ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার করা না হলে দুর্বার আন্দোলন

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ১৯ অক্টোবর ২০২০

রায়হান হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার করা না হলে দুর্বার আন্দোলন

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ রায়হান হত্যার সঙ্গে জড়িতদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার না করা হলে হরতাল, সড়ক অবরোধসহ দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে। সিলেট বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ‘নির্যাতনে’ রায়হান আহমদের মৃত্যুর আট দিনের মাথায় তার পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে রবিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বক্তব্য রাখেন রায়হানের মা সালমা বেগম। সেখানে ছয়টি দাবিসহ ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ঘোষণা করেন স্থানীয় মুরুব্বি শওকত হোসেন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- রায়হান হত্যাকান্ডে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি; রায়হান হত্যায় জড়িত পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর ভূঁইয়াসহ দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার; এসআই আকবরকে গ্রেফতারে আইজিপির নির্দেশ; পুলিশ কমিশনারের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য; নিহতের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেফতার না করলে হরতাল-সড়ক অবরোধসহ বৃহত্তর আন্দোলন। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরান ও ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। উপস্থিত ছিলেন ১০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ, ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান, কাউন্সিলর তৌফিক বক্স লিপন, নারী কাউন্সিলর রেবেকা বেগম, সাবেক কাউন্সিলর জগদীশ দাশ ও রায়হানের সৎ বাবা হাবিবুল্লাহসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। সংবাদ সম্মেলনে রায়হানের মা বলেন, আমার ছেলে রায়হান আহমদকে (৩৩) গত ১১ অক্টোবর রাতে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ডেকে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নারকীয় এই হত্যাকা-ের ঘটনাটি গণমাধ্যম কর্মীরাই সবার আগে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। যা পুরো সিলেটসহ সমগ্র বাংলাদেশ, এমনকি বহির্বিশ্বেও বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। ফলে, দেশে বিদেশে সর্বস্তরের মানুষ রায়হান হত্যকারী খুনী পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে নেমে এসেছেন। তিনি বলেন, রায়হানের হত্যাকারী বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ জড়িত সব পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার দাবিতে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, রায়হান হত্যাকান্ডের প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর পুলিশী হেফাজত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। সন্দেহভাজন হত্যাকারী আট পুলিশ সদস্য এখনও পুলিশী হেফাজতে থাকলেও তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, রায়হান এক ডাক্তারের চেম্বারের কর্মচারী হিসেবে কাজ করত। গত ১০ অক্টোবর রাতের কোন এক সময় তাকে আটক করে বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ। পরে তাকে একটি সিএনজি অটোরিক্সাযোগে ফাঁড়িতে নিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আমার নিজের মোবাইলে একটি কল আসে। কল রিসিভ করলে অপর প্রান্ত থেকে আমার ছেলে রায়হান আর্তনাদ করে বলে, ‘আমাকে বাঁচাও। কিছু টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আস।’ ফোন পেয়ে রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ চৌধুরী ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। ফাঁড়ির পুলিশের কাছে রায়হানের অবস্থান জানতে চান হাবিবুল্লাহ চৌধুরী। পুলিশ জানায়, রায়হান ঘুমিয়ে আছে এবং তাকে যারা ফাঁড়িতে নিয়ে এসেছে, তারাও চলে গেছে। কর্তব্যরত পুলিশ হাবিবুল্লাহ চৌধুরীকে সকাল সাড়ে নয়টার সময় ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসতে বলে। কথামতো সকাল পৌনে ১০টার দিকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে হাবিবুল্লাহ চৌধুরী বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পৌঁছলে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা জানায়, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ চৌধুরী দ্রুত ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে উপস্থিত হয়ে জানতে পারেন, সকাল ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে রায়হানকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে রায়হান মারা যান। খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজনসহ ওসমানী হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে ছেলের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখতে পাই। এ ঘটনায় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্যদের আসামি করে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন, যা পরবর্তীতে মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়। তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যম কর্মীদের অনুসন্ধানেই জানা যায়, ১১ অক্টোবর রাতে আমার ছেলে রায়হানকে আটক করে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা জানতে পারি, বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তাকে আটকে রেখে রাতভর নির্মম নির্যাতন করা হয়। রাতেই বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির সাব ইন্সপেক্টর তৌহিদ এলাহীর মোবাইল ফোন থেকে আমাকে কল করে ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। বন্দরবাজার ফঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর আকবর ভূইয়ার নেতৃত্বে আমার ছেলেকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। রায়হানের দুই হাতের কজি ও পায়ের হাড় আঘাতের পর আঘাতে ভেঙ্গে দেয়া হয়। তার হাতের আঙ্গুলের নখ প্লাস দিয়ে টেনে তুলে ফেলা হয়। আপনাদের মাধ্যমে এসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর পুরো সিলেটবাসী তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি বলেন, নির্মম এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নিতে গড়িমসি করে। পরে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনারের (উত্তর) লিখিত নির্দেশের পর থানা কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত পুলিশের এই চিঠি চালাচালির পর্যায়েই মূল আসামি এসআই আকবর হোসেন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পুলিশ এখনও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে রায়হানের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা যত দূর জানতে পেরেছি, ওসমানী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, গুরুতর আঘাতের কারণেই রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। কিন্ত রায়হান হত্যাকারী পুলিশ সদস্যদের কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। ফলে রায়হান হত্যা মামলার ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। গুরুতর আঘাতেই রায়হানের মৃত্যু ॥ পুলিশী নির্যাতনে মৃত্যুবরণকারী রায়হানের প্রথম দফার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পিবিআইকে হস্তান্তর করা হয়েছে। রিপোর্টে রায়হানের শরীরে ১১৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। লাঠির আঘাতের কারণে চামড়া ছিলে যাওয়া ১৪টি জখম পাওয়া যায়। তার দুটি আঙ্গুলের নখ উপড়ে ফেলাসহ পুরো শরীরে শুধু লাঠির আঘাত রয়েছে ১১১টি। নির্যাতনের সময় রায়হানের পাকস্থলীও খালি ছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ শামসুল ইসলাম। তিনি বলেন, রায়হানের শরীরে ১১৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এরমধ্যে শরীরের রয়েছে ১১১টি ও দুটি হাতের নখ উপড়ানোসহ মোট ১১৩টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। একের পর এক লাঠির আঘাতের কারণেই রায়হানের পুরো শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিটি আঘাত ছিল খুবই গুরুতর। অতিরিক্ত আঘাতের কারণে রায়হানের হৃদযন্ত্র রক্ত পায়নি। সেজন্য তার মৃত্যু হয়। লাঠির আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃদপি-, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কার্যক্ষমতা হারায়।
×