ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খাদ্যপণ্যের সম্ভাবনায় দেশ

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ২০ অক্টোবর ২০২০

খাদ্যপণ্যের সম্ভাবনায় দেশ

স্বয়ংসম্পূর্ণ খাদ্য অর্থনীতির সুবর্ণ সময়ে বাংলাদেশ। পেঁয়াজকে নিয়ে যে ব্যবসায়িক অস্থিরতা তাকেও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সময়ের দাবি। শুধু তাই নয়, অচিরেই বাংলাদেশকে পেঁয়াজেও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে বিদেশ থেকে আমদানিও বন্ধ করা হবে। আর ইলিশের প্রাচুর্য তো চিরায়ত ঐতিহ্য। মাঝখানে তা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রমে হলেও তাকে নতুনভাবে জনগণের মাঝে উপহার দেয়া হয়েছে। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের এসব বিষয়ে কথা বলেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ওবায়দুল আযম পান্না। আলাপচারিতায় -নাজনীন বেগম করোনা দুর্যোগে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব দুঃসহ ক্রান্তিকাল পার করছে। উন্নয়নের নানামাত্রিক সূচকে পড়েছে অনাকাক্সিক্ষত দুরবস্থায়। গত বছর এই দুঃসময় অতীতের সব ইতিহাস ছাড়িয়ে যায়। সেই সেপ্টেম্বরÑঅক্টোবর মাস। ২০১৯ সালের এই সময়ে ভারতের মহারাষ্ট্রে ঢল নামলে সেখানে পেঁয়াজ উৎপাদনে অনেক সমস্যা ও ঝুঁকি তৈরি হয়। ফলে ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করলে সরাসরি তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। পেঁয়াজ গুদামজাত থাকা অবস্থায়ও লাফ দিয়ে পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা পর্যন্ত গড়ায়। বাজার অর্থনীতিতে একটি প্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্কট তৈরি হলে অন্যান্য দ্রব্যেও পড়ে তার নেতিবাচক প্রভাব। লাগামহীন পেঁয়াজের বাজার মূল্যে ভোক্তা শ্রেণীর নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। সঙ্গে অন্যান্য দ্রব্যেও লাগে তার প্রবল হাওয়া। সেই সেপ্টেম্বর মাস পার হতে না হতেই পুনরায় ভারত সে দেশে পেঁয়াজের রফতানির ওপর কড়া নির্দেশ জারি করলে বাংলাদেশ এবারও সেই আবর্তে পড়ে যাওয়ার পথে। তবে এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কঠোর অবস্থানে। অতিরিক্ত সচিব ওবায়দুল আযমের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়Ñগত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় এই বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ২ লাখ মেট্রিক টন বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয়। পাশাপাশি টিসিবিকেও অধিকতর শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেয়ার কারণে ন্যায্য মূল্যে ৩০ টাকা কেজি পেঁয়াজ সরকারীভাবে সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে। আর যে কঠোর সিন্ডিকেট বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সব ধরনের কারসাজি অব্যাহত রাখে সেখানেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত বছরের পেঁয়াজের সঙ্কট তৈরিতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে প্রায় ৩ কোটি টাকা জরিমানাও নাকি গুনতে হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব অভিমত দেন নজরদারির ব্যাপারটি অত সহজ নয়। তার জন্য রীতিমতো প্রশিক্ষণ আর শৃঙ্খলাবোধও জরুরী। বিক্ষিপ্ত কর্মসূচীতে কোন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায় না। তাই নজরদারির ব্যাপারটি কঠোর করা হয়েছে, যাতে ফাঁক ফোকরে কোন অপকৌশল অব্যাহতি না পায়। তার মতে সরকার এবার বাজার ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপে খাদ্য অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছে। শুধু বাজারের ওপর নয়, আরও কঠিন নজরদারি রয়েছে সিন্ডিকেট চক্রের ওপরও। খুব বেশি সুযোগ থাকছে না দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন পর্যায়ে যেতে। যার কারণে করোনার রমজান এবং কোরবানির ঈদে দ্রব্যমূল্য তার স্বাভাবিক মাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়নি। ৩০ টাকা কেজিতে ন্যায্য মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি সরকারের এক অভাবনীয় উদ্যোগ। আর অনলাইনেও পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে টিসিবির মাধ্যমে। সেখানে ৩৬ টাকা কেজি। কারণ যারা অনলাইন কার্যক্রম এবং ব্যবহারে পারদর্শী তারা মোটামুটি অপেক্ষাকৃত সচ্ছল। ওবায়দুল আযম আরও অভিমত দেন অচিরেই আমরা দেশজ উৎপাদন বাড়িয়ে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করতে পারব। তেমন কর্মপরিকল্পনায় সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। তার সুফল পেতে হয়ত আমাদের আর একটু সময় অপেক্ষা করতে হবে। পেঁয়াজেও আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসতে খুব বেশি দেরি হবে না। অতি আবশ্যিকভাবে আবাদী জমির ক্ষেত্র বাড়াতে হবে, যা উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিয়ামক ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে সরকার প্রদত্ত সার, বীজ, কীটনাশক, ওষুধ সরবরাহও বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনে তা আরও বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আসা শুরু