ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যশোর রোড ॥ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ২০ অক্টোবর ২০২০

যশোর রোড ॥ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

১৯৭৬-৭৮ এ বৃহত্তর যশোর জেলার জেলা প্রশাসক ছিলাম আমি। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ সেপ্টেম্বরে তখনকার পৃথিবীব্যাপী নজরকাড়া বিট কবি এলেন গিনসবার্গ উভয় বাংলার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে কলকাতা থেকে যশোর রোড ধরে পাকিস্তানের অনৈতিক দখলে থাকা বাংলাদেশের পথে অগ্রসর হন। ভারতের বনগাঁয়ে বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের অবস্থা দেখে মর্মাহত হন গিনসবার্গ, চোখের পানি মুছতে থাকেন সুনীল। শ্রুতিতে জানা, বেনাপোলে বাংলাদেশ-ভারতের উন্মুক্ত সীমান্ত পার হয়ে তারা দখলদার পাকিস্তানীদের দিয়ে বিধ্বস্ত সেই সড়ক ধরে যশোরের পথে নাভারন পর্যন্ত এসে একই সড়ক ধরে ফিরে যান। গিনসবার্গ দেখেন পথের দু’ধারের খড়ের চালার ঘর, অগুনতি নিরাশ্রীয় জনতার দখলকৃত বাংলাদেশ থেকে ভারতমুখী পথ চলা, মানুষের বিষ্ঠার দুর্গন্ধ, শরীর-স্বাস্থ্য বিনাশী বিড়ির টানে নিমগ্ন মানুষের অসহায় চাহনী। তারপর কলকাতা হয়ে নিউইয়র্ক গিয়ে গিনসবার্গ লেখেন তার কালজয়ী কবিতা ‘যশোর রোডে সেপ্টেম্বর’। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমসে ১৯৭১ এর ১৪ নবেম্বর। এই কবিতায় মানবদরদী গিনসবার্গ যশোর রোড ধরে প্রায় প্রতিকারহীন শক্তিতে পাকিস্তানীদের দখল করা বাংলাদেশ থেকে ভারত অভিমুখে যেতে থাকা উদ্বাস্তুদের অমানবিক দুঃখ কষ্টের কথা, স্বাধীনতার আর্তি ও এই পটে গণতন্ত্রের পতাকাবাহী আমেরিকার চোখ বুজে থাকার কথা অননুকরণীয় ভাষায় পৃথিবীর স্বাধীনতা ও মানবতাকামী মানুষের সামনে তুলে ধরেন। প্রতিবাদের ভাষায় তিনি এই কবিতায় প্রশ্ন করেন, মানবতার এই দুঃসময়ে কেন মার্কিন বিমান ও নৌবাহিনী বাংলাদেশের দুস্থদের সহায়তায় এগিয়ে আসছে না? এখন তারা কি উত্তর লাওসে বোমা ফেলতে ব্যস্ত, কিংবা নাপাম অগ্নিবোমা দিয়ে উত্তর কোরিয়াকে বিধ্বস্তকরণের মিশনে নেমে রয়েছে? কবিতার শেষ স্তবকে গিনসবার্গ পৃথিবীর সকলের কণ্ঠ এবং মানব প্রেমের ধ্বনি দিয়ে সচেতনীয় আমেরিকার সামষ্টিক চিন্তা শক্তিকে এই মানবিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রযুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার কদিন আগেও ১ আগস্টে জর্জ হ্যারিসন ও জোয়ান বায়েজের গীত গানের সঙ্গে মিশে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য বিশ্বের, বিশেষত পাশ্চাত্য পৃথিবীকে এগিয়ে আসতে কণ্ঠ মিলিয়েছেন। ১৯৭০-এর দশকে তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত আহ্বান ১৯৬০-এর দশকে বেড়ে ওঠা আর ’৭০-এর দশকে সামষ্টিক চিন্তা, চেতনা কর্মে স্থান নেয়া পাশ্চাত্যের কোমর ঘোরানো মাথা দোলানো মুক্ত প্রজন্মকে উজ্জীবিত করেছে। এই পটভূমিকায় বাংলাদেশে যে রোড ধরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও এলেন গিনসবার্গ মানবতার টানে ও সংগ্রামে এসেছিলেন তার বাংলাদেশস্থ অংশ সে ক্রান্তির সময়ে যেভাবে মানুষের হৃদয়ে অনুধাবিত হয়েছে, তা জীবনভর বুকে ধরে রাখার জন্য সীমান্তের বেনাপোল থেকে ৪ মাইল পূর্বদিকে যশোর রোডের ওপর অবস্থিত নাভারন ছাড়িয়ে আমি বার বার আসা-যাওয়া করেছি। তেমনি এখনও আসা যাওয়া করে