ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ছেঁড়া কাগজে লেখা মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে শনাক্ত মেহেদীর খুনীরা

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ২০ অক্টোবর ২০২০

ছেঁড়া কাগজে লেখা মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে শনাক্ত মেহেদীর খুনীরা

আজাদ সুলায়মান ॥ অপরাধীরা যতই দক্ষই হোক- ভুল তারা করেই। অপরাধের পর তারা কোন না কোন ক্লু রেখে যায়। সর্বশেষ গত পরশু হাতিরঝিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধারের পর আবারও সেটাই প্রমাণ হলো। একটি ছেঁড়া চিরকুটের সূত্র ধরেই ওই শিক্ষার্থী মেহেদীর খুনীদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় পুলিশ। অথচ হত্যার পর মেহেদীর মুখ ও আঙ্গুল বিকৃত করার পর লাশ গুম করেছিল খুনীরাÑ যাতে তাকে শনাক্ত করা না যায়। চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজিজুল ইসলাম মেহেদীর খুনীদের শনাক্তের পর পুলিশ জানায়- নাটকীয় কায়দায় এ হত্যার রহস্য উদঘাটন করা হয়। মেহেদীর লাশের কয়েক গজ দূরে পড়ে থাকা ছেঁড়া এক টুকরো কাগজে লেখা একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে খুনীদের পরিচয় নিশ্চিত করে পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতারকৃত তিনজন ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এ বিষয়ে সোমবার তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এটি একটি ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ড ছিল। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় যাতে শনাক্ত করা না যায় সেজন্য হাতের আঙ্গুল বিকৃত করার পাশাপাশি মুখমণ্ডলও বিকৃত করে খুনীরা। যেখানে লাশ ফেলেছিল সেখান থেকে ৫০ মিটার দূরে পাওয়া একটি ছেঁড়া কাগজে লেখা একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত চার আসামিকে গ্রেফতার ও সব আলামত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। এ ধরনের ক্লুলেস হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটনে পুলিশ আবারও পেশাগত দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। উল্লেখ্য, গত ১২ অক্টোবর রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় পরিচিত পাসপোর্ট দালালদের হাতে খুন হন আজিজুল ইসলাম মেহেদী। রাতে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যার পর মরদেহটি পলিথিন, মশারি ও বেডশিট পেঁচিয়ে ফেলে দেয়া হয় হাতিরঝিলে। লাশ গুম করার আগে খুনীরা তার মুখম-ল ও আঙ্গুল বিকৃত করে। যাতে খালি চোখে ও ফিঙ্গার প্রিন্টে তার পরিচয় শনাক্ত না হয়। কিন্তু একটি কাগজে লেখা ফোনের সূত্র ধরেই খুনীদের শনাক্ত করে পুলিশ। ১৩ অক্টোবর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে রাজধানীর খিলক্ষেত থানাধীন উত্তরপাড়া এলাকা থেকে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামি আহসান ও তামিম, হাতিরঝিল থানাধীন মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে আলাউদ্দিন এবং রামপুরা এলাকা থেকে রহিমকে গ্রেফতার করে। তাদের স্বীকারোক্তিতেই বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা রহস্য। জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী পিতার একমাত্র ছেলে আজিজুল ইসলাম মেহেদী। তারা বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার সন্দীপের বাউরিয়া গ্রামে। কয়েক বছর ধরে মাকে নিয়ে চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ এলাকায় থাকতেন তিনি। লেখাপড়া শেষ করে কানাডায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। লেখাপাড়ার পাশাপাশি পরিচিতজনদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিংয়ে সহায়তা করতেন মেহেদী। কিন্তু দুর্ভাগ্য দালালের মাধ্যমে পাসপোর্টের কাজ করতে ঢাকায় এসে খুন হন তিনি। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আহসান, আলাউদ্দিন ও রহিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। গ্রেফতারকৃত আহসানের জন্ম চট্টগ্রাম জেলার সন্দীপের বাউরিয়া গ্রামে। সে নিহত আজিজুল ইসলামের বাল্যবন্ধু। পাঁচ বছর মালেশিয়ায় থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে ফেরে আহসান। গত মার্চে ঢাকার গুলশান-২ এ অবস্থিত ‘দ্য গ্রোভ’ রেস্টুরেন্টে মাসিক ৬৫ হাজার টাকা বেতনে এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে যোগদান করে আহসান। তবে করোনায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক সঙ্কটে পড়ে সে। তখন সে তার স্ত্রীর আত্মীয় এবং এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপর আসামি আলাউদ্দিনের কাছে কিছু টাকা ধার চায়। আলাউদ্দিন পেশায় ড্রাইভার হলেও পাসপোর্ট অফিসে দালালি ও পরিবহন