ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিযুক্তের যাবজ্জীবন দণ্ড

সাত কর্মদিবসে শিশু ধর্ষণ মামলার প্রথম রায় বাগেরহাটে

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ২০ অক্টোবর ২০২০

সাত কর্মদিবসে শিশু ধর্ষণ মামলার প্রথম রায় বাগেরহাটে

বাবুল সরদার, বাগেরহাট ॥ দেশে প্রথম মামলা দায়েরের পর বিচার প্রক্রিয়া শুরুর সাত কর্মদিবসের মধ্যে শিশু ধর্ষণ মামলার রায় হয়েছে বাগেরহাট আদালতে। রায়ে অভিযোগ ‘সন্দেহাতীতভাবে’ প্রমাণিত হওয়ায় আব্দুল মান্নান সরদার নামে এক ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন আদালত। সেই সঙ্গে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ-াদেশ দেয়া হয়। সোমবার দুপুরে জনাকীর্ণ আদালতে আসামির উপস্থিতিতে যুগান্তকারী এ রায় দেন বাগেরহাট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মোঃ নূরে আলম। এর আগে দেশে এত দ্রুত কোন ধর্ষণ মামলার রায় হয়নি। ফৌজদারি মামলার ইতিহাসে দৃষ্টান্ত এ রায়ে নারী নেত্রী, আইনজীবী ও সুশিল সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মামলা সূত্রে জানা যায়, পিতৃহারা সাত বছর বয়সী শিশুটি মংলা উপজেলায় তার মামার কাছে থাকত। গত ৩ অক্টোবর বিকেলে বিস্কুট খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করে একই উপজেলার মাকোড়ডোন গ্রামের ভূমিহীন আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার আব্দুল মান্নান সরদার। পরে মেয়েটি তার মামাকে এ কথা জানালে ওই রাতেই আব্দুল মান্নানকে আসামি করে মংলা থানায় মামলা দায়ের করেন শিশুটির মামা। এরপর একই রাতে মংলা থানা পুলিশ আব্দুল মান্নানকে গ্রেফতার করে। ১১ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোংলা থানার এসআই বিশ্বজিৎ মুখার্জি। পরে ১২ অক্টোবর মামলাটির অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৩ অক্টোবর বাদীপক্ষের ১৬ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হয়। ১৪ অক্টোবর চিকিৎসক, বিচারিক হাকিম, নারী পুলিশ সদস্য এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। ১৫ অক্টোবর আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনে সাফাই সাক্ষ্য নেয়া হয়। ১৬ ও ১৭ অক্টোবর সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় রবিবার (১৮ অক্টোবর) বাদী ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ করে সোমবার রায়ের দিন ধার্য করেন বাগেরহাট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মোঃ নূরে আলম। সে অনুযায়ী রায় ঘোষণা করা হয়। প্রসঙ্গত গত ১২ অক্টোবর যেদিন এ মামলার অভিযোগ গঠন হয়, তখন পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদ-। তার পরদিনই আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এদিকে এ ধর্ষণ মামলায় সাত কার্যদিবসের মধ্যে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করে রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হয় রবিবার (১৮ অক্টোবর)। তারিখ অনুযায়ী সোমবার (১৯ অক্টোবর) এ মামলার রায় ঘোষণা করা হলো। বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার মাত্র সাত কার্যদিবসে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়াকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন নারীনেত্রী, আইনজীবী ও সুশিল সমাজের প্রতিনিধিরা। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের বিচার এভাবে দ্রুত সম্পন্ন হলে ধর্ষণ রোধে ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। দেশে ফৌজদারি মামলার ইতিহাসে বিরল এ রায়কে ধর্ষকদের জন্য দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে নারী উন্নয়ন ফোরামের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রিজিয়া পারভীন বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আন্তরিক থাকলে অল্প সময়ের মধ্যে যে বিচার কাজ শেষ হতে পারে, এটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাগেরহাট জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট শরীফা হেমায়েত ও নারী নেত্রী এ্যাডভোকেট পারভিন আহম্মেদ এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ রায় ধর্ষকদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে। স্বল্প সময়ে রায় হলে বাদী পক্ষ অনেক স্বস্তি পায়। ভুক্তভোগীও তার বিভীষিকাময় স্মৃতির ক্ষত ভোলার আগেই বিচারের রায় শুনে কিছুটা হলেও স্বস্তি পান। আমরা দাবি করব, অন্যান্য ধর্ষণ মামলার বিচার যেন এমন দ্রুত সম্পন্ন হয়। বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ড. একে আজাদ ফিরোজ টিপু ও বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সভাপতি এ্যাডভোকেট মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলার ইতিহাসে এটি সংক্ষিপ্ত সময়ে রায়। এ রায় ঘোষণার মধ্যে দিয়ে বাগেরহাটের আদালত একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, যা ধর্ষণ প্রবনতাসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের তরিৎগতিতে মামলার রায় হলে বিচার প্রার্থিরা হয়রানির হাত থেকে মুক্তি পাবেন বলে তারা মত দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এপিপি রনজিৎ কুমার ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, মামলার একমাত্র আসামি আব্দুল মান্নান সরদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘সন্দেহাতীতভাবে’ প্রমাণিত হওয়ায় ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-ের পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে উল্লেখ আছে, ধর্ষণের ঘটনায় আসামি ধরা পড়লে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন করা যাবে। এ মামলাটি তারই প্রমাণ। এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী লিয়াকত হোসেন বলেন, এটি একটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলা। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করব। ধর্ষকের যাবজ্জীবনে খুশি বাদী ॥ সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণের অপরাধে ধর্ষক আব্দুল মান্নান সরদারকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী নির্যাতিত শিশুটির মামা। মামলার রায় শোনার পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আসামি মান্নান ধর্ষণ করার পর থেকে এই রায় হওয়া পর্যন্ত পুলিশ আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে। ঘটনার দিনই পুলিশ আসামিকে গ্রেফতার করেছে। আমাকে সর্বাত্মক নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছে। আর আদালত স্বল্প সময়ে আজকে যে রায় দিয়েছে এতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি আদালতের বিচারক, উকিল ও পুলিশ ভাইদের ধন্যবাদ জানাই। আদালতে রায় ঘোষণার পর সোমবার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মামলার বাদী এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আমার দুলাভাই মারা যাওয়ার পরে আমি আমার ভাগ্নিকে আগলে রেখেছিলাম। কিন্তু লম্পট আব্দুল মান্নান যেটা করেছে তা এই পৃথিবীতে কেউ সহ্য করতে পারে না। এতিম ভাগনির ওপর নির্যাতনের অপরাধে আদালত যে রায় দিয়েছে, তাতে আল্লাহও খুশি হয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
×