আসছেন উন্মুক্ত ট্রাকের ডেকে হারমোনিয়াম, তবলা, গীটার হাতে সাধারণ মানুষের অনুভূতির সঙ্গে কণ্ঠ-মিলিয়ে স্বদেশ প্রেমে উদ্বেলিত আবেগে উদ্বেলিত শিল্পীগণ। বেনাপোল সীমান্তরেখা থেকে নাভারন এর দুপাশের কয়েকটি গ্রামে ১৯৭৬-৭৮ পর্যন্ত তখনও বর্বর হানাদার পাকিস্তানীদের অত্যাচারের চিহ্ন ছিল। মানুষের চামড়ার নিচে অস্তিত্বমান অভিশপ্ত পশুর বর্বরতার কাহিনী শোনা যাচ্ছিল। নাভারন বিন্দু থেকে যশোর রোডের একটি শাখা উলশী গ্রাম ও যদুনাথপুর গঞ্জ হয়ে মরা বেত্রবর্তী বা বেতনা নদীর পার ঘেঁষে সাতক্ষীরার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। এই সড়কের দুপাশে নাভারন থেকে ৩ মাইল দক্ষিণের যদুনাথপুরে ও সংলাগ সন্মন্দকাটিতে বার বার শুনেছি হানাদার পাকিস্তানীরা কিভাবে যুবতী মেয়েদের নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে, বসতঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, মসজিদ, মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, দোকানপাট লুট করেছে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের ঘর থেকে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে, তরুণ বা যুবকের দেখা পেলেই ওপর নিচ না তাকিয়ে গুলি চালিয়ে মানুষের মরদেহ বিষ্ঠাসম ফেলে চলে গেছে। চোখের পানি সংবরণ করে শুনেছি, বার বার শুনেছি, সেসব নারকীয় অত্যাচারের কথা নাভারনের পশ্চিমের চারাতলা, কাশিপুর ও কু-িপুরে। অত্যাচারের একই কাহিনী শোনা গেছে নাভারনের উত্তরে বাড়িপোতা ও কলাগাছি গ্রামে। সেখানে জীবননাশের এই মচ্ছবের নিধন আর অত্যাচার থেকে অতিবৃদ্ধ-বৃদ্ধারা রেহাই পাননি। গর্ভবতী নারীরাও পাশবিক অত্যাচার ও হত্যা এড়াতে পারেননি। বাড়িপোতা গ্রামে ১৯৬০-এর দশকে তৈরি ছনে মোড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র পুড়িয়ে সঙ্গে নিয়ে আসা বিজাতীয় কাবাব রুটি গরম করে পশুর উল্লাসে উদরস্থ করেছে। আমি বার বার বাড়িপোতা গ্রামে গিয়েছি। এসব অত্যাচারের কথায় ¤্রয়িমাণ ও স্থবির না হয়ে ঘরগুলো নতুন করে বাঁধার ও বিদ্যালয়টি আবারও বড় করে গড়ে তোলায় জনসাধারণকে স্বেচ্ছাশ্রম নিয়ে এগিয়ে আসায় উজ্জীবিত করেছি। গ্রামবাসীরা অসহায়ত্বের স্তব্ধতা-স্থবিরতা কাটিয়ে ক্রমান্বয়ে তাই করেছেন। আমি সে সময় ভাবতেও পারিনি যে, তারা যশোর থেকে বদলি হওয়ার পর আমার নাম দিয়ে ঐ পোড়ানো প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পাকা করে নির্মাণ করবেন। অত্যাচার ও অবিচারকে সময়ের ব্যপ্ত পরিসরে পরাজিত করতে যে অবিনাশী মনোবল ও নিরন্তর পরিশ্রম সফল তাই তারা প্রমাণ করেছেন। অমানবিক অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতাকে পেছনে ফেলে মানব বিকাশের পথে তারা আমাকেও সমব্যথী ও সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করে সম্মান দিয়েছেন। উপলব্ধি করেছি গিনসবার্গের ভাষায় জনগণের কণ্ঠ বিশ্ববাসীর কণ্ঠের সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন করে নিরন্তর সামনে চলার প্রতীতি কালনিরবধি উৎসাহ ও প্রচেষ্টার জন্ম দেয়। এর আগে ১৯৭১ এর ১ আগস্টের বিকেল ও সন্ধ্যায় জর্জ হ্যারিসন, প-িত রবি শংকর, ওস্তাদ আলী আকবর খান নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে ‘বাংলাদেশ’ নামায়িত পৃথিবী খ্যাত কনসার্টে অত্যাচার ও অবিচারে বিধ্বস্ত মুক্তিকামী বাংলাদেশীদের কথা সমবেত মানবাধিকার