ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আপোসহীনের আপোসকামিতায় সমালোচনা

লন্ডনে যেতে যে কোন শর্তে আপোসে রাজি খালেদা

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ২১ অক্টোবর ২০২০

লন্ডনে যেতে যে কোন শর্তে আপোসে রাজি খালেদা

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপির পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে আপোসহীন বলা হলেও বাস্তবে তিনি বার বারই আপোস করছেন। নিজের স্বার্থে আপোস করে তিনি এখন সমালোচনার মুখে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। তার এ ভূমিকার জন্য দলের একটি অংশ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ্যে কিছুই বলছে না। সূত্রমতে, রাজনৈতিক স্বার্থে অতীতেও খালেদা জিয়া আপোস করলেও তেমন সমালোচনার মুখে পড়েননি। তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা নিয়ে কারাগারে যাওয়ার পর সাময়িক মুক্তির জন্য তিনি বার বারই আপোস করেছেন। প্রথমে আপোস করে সাজার মেয়াদ ৬ মাসের জন্য স্থগিতের পর এ সময়ের জন্য সাময়িক মুক্তিলাভ করেছেন। এরপর আবারও ৬ মাসের মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছেন। এখন আবারও আপোস করে চিকিৎসার জন্য লন্ডন যেতে চাচ্ছেন। কারাবন্দী থাকা অবস্থায় আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্তি বা জামিনের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তার একগুয়ে মনোভাব পরিবর্তন করে সরকারের সঙ্গে আপোস করার চেষ্টা করেন। এ চেষ্টায় তাকে সহযোগিতা করেন স্বজনরা। বিএনপি নেতাদের একটি অংশ খালেদা জিয়ার এভাবে আপোস করে মুক্তির বিষয়টি ভালভাবে না নেয়ায় তিনি স্বজনদের কাজে লাগান। জানা যায়. স্বজনদের মাধ্যমে আবারও আপোস করেই চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করবেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে গুঞ্জন। তবে আবেদন মঞ্জুর করার আগে বিদেশে গিয়েও রাজনীতি করবেন না এবং বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে এমন আশ্বাস দিতে হবে বলে আপোস করার দায়িত্বে নিয়োজিত স্বজনদের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। সূত্রমতে, চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়া এখন যে কোন শর্তে আপোস করতেও রাজি আছেন। আদালতে শাস্তি পাওয়া খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে দলের পদ ছাড়ার শর্ত আসতে পারে এমন আভাস পাওয়ার পরও তিনি আপোস করে লন্ডনে যেতে রাজি আছেন বলে জানা যায়। খালেদা জিয়ার স্বজনরা দীর্ঘদিন ধরেই তাকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আগে তিনি দেশের বাইরে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে তিনি আপোস করেই সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। এ পরিস্থিতিতে দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর ২৫ মার্চ স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার নির্বাহী আদেশে তাকে ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেয়ার পর গুলশানের বাসায় অবস্থান করেন তিনি। স্বজনদের চেষ্টায় একইভাবে আবারও ৬ মাসের জন্য মুক্তি পান তিনি। নিয়মিত বাসায় গিয়ে স্বজনরা তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। বিদেশে চিকিৎসার বিষয় নিয়েও তারা কথা বলেন। এক পর্যায়ে তারা খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার প্রস্তাব দিলে তিনি আপোস করেই এ সুযোগ নেয়ার পক্ষে মত দেন। খালেদা জিয়া বিদেশে গিয়ে চিকিৎসার বিষয়ে আপোস করতে রাজি হওয়ার পর তার স্বজনরা আবারও তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেন। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ দ্বিতীয় দফায় বাড়ানোর কথা জানানো হয়। কিন্তু প্রথম দফার মতো দ্বিতীয় দফায়ও বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং বিদেশে যাওয়া যাবেনা- এই দুই শর্তে তার সাজার মেয়াদ ৬ মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। স্বজনরা মনে করেছিলেন, খালেদা জিয়াকে দ্বিতীয় দফায় কমপক্ষে এক বছরের জন্য মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হবে। তবে স্বজনরা বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যেতে হলে নিজের স্বাক্ষর করা একটি আবেদন করতে হবে প্রধানমন্ত্রী বরাবর। প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিলে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া সম্ভব। এ বিষয়টি খালেদা জিয়াকে জানানোর পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে রাজি হন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য সুযোগ চেয়ে আবেদনের বিষয়ে বিভিন্ন মহলের কাছে খোঁজখবর নেন তার স্বজনরা। তখন তাদের বিভিন্ন মহল থেকে জানানো হয় কিছু বিষয়ে সরকারের সঙ্গে খালেদা জিয়াকে আপোস করতে হবে। খালেদা জিয়াও এসব বিষয়ে আপোস করতে রাজি হন। জানা যায়, চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার সুযোগ নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়া আবেদনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তবে আবেদন করলেই বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাবেন এমন আশ্বাস এখনও পুরোপুরি পাননি। আশ্বাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করবেন। আর এ বিষয়ে তার স্বজনরাই দৌড়ঝাঁপ করে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। যে কোন দিন স্বজনরা খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আবেদন করতে পারেন বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করার পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন মহলকে আশ্বস্ত করতে হবে তিনি বিদেশে গিয়েও রাজনীতি করবেন না এবং বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবেন। এ ছাড়া আদালতে শাস্তি পাওয়া খালেদা জিয়া ও তার লন্ডন প্রবাসী ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দলের পদ ছাড়ার শর্তও আসতে পারে। তাই এভাবে কঠোর শর্ত মেনে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে দলের একটি অংশ নারাজ। যদিও দলের অপর অংশটির খালেদা জিয়ার যে কোনভাবে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার বিষয়ে কোন আপত্তি নেই। খালেদা জিয়া বিদেশে গিয়ে চিকিৎসার বিষয়ে সম্মত হওয়ার পর থেকেই লন্ডনে তার ছেলে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডাঃ জোবায়দা রহমান যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। কোথায় চিকিৎসা নেবেন এবং বাসায় তার আরামে থাকার জন্য কি কি দরকার সে ব্যবস্থাও করে রাখা হচ্ছে। খালেদা জিয়া কবে যাবেন সেজন্য লন্ডনে অন্য স্বজনরাও অপেক্ষা করছেন । এ বিষয়ে বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কখনও কখনও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে সুযোগ নিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। এ কৌশল শুধু বিএনপি নয় অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও নিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তাই সুচিকিৎসার জন্য স্বজনদের চেষ্টায় তিনি সাময়িক মুক্তির সুযোগ নিয়েছেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে তিনি উন্নত চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারেননি। তাই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এখন ভাল নয়। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়া প্রয়োজন। সরকার সুযোগ দিলে তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন। তবে এ সুযোগ পাওয়ার জন্য খালেদা জিয়ার স্বজনরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছেন। ২৫ মার্চ প্রথম দফায় খালেদা জিয়ার মুক্তির সময় তার স্বজনরা যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রয়োজনে আবারও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়ার লেখা আবেদন পৌঁছে দেবেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় দফায় ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে আরও ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেয়ায় খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হবে। তবে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বিএনপির কোন নেতা বা খালেদা জিয়ার স্বজনরা এখনও কিছু বলছেন না। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সরাসরি আবেদন করলে অসুস্থতা ও মানবিক বিবেচনায় তাকে বিদেশ যেতে দিতে সরকারের হাইকমান্ডের মনোভাব ইতিবাচক। খালেদা জিয়ার স্বজনরা নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এমন আশ্বাস পেয়েছেন।
×