হয়েছে। আমদানি শুল্কের ব্যাপারেও সরকারের বিশেষ বিবেচনা ব্যবসায়ী শ্রেণীকে উদ্বুদ্ধ করবে। পেঁয়াজের মতো অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যটির চাহিদা অপরিসীম। সেখানে পর্যাপ্ত সরবরাহ ও ভোক্তা শ্রেণীর প্রতিদিনের চাহিদা বিবেচনায় থাকে। তাই কোন ধরনের কারসাজি কিংবা অতিরিক্ত মুনাফায় সাধারণ মানুষের ওপর অকারণ ও অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি কারও কাম্য হতে পারে না। সরকারের তো নয়ই। ওবায়দুল আযম তেমন সম্ভাবনার ইঙ্গিতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। শুধু পেঁয়াজ নয়, সব ধরনের খাদ্যপণ্য যাতে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে তেমন কার্যকরী পদক্ষেপও সরকারের বিশেষ পরিকল্পনায় রয়েছে। আমরা দেখেছি দুই ঈদেও প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী যেমনÑ মাছ, মাংস, পেঁয়াজসহ যাবতীয় মসলার বাজার মূল্যও নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেখানে বাজার সিন্ডিকেটের সেভাবে অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জন প্রতিরোধ করাও ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন দায়বদ্ধতা। সফল খাদ্য অর্থনীতির সম্ভাবনার বলয় গত দশ বছরের উন্নয়ন অভিযাত্রার অভাবনীয় প্রাপ্তি। মাছে-ভাতে বাঙালী এমন ঐতিহ্যিক প্রবাদে বাংলার ঘরে ঘরে যে চিরায়ত বৈভব সেখানেও বাংলাদেশ তার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখার অক্লান্ত প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। সমুদ্র আর নদী বিধৌত বাংলার মৎস্য সম্পদ বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ বাংলাদেশের এক ঐশ্বর্যিক পরিম-ল। হরেক প্রজাতির মাছের যে পরিপূর্ণ ভাণ্ডার সেখানে এক সময় সঙ্কট তৈরি হলে গত দশ বছরের চেষ্টায় তাও পূর্ণ হওয়ার পথে। বিশেষ করে জাতীয় মাছ রুপালি ইলিশের স্বাদ নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছিল। মনে হতো আমাদের নিজস্ব বৈভব ইলিশ কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে মাত্র পাঁচ বছরে সমস্ত আবর্জনা মুছে ফেলতে পারেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারিক প্রক্রিয়াও শেষ অবধি পৌঁছাতে শেখ হাসিনাকে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসতে হয়। ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সরকার যে অদম্য পথযাত্রায় অনেক ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলে সেখানে ইলিশেরও নবযাত্রা পথ জাতির জন্য এক অভাবনীয় অর্জন। অতিরিক্ত সচিবের বক্তব্যেও সেই অভিমত উঠে আসে। তাঁর মতে ইলিশের জাটকা ধরা বন্ধ শুরু করা হয় সেই ২০০৯ সাল থেকেই। সেখানে মৎস্য উৎপাদনকে যথেষ্ট প্রণোদনায় নতুন কার্যক্রমকে অবারিত করতে বর্তমান সরকার যুগান্তকারী পদক্ষেপও নিয়েছিল। মাছ ধরা বন্ধের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের প্রতিদিন ১ কেজি করে মাসে ৩০ কেজি চাল দেয়া হতো যাতে তাদের যাপিতজীবন বিপন্ন অবস্থায় না পৌঁছে। তারই সুফল পেতে শুরু করেছি আমরা প্রায় ১১ বছর পরে। তবে ওবায়দুল আযম বলেনÑ ইলিশের সম্ভারকে নতুন যাত্রায় অভিষিক্ত করতে যে কার্যক্রম শুরু সেটা প্রতি বছরই কিছু না কিছু দৃশ্যমান হয়েছে। তবে অবারিত হচ্ছে গত দুই বছর থেকে। আর মূল্যের ব্যাপারটি এবারই জনগণকে স্বস্তির পর্যায়ে নিয়ে যায়। যেমন গত বছরে ইলিশের দাম এক কেজির ওপরে হলে তা ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় পাওয়া যেত। এবার তা ৮৫০ থেকে ৯০০ এর মধ্যেই ভোক্তা শ্রেণী কিনতে পেরেছে। সরবরাহও পর্যাপ্ত এবং ওজনের মাত্রায়ও বাড়ার দৃশ্য। তাই গত বছরের তুলনায় এবারের ইলিশ উৎসব অন্য মাত্রায় সাধারণ মানুষকে আনন্দ দিয়েছে। ইলিশ আমাদের অনেক পছন্দের একটি মাছ। যার জাতীয় মর্যাদাও অতুলনীয়। শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও আমাদের ইলিশের কদর নজরকাড়া। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই পুষ্টিকর মাছটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে যাচ্ছে। পশ্চিম বাংলায়ও আমাদের ইলিশের চাহিদা অনেক। সচিব ওবায়দুল আযম বললেন-এবার দুর্গাপূজা উপলক্ষে ইলিশের উপহার পাঠানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সরকারের কাছে। শুধু তো উপহার নয়, সঙ্গে সুস্বাদু এই মাছটির চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বাণিজ্যিক বিষয়টিও কোনভাবে আলাদা করা যায় না। মৎস্য সম্পদে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ শুধু নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদায় সরবরাহ করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আনে। শুধু ইলিশ নয়, বাংলাদেশের হরেক প্রজাতি মাছের প্রচুর সম্ভাবনাকে নতুনভাবে কাজে লাগিয়ে মৎস্য সম্পদে অধিকতর অর্জনকে সফলতার দ্বারে নিয়ে যেতেও বর্তমান সরকার সঙ্কল্পবদ্ধ। আমরা এখন মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়তম। এই অর্জনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ের কর্ম পরিকল্পনার প্রাসঙ্গিক যোগসাজশ। যা সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে আধুনিক ও আলোকিত বলয়ে নিয়ে যেতে সময় নেবে না। লেখক : সাংবাদিক
×