ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফুটবল রেফারি সালমার দিনকাল

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ২১ অক্টোবর ২০২০

ফুটবল রেফারি সালমার দিনকাল

* একটি স্মরণীয় তারিখ : তারিখটা নিঃসন্দেহে কোনদিনই ভুলবেন না মনি। ১৬ অক্টোবর, শুক্রবার, ২০২০। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ফিফা রেফারি পদে উত্তীর্ণ হওয়ার ‘অগ্নি’পরীক্ষা। ফিটনেস টেস্ট। পুরুষ ও নারী মিলিয়ে বেশ কজন পরীক্ষার্থী। তাদেরই একজন মনি। অনেক আশা, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর পরীক্ষা খুব ভালমতোই পাস করেন মনি। ফলে তারিখটা তার হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। * বয়স নিয়ে শঙ্কা-সমস্যা ॥ পরীক্ষায় খুব ভালভাবে পাশ করেও খুব একটা স্বস্তিতে নেই মনি। কেন? জনকণ্ঠকে মনি বলেন, ‘গতবারও (২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট) একই ভেন্যুতে একই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। সেবার পাসও করেছিলাম। কিন্তু বাঁধ সেধেছিল কম বয়স! ফিফা সহকারী রেফারি হতে যে মিনিয়াম বয়স থাকতে হয়, তার চেয়েও এক বছর কম ছিল আমার! এবারও পাস করলেও সেই একই সমস্যায় পড়েছি। এবারও বয়সের ঘাটতি আছে। তবে সেটা মাত্র এক দিনের! আমার জন্ম ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বয়সের সময়সীমা থাকতে হয়। * আশার ক্ষীণ আলো প্রজ¦লিত ॥ বয়সের ঘাটতির গ্যাঁড়াকলে পড়লেও ক্ষীণ একটি আশার আলো ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন মনি। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ‘যারা আমার পরীক্ষা নিয়েছিলেন, তারা আমাকে আশ^াস দিয়েছেনÑ বিষয়টা তারা দেখবেন। আমার বয়সের বিষয়টা বিবেচনা করতে তারা ফিফার কাছে সুপারিশ করবেন। তাই আশায় বুক বাঁধছি।’ উল্লেখ্য, মনিসহ সব রেফারিদের পরীক্ষা নিয়েছিলেন ইব্রাহীম নেসার, আজাদ রহমান, সুজিত চন্দন ব্যানার্জি, তৈয়ব হাসান, এম আর মুকুল, শহীদুল ইসলাম লাবু এবং আমানত হালদার। মনি আরও বলেন, ‘কিছু পত্রিকা ও অনলাইন ইতোমধ্যেই আমাকে বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী সহকারী রেফারি হিসেবে নিউজ করে দিয়েছে। এটা আসলে ঠিক হয়নি। কারণ অফিসিয়ালি আমি এখনও ফিফা সহকারী রেফারি হইনি। তাই নিজেকে সেটা দাবিও করা উচিত নয়। ফিফা থেকে এই পরীক্ষার চূড়ান্ত এপ্রুভাল আসতে (আমিসহ সব পরীক্ষার্থীর) মাসখানেক লাগতে পারে। তখন বোঝা যাকে কি হয়েছে। * কেমন ছিল ফিটনেস পরীক্ষা ॥ ২৬/২৭ মিনিটে মাঠে ১০ চক্কর (ল্যাপ) দেয়ার পরীক্ষা দিতে হয়েছে মনিদের। তিনি ওই সময়ের মধ্যে পুরো চক্কর তো দিয়েছেনই, বরং আরও বেশি ৫ বার চক্কর দিয়েছেন। মানে প্রায় ৩৯ মিনিটে দিয়েছেন ১৫ চক্কর! তাহলে বুঝতেই পারছেন মনি কতটা ফিট! * যেমন ছিল পরীক্ষার প্রস্তুতি ॥ এই ফিটনেস টেস্টে পাশ করার জন্য তিন মাস অনুশীলন করেছেন মনি। সেটা জিমনেশিয়াম, বাসায়, এলাকার ফাঁকা রাস্তায় এবং সপ্তাহে দুদিন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। তার লক্ষ্য, ধ্যান-জ্ঞান ছিল একটাইÑ পরীক্ষায় পাস করতেই হবে। * কতটা আত্মবিশ^াস ছিল ॥ ‘অনেক কনফিডেন্স ছিল। যতটা আশা করেছিলাম, রেজাল্ট তার চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে।’ ফোনের ওপাশ থেকে বেশ উচ্ছ্বসিত শোনালো মনির কণ্ঠ। * পাস করার পরের মুহূর্তটা কেমন ছিল ॥ ‘সত্যি বলতে কি, আসলে গত বছরই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এবং পাস করে বেশি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। অথচ তখন বয়স কম থাকার বিষয়টা একদমই জানতাম না! এমনকি যারা পরীক্ষক ছিলেন, তারাও এটা খেয়াল করেননি। তাই পাস করেও ফিফা সহকারী রেফারি না হতে পেরে মিশ্র অনুভূতি হয়েছিল। সেই তুলনায় এবার আমি বেশ নিয়ন্ত্রিত এবং শান্তই ছিলাম।’ মনির ভাষ্য। * কেমন ছিল প্রিয়জনদের প্রতিক্রিয়া ॥ ‘পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মীরা আমার এই ফলাফলে অনেক খুশি হয়েছে। আমার চেয়েও বেশি।’ মনির জবাব। * যার অবদান অনস্বীকার্য ॥ রেফারি মাহমুদ জামাল ফারুকী নাহিদ ভাইয়ের কাছে মনির কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, ‘তার কাছে আমি অনেক ঋণী। তিনি আমাকে প্রতিনিয়ত পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি আমার প্র্যাকটিস শিডিউলও তিনিই তৈরি করে দিয়েছিলেন।’ * যার কারণে রেফারিংয়ে ॥ নেত্রকোনা সদরের মেয়ে মনি। তার বড় ভাই শফিকুল ইসলাম। তিনি জেলা পর্যায়ের সাবেক ফুটবলার। বর্তমানে প্রথম শ্রেণীর রেফারি। তার সঙ্গেই রেফারি ক্যারিয়ার শুরু করেন মনি। এর আগে মনি ফুটবল খেলেছেন নেত্রকোনা আন্তঃস্কুল ও জেলা ফুটবলে। খেলতেন সেন্টার ব্যাক পজিশনে। তবে নেত্রকোনার আরেক রেফারি ফেরদৌস আহমেদই (সাবেক ফিফা রেফারি) ছিলেন মনির রেফারিংয়ে আসার অনুপ্রেরণা। তিনি মনির গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশীও ছিলেন। ২০১২ সালে রেফারিংয়ের ভুবনে পা বাড়ান মনি। রেফারি হওয়ার পথে ধাপে ধাপে ক্লাস-৩, ২ ও ১ কোর্স, জাতীয় ও ফিফা রেফারিং টেস্টে উত্তীর্ণ হন তিনি। * রেফারি হতে যা লাগবে ॥ এখন আপাতত সহকারী রেফারি হিসেবেই কাজ করছেন মনি। স্বপ্ন দেখেন একদিন তিনি প্রধান রেফারি হবেন। এক্ষেত্রে তার পথের বাধা তার নিজেরই বয়স। মানে ফিফার নিয়ম অনুযায়ী ২৫ বছরের আগে কেউ রেফারি হতে পারেন না। ফলে আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে তাকে। সেই সঙ্গে এবারের মতোই আবারও সেই ফিটনেস টেস্ট দিয়ে পাস করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মনির ভাষ্য, ‘অনেকেই হয়তো জানেন না, একবার ফিফা রেফারি হয়ে যাওয়া মানে কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তাকে প্রতিবছরই এভাবে ফিটনেস টেস্টে অংশ নিয়ে পাস করতে হবে। রেফারি হওয়ার পর সেই পদটা ধরে রাখাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কাজেই এত খুশি হওয়ার কিছু নেই।’ * যেসব দেশী-বিদেশী আসরে রেফারিং করার অভিজ্ঞতা ॥ বাংলাদেশে জেএফএ কাপ, পাইওনিয়ার লীগ, মহিলা ফুটবল লীগ, বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক স্কুল ফুটবল, বঙ্গমাতা অ-১৯ আস্তর্জাতিক নারী চ্যাম্পিয়নশিপ, সাফ অ-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ; বিদেশে ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কায় এএফসি অ-১৩ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৫ সালে নেপালে এএফসি অ-১৪ নারী আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৮ সালে ভুটানে এএফসি অ-১৬ মহিলা আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ ইত্যাদি। এসব আসরগুলোর খেলাগুলোতে মনি বেশিরভাগ সময়ই দায়িত্ব পালন করেন সহকারী রেফারি হিসেবে। সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ ম্যাচে কাজ করেছেন তিনি। * পরিবারের উৎসাহ যেমন ছিল ॥ তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মনিই সবার ছোট। আর দশটা পরিবারের মতো মনির পরিবার কখনই মনিকে খেলাধুলায় ও রেফারিং করাতে কোন বাধা দেয়নি। বরং দিয়েছে উৎসাহ ও সমর্থন। এজন্য নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেন মনি। * মনির খেলোয়াড়ী জীবন : স্কুলে পড়ার সময় এ্যাথলেট ছিলেন মনি। ছিলেন হাই জাম্পার। জাতীয় শিশু এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় হাই জাম্পে তা¤্রপদক, জাতীয় জুনিয়র এ্যাথলেটিক্সে ২০১৩ সালে নেত্রকোনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে লং জাম্পে অর্জন করেছিলেন তা¤্রপদক। হ্যান্ডবলও খেলেছেন মনি। জাতীয় জুনিয়র হ্যান্ডবলে বিজেএমসির হয়ে অ-১৬ নারী হ্যান্ডবল দলের ক্যাম্পে ডাকও পেয়েছিলেন। অ-১৬ জাতীয় হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিভাগের হয়ে খেলে তার দল তৃতীয় হয়েছিল। কাবাডিতেও পারঙ্গম মনি অ-১৬ জাতীয় নারী কাবাডি দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন। * পড়াশোনা ॥ ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে মানবিক বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে ¯œাতকে পড়ছেন মনি। * রেফারিংয়ে লক্ষ্য ॥ ‘আমি ভবিষ্যতে একজন ‘এলিট’ রেফারি হতে চাই। স্বপ্ন দেখি একজন দক্ষ ও সফল রেফারি হওয়ার, যেন ফুটবলপ্রেমীরা আমায় মনে রাখে।’ মনির অভিলাষ। * পারিশ্রমিক নিয়ে হতাশা ॥ বাংলাদেশের নারী রেফারিরা পারিশ্রমিক কেমন পান? প্রশ্নটা শুনে মনির বিষাদমাথা কণ্ঠ, ‘পারিশ্রমিক তেমন কিছুই না। আরও বেশি পাওয়া উচিত। আশা করি আগামীতে সবাই সেটা পাবে।’ ম্যাচপ্রতি পারিশ্রমিক নিয়ে একটা ধারণা দেন মনি। জেএফএ কাপে ৬০০, মহিলা লীগে ২০০০, বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধু ফুটবলে ১০০০ টাকা করে (শুরুতে পেতেন, এখন সেটা দ্বিগুণ হয়েছে)। আর এএফসির ম্যাচে ১০০ ডলার করে। * মনির প্রিয় ফুটবলার-রেফারিরা ॥ মনির প্রিয় ফুটবলাররা হচ্ছেন দেশে মামুনুল ইসলাম এবং সাবিনা খাতুন, বিদেশে আর্জেন্টিনা ও এফসি বার্সেলোনার লিওনেল মেসি। প্রিয় রেফারিরা হচ্ছেন, দেশেÑ মিজানুর রহমান, আজাদ রহমান, মাহমুদ জামাল ফারুকী নাহিদ, ফেরদৌস আহমেদ এবং বিদেশে ভারতের রঞ্জিতা দেবী।
×