ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই দেশের কারবারিরাই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে দুই দেশেই বছরের পর বছর অভিযান চলছে পাঁচ বছরে গ্রেফতার হয়েছে দেশী-বিদেশী পাঁচ শ’ কারবারি জামিন পেয়ে আবার জড়াচ্ছে এই কারবারে

দাপটেই জাল টাকা ॥ বাংলাদেশ-ভারত চুক্তির ৫ বছরেও দৌরাত্ম্য থামেনি

প্রকাশিত: ২২:৫০, ২১ অক্টোবর ২০২০

দাপটেই জাল টাকা ॥ বাংলাদেশ-ভারত চুক্তির ৫ বছরেও দৌরাত্ম্য থামেনি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তির পাঁচ বছর পরও দাপট কমেনি জাল টাকার। দেশের অর্থনীতির ক্যান্সার হিসেবে পরিচিত জাল টাকা নিয়ন্ত্রণে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন হয়েছিল। দুই দেশের কারাবারিই এই জাল টাকা তৈরি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। চুক্তি সম্পাদনের পর অনেক যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অভিযান চলেছে মাসের পর মাস। গ্রেফতার হয়েছে দুই দেশের শ’ শ’ অপরাধী। এর পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না জাল টাকার আধিপত্য। করোনা পরিস্থিতি ও সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবের সুযোগে আবারও সক্রিয় এই চক্র। এমন তথ্যের ভিত্তিতে দুই দেশেই জাল টাকা নির্মূলে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। তেমনই এক অভিযানে ঢাকা থেকে অর্ধকোটি টাকার জাল নোট ও তিন সহযোগীসহ সাতবারের মতো গ্রেফতার হয়েছে আন্তর্জাতিক জাল টাকার কারবারি হুমায়ুন কবির। চক্রটি ভারতীয় জাল রুপী তৈরি করত। গ্রেফতারদের কাছ থেকে জাল টাকা তৈরির সব ধরনের সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। উদ্ধার করা সরঞ্জাম দিয়ে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের জাল নোট তৈরি সম্ভব ছিল। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল জানান, ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরমধ্যে ১৪ নম্বর চুক্তিটি হয় মাদক চোরাচালান ও জাল টাকা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে। ওই চুক্তি হওয়ার পর থেকেই দুই দেশেই জাল টাকার কারবারিদের ধরতে পারস্পরিক যোগাযোগ ও কম্বিং অপারেশন চলমান আছে। এ সংক্রান্ত তথ্য দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত আদান-প্রদান হচ্ছে। সিআইডির এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, নতুন করে সেই চুক্তির বিষয়ে ভারতের তরফ থেকে এবং বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাইকমিশন, দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পক্ষ থেকে তাগাদা এসেছে। গত বছর ভারতের দেয়া তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে কম করে হলেও ২০টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। আবার বাংলাদেশের দেয়া তথ্য মোতাবেক ভারতেও জাল টাকা কারবারিদের গ্রেফতারে বহু কম্বিং অভিযান পরিচালনা করেছে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সূত্রটি বলছে, জাল টাকার আগ্রাসন কমাতে পাকিস্তানীদের বাংলাদেশে যাতায়াতের ওপর বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে জাল টাকায় পাকিস্তানী গ্রেফতারসহ নানা ইস্যুতে সরকারের তরফ থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদ- দুর্বল করে দিতে পাকিস্তানের কোন সংস্থা পরিকল্পিতভাবে জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ আছে। জাল টাকা ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মোতাবেক আগাম অভিযান চালানো অব্যাহত আছে বলে জানান র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ। তিনি আরও জানান, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী দুই হাজারের বেশি জাল টাকা কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলামের দেয়া তথ্য মোতাবেক, গত কয়েক বছরে অন্তত সাড়ে ৫শ’ দেশী-বিদেশী জাল টাকা কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। যার মধ্যে অন্তত সাড়ে ৪শ’ বিদেশী। এদের অধিকাংশই আফ্রিকান। উদ্ধার হয়েছে দেশী-বিদেশী বিপুল অঙ্কের জাল টাকা এবং জাল টাকা তৈরির সরঞ্জাম। জাল টাকার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে কম্বিং অপারেশন অব্যাহত থাকবে। উদ্ধার হয়েছে প্রায় দশ কোটি জাল টাকা ও সমপরিমাণ জাল টাকা ছাপানোর সরঞ্জাম, অন্তত সাত কোটি টাকা সমমূল্যের জাল ভারতীয় রুপী, প্রায় পাঁচ লাখ ইউএস ডলারসহ বিভিন্ন দেশের জাল টাকা। জাল টাকা আইনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনের বিধান আছে। তারপরও চক্রের সদস্যরা এমন অপরাধ থেকে সরেনি। পুলিশ ও বিজিবি সদর দফতর সূত্রগুলো বলছে, জাল টাকা সংক্রান্ত ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার গ্রেফতার হয়েছে। প্রতিমাসে জাল টাকা সংক্রান্ত ঘটনায় গ্রেফতারের হার গড়ে ১০ থেকে ১২ জন। আগে মাসে গড়ে অন্তত ৬০ জন গ্রেফতার হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ থেকে হালনাগাদ জাল নোট সংক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মামলা হয়েছে। এরমধ্যে অধিকাংশ মামলাই ২০১৫ সালের আগে দায়ের করা । ২০১৫ সালের পর গত প্রায় ৫ বছরে মামলা হয়েছে প্রায় তিন শ’। জাল টাকার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়টি শাখার চার কর্মকর্তাসহ দশ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, চোরাচালানপ্রবণ স্থল