ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা

শিল্পীর খাট, আঁকা ছবি- সব ঠিক আছে, নেই শুধু যত্ন

প্রকাশিত: ২২:৫০, ২০ অক্টোবর ২০২০

শিল্পীর খাট, আঁকা ছবি- সব ঠিক আছে, নেই শুধু যত্ন

রিফাত-বিন-ত্বহা ॥ শুধু রংতুলির স্পর্শে তিনি সৌন্দর্য্য অন্বেষণ করেননি, বাস্তবেও প্রমাণ দিয়েছেন ভালবাসার। তাই ঢাকার ফুটপাথ থেকে দুর্লভ নাগলিঙ্গম বৃক্ষ নিধন হতে দেখে তার চোখ প্লাবিত হয়েছিল। বলতেন, এতো একটি বৃক্ষের নিঃশেষ নয়, গোটা জীবনের পরিসমাপ্তি। সেই মহান মানুষটি হলেন শিল্পী এসএম সুলতান। বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের নামে নড়াইলে স্মৃতিসংগ্রহশালা ও শিশুস্বর্গ নির্মাণ, আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বেশ উন্নয়ন হয়েছে। তবে চিত্রা নদীর পাড়ে ‘সুলতান ঘাট’ নির্মাণ কাজ শুরুতেই থমকে আছে। এছাড়া সুলতানের বসতঘরটির অবস্থা একেবারেই করুণ। এই ঘরের মধ্যে সুলতানের ব্যবহৃত খাট, পোশাক, দ্বিতলা নৌকার নোঙ্গরসহ স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছু রয়েছে। আর এই ঘরের ভেতরে সংরক্ষিত এস এম সুলতানের ব্যবহৃত খাটসহ অন্যান্য জিনিসপত্রও নষ্টের উপক্রম। সুলতানপ্রেমীদের দাবি, এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করে দৃষ্টিনন্দন ও পর্যটনবান্ধব করে তোলা হোক সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা। সবুজ-শ্যামল ঘেরা ‘এসএম সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালায় ফুল, পাখি, গাছপালার অপরূপ রূপের আকর্ষণেই প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন পর্যটকরা। মুগ্ধ হন সুলতানের অঙ্কিত ছবি, ভাসমান শিশুস্বর্গ (নৌকা) ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখে। এদিকে, সুলতান সংগ্রহশালার পাশ দিয়ে প্রবাহিত সুলতানের স্মৃতিধন্য চিত্রা নদীও এক অপরূপ রূপ মেলে আছে যেন। সুলতানের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু ছিল-কৃষক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার, মাঠ, নদী, হাওড়, বাঁওড়, জঙ্গল, সবুজ প্রান্তর প্রভৃতি। মানবতাবাদী সুলতান চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি বাঁশিসহ অন্যান্য সুরযন্ত্র বাজাতেও পটু ছিলেন। তার সঙ্গী ছিল-বিভিন্ন প্রজাতির পশু ও পাখি। শিল্পের মূল্যায়ন হিসেবে ১৯৮২ সালে পেয়েছেন একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮৪ সালে রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননাসহ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব এ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার পেয়েছেন। এদিকে, ২০০১ সাল থেকে সুলতান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একজন গুণী চিত্রশিল্পীকে সুলতান পদক দেয়া হচ্ছে। বরেণ্য এই শিল্পী অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলের রূপগঞ্জের কুড়িগ্রাম এলাকায় সংগ্রহশালা চত্বরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এসএম সুলতান। সরেজমিনে দেখা যায়, এসএম সুলতান তার জীবদ্দশায় যে ঘরটিতে বসবাস করতেন, সেই একতলা পাকাঘরটির অবস্থা খুবই করুণ। প্রায় পাঁচ বছর ধরে খসে পড়ছে ছাদের পলেস্তারা। সংগ্রহশালা দেখভালের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কয়েকজন জানান-এস এম সুলতানের বসতঘরটির ছাদ বেশ জরাজীর্ণ। ঘরের ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতেও ভয় লাগে। কখন পলেস্তারা খসে পড়ে তার ঠিক নেই। দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই ঘরের মধ্যে সুলতানের ব্যবহৃত খাট, পোশাক, দ্বিতলা নৌকার নোঙ্গরসহ স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছু রয়েছে। ১৯৮২ সালে ঘরটি নির্মিত হয়। এস এম সুলতানের চিঠি সংগ্রাহক রূপগঞ্জ বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী তাহিদুল ইসলাম সারজান জানান, সুলতান বেঁচে থাকাকালীন দুঃখ-কষ্টের কথা তার (সারজান) সঙ্গেই বেশি ভাগাভাগি করতেন। অভাব-অনটনে সুলতানের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন তিনি। সুলতানের লেখা এ সংক্রান্ত অনেক চিরকুট ও চিঠি সংগ্রহ করে রেখেছেন ওষুধ ব্যবসায়ী সারজান। এছাড়া তার দোকানে যে চেয়ারটিতে সুলতান প্রায়ই বসতেন, সেই চেয়ারটি সেখানেই সংরক্ষিত আছে। এসব স্মৃতিচারণ করে সুলতানপ্রেমী তাহিদুল ইসলাম সারজান বলেন, খ্যাতিমান এই চিত্রশিল্পীর বসতঘরটির জরাজীর্ণের খবর শুনে খুবই মর্মাহত হলাম। এটি সুলতানের স্মৃতিবিজড়িত ঘর। আমাদের দাবি, দেশী-বিদেশী পর্যটকরা এখানে এসে যেন সুলতানের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখার সুযোগ পান। সব কিছু সুন্দর-পরিপাটি যেন করা হয়। শিশু শ্রেণীর শিক্ষার্থী ঐতিহ্য বলে, আমি সুলতান দাদুর এখানে (শিশুস্বর্গ) ছবি আঁকা শিখি। করোনার কারণে অনেকদিন ক্লাস বন্ধ। সংগ্রহশালায় এসে ফুল-পাখি দেখি। তবে নৌকায় চড়তে পারি না। আমি সুলতান দাদুর দুইতলা নৌকায় চিত্রা নদীতে ঘুরতে চাই। এখানে একটি শিশুপার্ক চাই। নারীনেত্রী নাসিমা রহমান পলি বলেন, আমার কিশোরী বেলায় সুলতান কাকুর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িত। কয়লা দিয়ে তার কাছে ছবি আঁকা শিখেছি। প্রাণের টানে মাঝে-মধ্যে সুলতান সংগ্রহশালায় ছুটে আসি। এখানে (সংগ্রহশালা) এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গের ঘাট নির্মাণ এখনও শুরু হয়নি। আশপাশে ঝোঁপঝাড়। বিশেষ করে সুলতানের ব্যবহৃত খাটসহ স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছু নষ্ট হচ্ছে। সুলতান সংগ্রহশালার অফিস সহকারী চিত্রশিল্পী নয়ন বৈদ্য বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি সংগ্রহশালা খুলে দেয়া হয়েছে। বিশ্বমানের সব চিত্রকর্ম এখানে রয়েছে। আমাদের প্রাণের দাবি, সংগ্রহশালাটি সেই মানের গড়ে তোলা হোক। এসব প্রসঙ্গে এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা বলেন, সুলতান সংগ্রশালাসহ ঘাটটিকে দৃষ্টিনন্দন ও পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে প্রায় দুই কোটি টাকা প্রয়োজন। অর্থ বরাদ্দ পেলে কাজগুলো শুরু হবে। এ বিষয়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। বরেণ্য এই শিল্পী ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় বাবা মেছের আলী ও মা মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এসএম সুলতান।
×