সচেতন সুধীজনকে শুনিয়েছেন। এদের বাইরে ঐ কনসার্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন সে সময়ের বিটলদের মহানায়ক জন লেনন, গেয়েছিলেন- বাজিয়েছিলেন এরিক ক্লাপটন, বব ডিলান, বিলি প্রেস্টন ও রিংগো স্টার। এরা সবাই ১৯৬০ এর দশকের সর্বজনীন মুক্ত জীবনের প্রবক্তা-প্রজন্ম, সকলের মুক্তির সমর্থনের ইতিহাস ও আর্তি বয়ে এনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা, আশা ও আহ্বানের সঙ্গে তাদের অনুভূতিও আশা মিলিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গীত পিয়াসী ও মানবতার মুক্তির পতাকাবাহী শ্রোতা ও দর্শকদের সংখ্যাধিক্য সামাল দিতে ১৯৭১ এর ১ আগস্টের ‘বাংলাদেশ’ নামায়িত এই কনসার্টটি ২ অধিবেশনে বিস্তৃত করা হয়েছিল। রবি শংকর ও আলী আকবর সেতার ও সরোদ নিয়ে প্রথমে বাজিয়ে গেয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ ধুন’। সূচনাতেই রবি শংকর শ্রোতাদের বলেছেন যে, এই কনসার্টের একটি আবেদন ও আহ্বান আছে : আমরা শিল্পীরা সঙ্গীতের মাধ্যমে আপনাদের আর্তি জানাব- বাংলাদেশের দুঃখ-বেদনার ঘটনা উৎসারিত কণ্ঠ শুনুন ও অত্যাচারীদের বেদনা বোধ করুন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের কষ্ট ও ত্যাগ অনুভব করুন। হ্যারিসন তার বন্ধু রবি শংকরের দেশের (বাংলাদেশ রবি শংকরের পিতা ব্যারিস্টার শ্যাম শংকরের ও তার প্রথম স্ত্রী ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের কন্যা অন্নপূর্নার জন্মভূমি) উপস্থিত সবাইকে এবং পশ্চিম পৃথিবীর মানবতার দর্শনে সচেতন সুধীজনকে বললেন, মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়া জনগণের মানবতার কথা মনে রাখুন। এ কথা মনে রেখেই এই কনসার্ট থেকে উঠে আসা আড়াই লাখ ডলার এসব শিল্পী দান করেছিলেন বাংলাদেশের ত্রাণে প্রযুক্ত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশুদের জরুরী তহবিলে বা ইউনিসেফ-এ। একটি ক্ষুধার্ত ও হাড় জিরে জিরে শিশুর ছবিকে প্রচ্ছদ করে এই কনসার্টির এলবামটি সারাবিশ্বে সে বছর সর্বাধিক সংখ্যায় বিক্রি হয়েছিল। এলবামের প্রচ্ছদে বলা হয়েছিল- বাংলাদেশে ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, যা নিঃসন্দেহে হিটলার কর্তৃক ইহুদীদের নিধনযজ্ঞের পরে দৃষ্ট জঘন্যতম বিশাল অত্যাচার। মনে পড়ে প্রায় একই সময়ে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কবি ও গায়িকা জোয়ান বায়েজ ক্যালিফোর্নিয়ার স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গেয়েছিলেন বাংলাদেশের কথা, মুক্তিকামী মানবতার দুঃখের, কষ্টের অত্যাচারের কাহিনী। এরপরে তেমনি গেয়েছিলেন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসার্টে ‘বাংলাদেশের জন্য গান’। তিনি গেয়েছিলেন, সারাবিশ্বে আদিকাল থেকে অনুসৃত ‘ভূমির জন্য জনগণকে বিসর্জন দেয়ার’ সেই সূত্র বাংলাদেশকে অত্যাচার ও অবিচারে পিষ্ট করেছে আর বিশ্ববাসী তা নিঃশব্দে সয়ে যাচ্ছে। তার গানে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠা-া মাথায় ছাত্রদের ওপর পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলিবর্ষণ ও ‘বালিশ ভিজিয়ে রক্তের’ মর্মকথা স্থান পেয়েছিল পাশ্চাত্য বিশ্বের সকল বিজ্ঞজন ও সচেতন মানুষের অনুধাবনে। ২৭ আগস্ট কারাকাসে লাতিন আমেরিকান পার্লামেন্ট পাকিস্তানকে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে পূর্ব