ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তিস্তার দ্রুত সমাধানের পথে ভারত

প্রকাশিত: ২২:৫২, ২১ অক্টোবর ২০২০

তিস্তার দ্রুত সমাধানের পথে ভারত

তপন বিশ্বাস ॥ দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ। করোনা পরিস্থিতিতে চীন-ভারত বৈরী সম্পর্কের মধ্যে পাকিস্তানের হুঙ্কার এবং নেপালের ভারতবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হওয়ায় ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়েছে। এতে দ্রুত তিস্তার পানি বণ্টন, দু’দেশের বাণিজ্য সহজীকরণ, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি বিষয়ে সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত। বাংলাদেশও চায় দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হোক। এ লক্ষ্যে ভারত হাইকমিশনার হিসেবে বাংলাদেশে নিয়োগ দিয়েছে বিক্রম দোরাইস্বামীকে। দায়িত্ব নেয়ার পর ভারতীয় নতুন হাইকমিশনার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে চলেছেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার বাংলাদেশে আকস্মিক সফর এবং আগামী বছরের প্রথমদিকে (মার্চে) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের ঘোষণাই বলে দিচ্ছে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব কত বেশি। পাশাপাশি চীন, পাকিস্তানও বাংলাদেশকে পাশে চাচ্ছে। সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। গুরুত্ব বাড়লেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আগের মতোই রয়েছে। বরং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হতে যাচ্ছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সব সময় ভাল। ক্রমান্বয়ে এটি আরও উন্নতি হচ্ছে এবং হবে। দুই দেশের সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে তিনি বলেন, কিছুদিন আগেই বিজিবি ও বিএসএফ বৈঠক করেছে। আশা করি, অল্পদিনেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে। দক্ষিণ এশীয়ায় ভারত ও চীন দুই পরাশক্তি। দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা অনেক পুরনো। এরই মধ্যে দুই দেশ একাধিকবার যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সার্বিক সহযোগিতা করেছিল। এই সময় চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। এর পর চীন-ভারত সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হলেও বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে চলছিল দুই দেশের সম্পর্ক। করোনার পর চীনের আগ্রাসী ভূমিকায় দু’দেশের সম্পর্ক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে। এর আগে ভারতের কিছু অংশ নিজেদের অংশে দেখিয়ে নেপাল নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে। পাশাপাশি পাকিস্তান নানা অজুহাতে যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। এদিকে চীনও চাইছে বাংলাদেশকে কাছে টানতে। এ লক্ষ্যে চীন বাংলাদেশকে নানাবিধ সুযোগ দিচ্ছে বা দেয়ার আশ্বাস দিচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত নতুন করে ভাবছে। দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সব কিছু নিজেদের অনুকূলে রাখতে ভারত তাদের তুখোড় কূটনীতিক বিক্রম দোরাইস্বামীকে বাংলাদেশে এনেছে। সূত্র জানায়, দ্রুততম সময়ে তিনি তিস্তা প্রকল্পের জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ নেবেনে। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে টানাপোড়েন দীর্ঘদিনের। এটি সমাধান হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। এছাড়া দু’দেশের বাণিজ্য সহজীকরণের বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। বিক্রম দোরাইস্বামী যোগদানের পর সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যে যোগদানের পর ভারতীয় নতুন হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী তিস্তা প্রকল্পের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন দাবি করে আসছে। দফয় দফায় বৈঠক করেও এটি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া নোম্যান্সল্যান্ডের বন্ধ বাজার দ্রুত চালু করা, করোনা ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহযোগিতা প্রদানের বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করছেন নতুন হাইকমিশনার। বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ায় গত আগস্টে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির কারণে মানুষ যখন ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে, সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও বৈঠকগুলো ‘অনলাইন’ মাধ্যমে চলছে, তখন আকস্মিক ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশ সফরে আসেন। আগে থেকে এই সফরের কোন পরিকল্পনা ছিল না বলে জানা যায়। আচমকাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত বার্তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিতে আসেন তিনি। দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার জন্যে এই সফর বলে জানানো হয়। সরকারীভাবে বলা হয়, দুই দেশের যেগুলো যৌথ উৎসাহের জায়গা, সেগুলোতে বোঝাপড়া বৃদ্ধি করার জন্য এই সফর। ১৮ ও ১৯ আগস্টের সফরে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর শেখ হাসিনা এটিই প্রথম কোন বিদেশী প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করলেন। এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গেও শ্রিংলার বৈঠক হয়। বৈঠকে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, করোনাভাইরাস টিকার প্রাপ্যতা, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা ও মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু, সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। যদিও সরকারীভাবে সবচেয়ে বেশি প্রচার করা হয়েছিল করোনা টিকার সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ভারতের সহযোগিতার বিষয়টি। এটাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু করোনা টিকাই যে এই সফরের মূল এজেন্ডা নয়, তা সবাই অনুমান করতে পারছেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরটি নানাদিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুটা চিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতে নাগরিকত্ব আইন বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জিকে নিয়ে দুদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়। রামমন্দিরের শিলান্যাস ঘিরেও ঘরোয়াভাবে কট্টরপন্থীদের সামনে বাংলাদেশ অস্বস্তিতে পড়ে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক, তা ঐতিহাসিক। এটাকে (মন্দির নির্মাণ) সেই সম্পর্কে আঘাত হানতে দেব না। তা-ও ভারতের কাছে অনুরোধ, এমন কিছু ঘটতে দেয়া যাবে না, যা দু’দেশের সুন্দর ও গভীর সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশকে ১০টি রেলইঞ্জিন দিয়েছে ভারত। কিন্তু একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ইঞ্জিনগুলো পুরনো। এমন অনেক ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ক্রমেই অপ্রীতিকর অবস্থায় নিয়ে যায়। এ ছাড়া অনেকবার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার ব্যাপারে ভারত আন্তরিকতা দেখায়নি। এটা নিয়েও বাংলাদেশের সঙ্গে মনোমালিন্য আছে। নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্য ঘাটতি ইত্যাদি সমস্যা তো রয়েছেই। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের আকস্মিক বাংলাদেশ সফরের মূল কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের ভূমিকা। সম্প্রতি ভারত ও চীনের তিক্ত সম্পর্কের আবহে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে চীন। লাদাখ নিয়ে চীন-ভারত উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখন বাংলাদেশ চীনে ৯৭ শতাংশ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবার ঘোষণা আসে। করোনাভাইরাসের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সঙ্গে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় আরও কাছাকাছি এসেছে চীন। ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি আটকে রয়েছে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার জলস্তর ধরে রাখার প্রকল্পে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চীন। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য নতুন করে অস্বস্তি তৈরি করেছে। তাই জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবেলাতে বাংলাদেশকে যত বেশি সম্ভব সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে ভারত। এতে করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করা সম্ভব বলে দেশটি মনে করছে। তবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পরদিন চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। যে কারণে চীনের চেয়ে ভারতকে কাছে রাখতে চায় বাংলাদেশ। এদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি হাসিনাকে ফোন করে করোনাভাইরাস ও বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ঢাকার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় ইসলামাবাদ। এটাও ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ। ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অনেক ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে। বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি সাফল্য পায়নি। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কথা দিয়েছিলেন, শীঘ্রই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এখনও তার সিকি ভাগও এগোয়নি। উল্লেখ্য, ২০১১ সালেই ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবল আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে তা ভেস্তে যায়।
×