ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এই সেবার জন্য পুলিশের আলাদা ইউনিট গঠনের পরিকল্পনা

‘৯৯৯’ ॥ আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসার প্রতীক

প্রকাশিত: ২২:৪০, ২০ অক্টোবর ২০২০

‘৯৯৯’ ॥ আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসার প্রতীক

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশের বিপন্ন মানুষের জন্য পুলিশের ডিজিটাল সেবা ‘৯৯৯’ এখন আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটা মূলত জাতীয় জরুরী সেবার হটলাইন। এই ডিজিটাল সেবা পরিচালনার জন্য পুলিশের একটি আলাদা ইউনিট গঠনের পরিকল্পনা করছে সরকার। সারাদেশে গত ৩ বছরে ২ কোটি ৪০ লাখ বার ফোন কল এসেছে এই ডিজিটাল সেবার নম্বরে। প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার ফোন কল আসছে। যে ফোন কলগুলো এসেছে তার মধ্যে শতকরা ৮১ ভাগ পুরুষ ও ১৯ ভাগ নারী। এ পর্যন্ত ৪৯ লাখ ৮২ হাজার ৯৬৩ জনকে সেবা দেয়া হয়েছে এই হটলাইনে। এই সময়ের সবচেয়ে বহুল আলোচিত ধর্ষণের শিকার অনেক নারীও এই ফোন নম্বরে কল করে প্রতিকার পেয়েছেন। ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দুর্ঘটনা, বাল্যবিয়ে ঠেকানো, ধর্ষণ, অগ্নিকা-সহ যে কোন বিপদের প্রতিকার পাওয়ার ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে পুলিশের এই ডিজিটাল সেবা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশনায় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ পরিচালনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর পরই পুলিশের এই জরুরী সেবা জনবান্ধব ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে চলছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের এই জরুরী সেবা এখন তিনটি মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং এ্যাম্বুলেন্স। বর্তমানে ১০০টি ওয়ার্ক স্টেশনে সাড়ে ৪শ’ জনবল কাজ করছে। প্রথম মাত্র ১০০ জন দিয়ে এটা শুরু করা হয়েছিল। জনবল এক শ’ থেকে চার শ’ বাড়ানো হয়েছে। কারণ, দিন দিন আমার সেবার চাহিদা বাড়ছে। এই চাহিদার প্রেক্ষিতেই সেবার জনবল বাড়াতে হয়েছে। চাহিদার পাশাপাশি আরও জনবল বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। এই জরুরী সেবার জন্য পুলিশের আলাদা ইউনিট গঠন করা হলে পৃথিবীর যে কোন উন্নত দেশের তুলনায় জরুরী সেবার সংখ্যা, গুণগত মান, দ্রুতগতিসহ নানাদিক দিয়েই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ছোঁয়া আরও দৃশ্যমান হবে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে পুলিশের মাধ্যমে শুরু হয়েছে এই জাতীয় জরুরী সেবা। এটি পরিচালনার মূল ভূমিকা পালন করছে পুলিশ। এই জরুরী সেবা পরিচালনার জন্য পুলিশের একটি আলাদা ইউনিট গঠনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পুলিশের আলাদা ইউনিট গঠন করা হলে জরুরী সেবা দ্রুতগতিতে মানুষজনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া যাবে। নতুন এই জরুরী সেবার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে সারাদেশের মানুষের। শুধু রাজধানী ঢাকাই নয়, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া সর্বত্রই এই সেবা পুলিশকে অসহায় মানুষের কাছে এই ডিজিটাল সেবা হয়ে উঠেছে জনবান্ধব। এটার ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য বা জনগণের দোরগোড়ায় নেয়ার জন্য বড় ধরনের প্রোগ্রাম করার পরিকল্পনা আছে। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ৯৯৯ এই ডিজিটাল ফোন নম্বরে প্রতিদিন ৩০ হাজারের মতো কল রিসিভ করা হচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতার অনেক কলই আসছে যা রিসিভ করা হচ্ছে। অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে আমাদের কাছে ফোন করে প্রতিকার চেয়েছেন। পুলিশ পাঠিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে ভুক্তভোগীকে। এমনকি ধর্ষকদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৯৬৬টি কল রিসিভ করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে রিসিভ করা হয়েছে ১ হাজার ৬৯টি ফোন কল। মার্চে এক হাজার ১৬৪টি, এপ্রিলে ৯৩১টি, মে মাসে ৯৩৪টি, জুনে ৭৫১টি, জুলাইয়ে ৩৫০টি কল পেয়েছি। এই ডিজিটাল সেবার ফোন নম্বরে কলের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ কোটি ৩৯ লাখের বেশি কল রিসিভ করা হয়েছে। তবে বিশাল সংখ্যক কলের সেবা দেয়া সম্ভব হয়নি, যার এখনও কাঠামোগতভাবে সক্ষমতা অর্জন করা যায়নি। অর্থাৎ সেবা দেয়া সম্ভবপর হয়েছে মাত্র ২১ শতাংশ, যা ৫০ লাখ কলের সেবা। ৭৯ শতাংশ কলের সেবা কিন্তু দেয়া সম্ভবপর হয়নি। যেভাবে কার্যক্রম শুরু হয় ॥ সেবাটি প্রথমদিকে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে পরিচালিত একটি পাইলট কর্মসূচী ছিল। ওই সময় পরীক্ষামূলক কাঠামোর অধীনে নাগরিকের জরুরী প্রয়োজনে সম্পূর্ণ টোলফ্রি পুলিশ, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও এ্যাম্বুলেন্স সেবা দেয়া হতো। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বাংলাদেশ পুলিশ, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান প্লাস ওয়ানের সেবার সমন্বয়ে ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে এ সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশনায় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ পরিচালনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে বাংলাদেশ পুলিশ উন্নত প্রযুক্তি ও কারিগরি সরঞ্জাম সংযোজন করে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিএমপি কমান্ড এ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের ৫ম এবং ৬ষ্ঠ তলায় জাতীয় জরুরী সেবা সেন্টারের কার্যক্রম শুরু করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন স্তরের প্রশিক্ষিত পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জরুরী এ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মুজিববর্ষে আধুনিকায়ন হচ্ছে ॥ যে কোন সমস্যায় দ্রুত সেবা পেতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ৯৯৯ নম্বর পুলিশী এই সেবাটি মুজিববর্ষে আরও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এখনই সেবাটি পৌঁছে গেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। এই সেবার আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে সেবা গ্রহণকারীর অবস্থান জানার প্রয়োজনে কলার আইডেন্টিফিকেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র, ঠিকানা, অবস্থান জানা যাবে। ৯৯৯ এ্যাপসটি গুগল প্লে স্টোরে সংযোজন করা হয়েছে। একইভাবে চালু হয়েছে ফেসবুক পেজ। রাইড শেয়ারিং এ্যাপসের অনুসরণে এ্যাম্বুলেন্স সেবার মতো পৃথক একটি এ্যাপস করা হয়েছে। ডিএমপি এবং সিএমপি’র প্রতিটি থানার দ্রুত সাড়া প্রদান এবং কেন্দ্রীয় যানবাহন ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সব পেট্রোল গাড়িতে ১টি করে মোবাইল ডাটা টার্মিনাল সংযোজন হয়েছে। অডিও ভিজ্যুয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে। ৯৯৯ সেবা পরিচালনা করার জন্য অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ সেবা আরও নিশ্চিত করতে দক্ষ জনবলও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ জনগণ সেবা পেতে গত ৩ বছরে ২ কোটি ৪০ লাখ ফোন কল পেয়ে সেবা ও সমাধান করার চেষ্টা করেছে, তাতে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় ঠাঁই করে নিয়েছে। এ্যাম্বুলেন্সে দ্রুত রোগী ফেরি পারাপার, প্রাণনাশের আশঙ্কা, ধর্ষণসংক্রান্ত ঘটনা, গৃহকর্মী নির্যাতন, কাউকে আটকে রাখা, লিফটে আটকে পড়া, অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকা, দুর্ঘটনা, অগ্নিকা-ের ঘটনা, পারিবারিক সমস্যা, শব্দদূষণ, ছিনতাইসহ নানা বিপদ থেকে উদ্ধারে মানুষকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। নাগরিকের জরুরী প্রয়োজনে কোন একটি মুঠোফোন থেকে ৯৯৯-এ বিনা পয়সায় ফোন করতে পারেন। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে এই জরুরী সেবা। কেউ ফোন করলে সমস্যার ধরন, নাম-পরিচয় ও ঠিকানা জেনে ব্যবস্থা নেয়া হয়। যেমন কেউ পুলিশের সেবার জন্য ফোন করলে তাৎক্ষণিকভাবে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশের সঙ্গে ফোনে ওই ব্যক্তিকে কথা বলিয়ে (টেলি কনফারেন্স) সহায়তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×