সীমান্তে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেসব সীমান্ত পয়েন্টে জাল টাকা পাচার হয়, সেসব সীমান্ত ভারত সরকারের তরফ থেকে যে সময়ে চোরাচালান হয়, সেই সময়ে একপ্রকার সিল করে দেয়ারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এসব পয়েন্টে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীসহ (বিজিবি) সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীসহ (বিএসএফ) সেদেশটির সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই যৌথ টহল ও স্থায়ী চেকপোস্ট বসানোর প্রস্তাব রয়েছে। এসব পয়েন্টে নির্দিষ্ট সময়ের পর অনেকটা কার্ফ্যু জারির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে দুই দেশের মধ্যে। পাশাপাশি বিমানবন্দরে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের জাল ও অচল নোট প্রতিরোধ ও পর্যালোচনা কোষ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনাটি জারি করা হয়েছে। গত রবিবার অভিযান পরিচালনকারী ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রেফতার হুমায়ুন কবির এই চক্রের হোতা। সে পুলিশের হাতে সপ্তমবারের মতো গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারের পর এরা জামিন পেয়ে বের হয়ে যায় এবং আবার জাল টাকার কারবার শুরু করে। সে আন্তর্জাতিক জাল নোট কারবারি। সীমান্তে এবং সীমান্তের ওপারেও তার সিন্ডিকেট আছে। তার বাড়ি পটুয়াখালী। হুমায়ুন এবং গ্রেফতাকৃত আরেকজন জামাল ২০০৮ সালের দিকে নুরুল হুদা নামের এক কারিগরের কাছে জাল নোট তৈরির কৌশল শেখে। এরপর তারা নিজেরাই জাল নোট তৈরির কারখানা চালু করে। ডিলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে জামাল। তিনি আরও জানান, চক্রটি প্রতি লাখ জাল টাকা ১০/১২ হাজার টাকায় পাইকারি বিক্রি করে। পাইকারি বিক্রেতারা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তা বিক্রি করে ১৫/১৬ হাজার টাকায়। এরপর মাঠ পর্যায়ে প্রতি লাখ জাল টাকা ২৫/৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। মাঠ পর্যায়ের ক্রেতারা জাল টাকা দিয়ে বিভিন্ন দোকান থেকে মালামাল কেনে। সেগুলো তারা একসঙ্গে করে পাইকারি বিক্রি করে দেয়। এতে করে তাদের দুই দফায় লাভ হয়। পাঁচ শ’ টাকার একটি জালনোট দিয়ে তিন শ’ টাকার কেনাকাটা করলে বাকি দুই শ’ টাকাই লাভ। আর ক্রয় করা জিনিস বিক্রি করেও আসল টাকা পায়। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, চলমান মহামারী করোনাভাইরাসের সঙ্কট ও আসন্ন দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে তারা বেশি তৎপরতা শুরু করেছিল। তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করছিল। তাদের দেশের আটটি বিভাগে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে। এছাড়া চলতি বছরের গত ২৪ আগস্ট রাজধানীর পল্টন থানা এলাকা থেকে প্রায় ৬২ লাখ জাল টাকাসহ পাঁচ জনকেও গ্রেফতার করা হয়। মশিউর রহমান জানান, দেশে জাল নোট তৈরিকারকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তারা বারবার গ্রেফতার হয়। আর বারবার অদৃশ্য কারণে জামিন পেয়ে যায়। জামিন পাওয়ার পর তারা প্রথমেই ধর্মীয় লেবাস ধরে। দাঁড়ি, মাথায় টুিী, পাজামা-পাঞ্জাবি পরিধান শুরু করে। বেশ কিছুদিন আল্লাহর রাস্তায় সময় দেয়। এর পর যখন তারা তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি কমে গেছে বলে ধারণা করে, তখনই তারা আবার জালনোট তৈরি ও বাজারজাত করা শুরু করে। হুমায়ুন দেড় বছর আগে জেল থেকে বের হয়। তার ভাই কাওসারও জাল টাকার ব্যবসায়ী। কাওসার বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আছে। এর আগে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কদমতলী থানাধীন ৩৫/১ নম্বর বাড়ি থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার সমমূল্যের শুধু ভারতীয় জাল রুপী ও জাল রুপী তৈরির সরঞ্জামাদিসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের দলনেতা বশির উদ্দিন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের নামকরা আটটি দেশে ভাল চাকরি করেছে। দেশে ফিরেই শুধু জাল রুপী তৈরি ও সরবরাহের কাজ কেন শুরু করেছিল সে বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। এছাড়া চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ধানমণ্ডির ৭/ই ১০ নম্বর বাড়ির দুই রুম ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরি শুরু করেছিল গ্রেফতারকৃত তাসলিমা আক্তারের স্বামী সাইফুল ইসলাম। তার কাছে পাওয়া যায় কয়েক কোটি টাকার জাল নোট ও জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, রোজা, ঈদ বা সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবের মতো বড় উৎসব এলেই জাল নোট কারবারিদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন প্রয়োজনে আগাম অভিযান শুরু করে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক জাল টাকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংক বরাবর নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনায় ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে আসল নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংবলিত ভিডিওচিত্র প্রতিটি ব্যাংকের শাখায় ও রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। জনসমাগমস্থলে বা রাস্তার মোড়ে সন্ধ্যার পর এক ঘণ্টা এ ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে।
×