারের একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’। বিদ্যমান আইনের ২১ ধারায় টেলিযোগাযোগ খাত থেকে আয় বিটিআরসির নিজস্ব তহবিলে জমা রাখার বিধান আছে। সেটি সংশোধন করে সরকারি কোষাগারে জমা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া আইনের ১২ ধারায় সংশোধন এনে বলা হচ্ছে, কোনো কমিশনার পদে বহাল থাকার অযোগ্য বিবেচিত হলে তার সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারবে। ২০০১ সালের আইনে এবং ২০১০ সালের সংশোধিত আইনে কমিশনারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের এক বা একাধিক বিচারক সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের বিধান ছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন সংশোধন প্রস্তাবে বিটিআরসির কমিশনের অপসারণের জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে সরাসরি ন্যস্ত করা হচ্ছে। এতে কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হবে। আইনের ১৮ ধারায় সংশোধন এনে লোক নিয়োগ থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের কমিশনের বিভিন্ন পদে প্রেষণে নিয়োগের সুযোগও বিস্তৃত করা হয়েছে। নতুন আইনের খসড়ায় আইনটির প্রয়োগ অংশে নতুন একটি উপধারা সংযুক্ত করে তাতে বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে থেকে এদেশের কোনো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বা যন্ত্রপাতি বা বেতার ব্যবস্থার সাহায্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে তাহলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ আইন এমনভাবে প্রয়োগ করা যাবে যে, অপরাধটি বাংলাদেশের ভেতরেই সংঘটিত হয়েছে। টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন নিয়ে খোদ বিটিআরসির ভেতরেই অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিটিআরসির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেভাবে আইন সংশোধনের কথা বলা হয়েছে তা চূড়ান্ত হলে আক্ষরিক অর্থে বিটিআরসির চরিত্র আর ‘কমিশন’ থাকবে না। এমনকি অধিদফতর নয়, এটা মন্ত্রণালয়ের একটা অনুবিভাগে পরিণত হবে। এ কারণে বিটিআরসির কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, ১৯৯৮ সালে প্রণীত টেলিযোগাযোগ পলিসিতে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের অধিকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিলো। পরবর্তীতে ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০০২ সালে বিটিআরসি একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে তার কার্যক্রম শুরু করে। ২০০২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত এ খাত কতটা এগিয়েছে, তা সবাই জানেন। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের যে আত্মবিশ্বাস, তার মূলশক্তি হিসেবে কাজ করছে বিটিআরসি। বিটিআরসির সুশৃঙ্খল ও দূরদর্শী নীতিমালা, গাইডলাইন, অপারেশন এবং নিয়মিত মনিটরিং এর ফলেই আজকে এই খাত এত পরিনত। বিগত ১৮ বছরে বিটিআরসির সফল রেগুলেশনের ফলে সরকারি কোষাগারে ৬০ হাজার কোটির অধিক রাজস্ব জমা হয়েছে। তিনি বলেন, সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের ব্যাখ্যায় বলা আছে, ‘রাষ্ট্র’ বলিতে সংসদ, সরকার ও সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষ অন্তর্ভুক্ত; আর সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষ অর্থ যেকোনো কর্তৃপক্ষ, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, যাহার কার্যাবলী বা প্রধান প্রধান কার্য কোন আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ বা বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন চুক্তিপত্র-দ্বারা অর্পিত হয়। বিটিআরসি একটি সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থা। কোন সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে তার উন্নয়ন হবে না। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধিনস্থ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থার সাথে কমিশনের উন্নয়নকে পর্যালোচনা করলেই তা বোঝা যায়। তিনি আরো বলেন, টেলিযোগাযোগ হচ্ছে একটি কারিগরি বিষয়। এটা পরিচালনায় ও রেগুলেটরি কার্যক্রম এ দক্ষ ও কারিগরি কর্মকর্তা প্রয়োজন। বিগত বছরগুলোতে কমিশনের লোকজন এ ব্যাপারে ব্যাপক দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। আমি মনে করি, দক্ষ লোকদের হাতেই কারিগরি বিষয়গুলো থাকা উচিত। আর সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে যদি আপনি বিলম্বিত করেন, তাহলে মানুষ বিরক্ত হয়। কমিশন হবে একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার। সব বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে গেলে বা যদি অনুমোদনে একাধিক ধাপ পার হতে হয় তাহলে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা হতে পারে। বিটিআরসির চেয়ারম্যান আরো বলেন, আমি মনে করি বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের যুগে আইন সংশোধন হলে ২০২০ এবং পরবর্তী সময়ের কথা বিবেচনা করে প্রযুক্তি পরিবর্তন এবং তার সঙ্গে প্রজন্মের চাহিদার সমন্বয় করে আইনে পরিবর্তন আসতে পারে। বর্তমান আইনে কোনো দুর্বল দিক থাকলে তাও সময়ের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সময়ের প্রয়োজনেই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আইন সংশোধন হলে বিটিআরসি ধ্বংস হবে না বরং আরো স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে পারবে। এ আইনের সংশোধনের উদ্যোগ একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এখনও বহু প্রক্রিয়া বাকি। এমনকি মন্ত্রণালয়েও আইনটি আসেনি। অতএব, এ আইন নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতে যে নীতিমালা নেয়া হয়, দেখা যায় কিছুদিন পর সেগুলো আর বাস্তবায়ন হয় না। উল্টো এমন সিদ্ধান্ত চাপানো হয়, যেগুলো কার্যত নীতিমালার বিরুদ্ধে যায়। এ অবস্থায় আইনের সংশোধন এবং বিটিআরসির কার্যক্রমে বড় পরিবর্তন এলে সেটা মোবাইল খাতের অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে দেবে।
×