বাংলার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে অচিরেই সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনায় আসার আহ্বান জানায়। আর এর আগেই ভিক্টোরিয়া অকাম্পো (রবীন্দ্রনাথের বিজয়া) ও জর্জ লুই বরসজের নেতৃত্বে লাতিন আমেরিকার ২৯ জন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ও আঁতেল মানবতা লঙ্ঘনের দায়ে হানাদারদের অভিযুক্ত করেন। ১৯৭১ এর ৮ বছর পরে যশোর রোড ধরে পূর্বদিকে আরও এগিয়ে এসে দেখেছি সড়কের উত্তর পাশে প্রায় লাগোয়া আনন্দবাজার গ্রাম। ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত বিভক্তির নির্মমতা থেকে রক্ষাকরণের নিমিত্ত এই গ্রামের নেতৃস্থানীয় সংবেদনশীল নাগরিকরা চলে গিয়েছিলেন কলকাতায় কয়েক বছর পর ফেলে আসা গ্রামের স্মৃতি বহনিয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন সেখান থেকেই। এদের উত্তরসূরিরাও ৭৮ এর সেই সময়ে যশোর রোড ধরে কলকাতা থেকে চোখ মুছতে মুছতে এসেছিলেন পূর্বপুরুষের আবাস আনন্দবাজার গ্রাম দেখতে। ধ্বংসের যুক্তিবিহীন নির্মমতা থেকে অসীম সাহসে ও মানবিক মূলধন নিয়ে আবার নির্মীয়মাণ সে সব বসতবাড়ি, উপাসনা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিকথা জানতে। আরও পূর্বদিকে যশোর রোড ধরে ঝিকরগাছা পার হয়ে মূল সড়ক ছেড়ে উত্তরদিকে মোড় নিয়ে তারা গিয়েছিলেন চুকনগরের দিকে। ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানীদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী এক হয়ে যেখানে জয়ী হয়েছিলেন বাংলাদেশের ঐ সময়ের সবচেয়ে বড় ট্যাংক যুদ্ধে। প্রায় সময় এই পথে পশ্চিমে গেছি বাংলাদেশের মারোয়া গ্রামের সন্নিকটে ভারতীয় সীমান্তবর্তী বয়রায়, যেখানে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে বুক মিলিয়ে মুক্তিবাহিনী স্বাধীনতার মঞ্চে উৎসর্গীকৃত দ্বিধাহীন হৃদয়ের রক্তের বিনিময়ে স্তব্ধ করেছিলেন পাকিস্তানী হানাদারদের। এ স্থানটির এই প্রেক্ষিতে জনগণের দাবির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রশাসনিক অভিপ্রায় মিলিয়ে তখন আমি নতুন নাম দিয়েছিলাম মুক্তিনগর। স্থানীয় জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের ভিত্তিতে সামনের প্রজন্মের দিশারীর আদলে জগন্নাথপুরে গড়ে তুলেছিলাম মুক্তিনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আর এর সঙ্গে জনগণের শ্রদ্ধার্ঘের সঙ্গে নিজ অনুভূতি মিলিয়ে লাগোয়া সিংহঝুলি গ্রাম যশোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ মসিউর রহমানের নামে নামায়িত করেছিলাম মসিউর নগর। মুক্তিনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খুদে গায়কদের বলেছি, ১৯৭১ সালে যশোর রোড ধরে সুনীল কি বলেছিলেন, জোয়ান কি গেয়েছিলেন, রবি শঙ্কর ও হ্যারিসন কি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বের স্বাধীনতাবিশ্বাসী জনগণকে। আর মূল যশোর রোডের পারে আরও দক্ষিণে এগিয়েছিলাম সহজে জীবন দাত্রী পানির অভাব চাপা দিয়ে গদখালিতে রজনীগন্ধার চাষ ছড়িয়ে দিয়ে নতুন করে ফুলেল সন্মোহনে বাঁচার নিলয় সৃষ্টি করণে। মনে পড়ে প্রশাসনিক ও সেবামূলক কাজ নিয়ে ১৯৭৬-৭৮ এ বার বার গিয়েছি যশোর রোড ধরে। নাভারন ও তার উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমের গ্রামগুলো দেখেছি। মনে করেছি পাকিস্তানী বর্বরতার