পুলের পুরনো গাড়ি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত ছিল। আলাউদ্দিন টাকা ধার না দিয়ে আহসানকে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ করে দিতে বলে। এ কাজে যে টাকা পাওয়া যাবে দুই জনে ভাগ করে নেবে। আহসান বাল্যবন্ধু আজিজুল ইসলাম মেহেদীকে জানায় পাসপোর্টে সমস্যা সংক্রান্ত কোন কাজ থাকলে সে সমাধান করে দিতে পারবে। এরপর চট্টগ্রামের তিনটি পাসপোর্টের নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য ১২ আগস্ট ঢাকায় আহসানের কাছে আসে মেহেদী। এরপর মেহেদীকে আলাউদ্দিন তার গাড়িতে করে আহসান ও মেহেদীকে মহানগর আবাসিক এলাকার বাসায় নিয়ে যায়। দুই সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট তিনটির নাম ও বয়স সংশোধন করে দেয়ার বিনিময়ে আলাউদ্দিনকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও আহসানকে এক লাখ টাকা দেয় মেহেদী। আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের এক উচ্চমান সহকারীকে ঘুষ দিয়ে পাসপোর্টের নাম ও বয়স সংশোধনের কাজ করত আলাউদ্দিন। কিন্তু মেহেদীর দেয়া তিনটি পাসপোর্টের কাজ নির্ধারিত সময়ে দিতে পারেনি আলাউদ্দিন ও আহসান। মেহেদী তাদের দুইজনকে দ্রুত পাসপোর্ট দিতে বলে চাপ দিতে থাকে। আহসান ও আলাউদ্দিন অনুরোধ করে আরও এক সপ্তাহ সময় নেয় মেহেদীর কাছ থেকে। ওই এক সপ্তাহ শেষ হওয়ার পরও তারা কাজ করে না দিতে পারায়, মেহেদী পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত চায়। আহসান ও আলাউদ্দিন পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত না দিয়ে সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। একপর্যায়ে মেহেদী এ দুই জনকে জানায় পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত না দিলে ঢাকায় এসে তাদের অফিসে অভিযোগ করবে। চাকরি হারানোর ভয়ে আহসান ও আলাউদ্দিন মেহেদীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আহসান ও আলাউদ্দিন পাসপোর্ট নেয়ার জন্য মেহেদীকে ১০ অক্টোবর ঢাকায় আসতে বলে। ১০ অক্টোবর রাত ১১টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান মেহেদী। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা মোতাবেক মেহেদীকে খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় ভাড়া বাসায় নিয়ে যায় আহসান। খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয় মেহেদীকে। রাত অনুমানিক দেড়টার দিকে ঘুমন্ত মেহেদীকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে সে। মেহেদীর হাত, পা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে বেডশিট, মশারি ও পলিথিনে মুড়িয়ে ফেলে মোবাইল ফোনে আলাউদ্দিনকে হত্যার পর বিষয়টি কনফার্ম করে আহসান। আহসানের পাশের রুমের ভাড়াটিয়া তামিম আকস্মিকভাবে আহসানের রুমে ঢুকে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারে। আহসানের অনুরোধে তামিম জানায় এ বিষয়টি সে কাউকে বলবে না এবং লাশটি সুবিধাজনক স্থানে ফেলে দিতে আহসানকে সহায়তা করবে। লাশ সরিয়ে ফেলার জন্য ভোর ৪টার দিকে আলাউদ্দিন খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় আহসানের বাসায় গাড়ি পাঠায়। আহসান ও তামিম ড্রাইভারকে গাড়িতে বসতে বলে নিজেরাই মালামাল গাড়িতে তুলবে জানালে ড্রাইভার তাদের মালামাল গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। পাশাপাশি ফজরের নামাজ শেষ হওয়ায় লোক সমাগম বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি ছেড়ে দেয় আহসান। লাশ বিছানার নিচে রেখে দুপুর ১২টার দিকে ‘দ্য গ্রোভ’ রেস্টুরেন্টে ডিউটিতে যায় আহসান ও তামিম। কাজ শেষে দুইজন একসঙ্গে বাসায় ফেরে। রাত ১টার দিকে আলাউদ্দিনের নির্দেশে ড্রাইভার রহিম আলাউদ্দিনের নোয়া মাইক্রোবাসটি চালিয়ে লাশ ফেলে দেয়ার জন্য খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় আহসানের বাসায় যায়। আহসান ও তামিম বিছানা, মশারি, বেডশিট ও পলিথিনে মোড়ানো মেহেদীর লাশটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে ড্রাইভার রহিমকে সায়েদাবাদে যেতে বলে। পথে তামিম নেমে যায়। আহসান মাইক্রোবাসে লাশটি নিয়ে হাতিরঝিল এলাকায় প্রবেশ করে। হাতিরঝিল লেকের মেরল-বাড্ডা প্রান্তে লোকজন বিহীন ও অন্ধকারচ্ছন্ন দেখে ড্রাইভার রহিম গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দেয়। আহসান লাশটি গাড়ি থেকে পানিতে ফেলে দেয়। এদিকে পুলিশ ওই লাশ উদ্ধারের পর ঘটনাস্থল থেকে একটি কাগজের টুকরো উদ্ধার করে। যাতে লেখা ছিল একটি মোবাইল নাম্বার। পুলিশ ওই নাম্বারে ফোন করে পেয়ে যায় ক্লু। তারপরই একে একে গ্রেফতার করা হয় চারজনকে। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই খুনীরা স্বীকার করে কি কারণে কোথায় কিভাবে মেহেদীকে হত্যা করা হয়।
×