ইতিবৃত্ত, সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য সংগ্রাম ও ত্যাগ। শুনেছি যশোর রোড এর সন্নিকটে যদুনাথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এক বালক শিক্ষার্থী কর্তৃক স্বাধীনতার পদমূলে বিসর্জনীয় সেই অবিস্মরণীয় গানের অনুকরণ- মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি। আর মুক্তিনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর কণ্ঠে শুনেছি সকল ত্যাগ ও সংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসেবে- পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল। যশোর রোড ধরে আরেক স্মৃতি জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে আমার হৃদয়ে। চুড়ামনকাঠি পেরিয়ে সেই মুক্তিনগরের আহ্বান দূর থেকেও শোনা যায়, এমনি এক গ্রাম সুবর্ণরেখায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দামামা ও হানাদারদের ভয়ভীতি ও অত্যাচার সত্ত্বেও এক হিন্দু বৃদ্ধা বাড়ির সকলে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া সত্ত্বেও তার গ্রামের শ্বশুরের ভিটা ছেড়ে যাননিÑ১৯৭৮ সালে সেই ভিটাটিই তিনি দান করেছিলেন ভবিষ্যত প্রজন্মকে, সুবর্ণরেখা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনকল্পে। বয়সের ভারে হামাগুড়ি দিয়ে সেই বুড়িমা যখন সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিলান্যাস আমার সঙ্গে করতে এসেছিলেন তার শেষ সম্বল শ্বশুরের ভিটা দান করে, তখন জেলা প্রশাসক হয়েও সকলের সামনে তাকে প্রণাম করেছিলাম আমি। এর আগে যশোর রোডের শেষ মাথায় যশোর শহরের প্রবেশ মুখে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকালে ও সরকারী অর্থায়নে তথাকথিত হরিজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য পাকা ইমারত তৈরি করে তার নামকরণ করেছিলাম সমতা প্রাথমিক বিদ্যালয়। মনে এসেছিল গিনসবার্গের যশোর রোড ধরে বাংলাদেশে আসার সেই অবিস্মরণীয় গান- শোষণ, শ্রেণীগত ও ধর্মীয় বিভাজন পার হয়ে মানবতার আহ্বানে আমাদের সাড়া দিতেই হবে। এই সমতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলাদেশ বিনির্মাণে সে বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে কি জানে। উত্তরে সে দ্বিধাহীন গলায় আমাদের, অভ্যাগত সকলের সামনে তখনকার বাংলাদেশের দখলদার স্বৈরাচারের শাসনামলে বিন্দুমাত্র ভরকে না গিয়ে গেয়েছিল : শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে উঠে রনি, বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ এর ২৬ মে হতে বার বার প্রচারিত এই গান সেখানে তারুণ্যের, অধিকারের প্রতীকÑসেই কিশোরের কাছ থেকে শুনে আমারও প্রতীতি জন্মেছিল : স্বৈরতন্ত্রের কোন ষড়যন্ত্র বা কার্যক্রম কোনদিন সেই কালজয়ী মুজিবরের আদর্শ ও আহ্বান থেকে আমাদেরকেÑ এই জাতিকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না, ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরের সেই যশোর রোড সকল বাধাবিঘœ ব্যত্যয় ছাড়িয়ে স্বাধীনতার আশীর্বাদকে বাংলাদেশের সকল প্রগতির পথে আমাদের অনুপ্রাণীত করে যাবে। মনে হয়েছে মানবতার সংগ্রাম, জয়গান আর পতাকায় এদেশের পূর্ব পশ্চিমের, উত্তর দক্ষিণের সকল রোড যেন যশোর রোডের আর্তি ও আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিশে এই কথাই বলে যাচ্ছে। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×