ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রণেশ মৈত্র

রোহিঙ্গামুক্ত কক্সবাজার জরুরী

প্রকাশিত: ১৯:৫৮, ১৯ অক্টোবর ২০২০

রোহিঙ্গামুক্ত কক্সবাজার জরুরী

বাংলাদেশের স্বার্থে শুধু কক্সবাজারকেই রোহিঙ্গামুক্ত নয়, গোটা বাংলাদেশকেই রোহিঙ্গামুক্ত করা জরুরী প্রয়োজন। বিগত কয়েক বছর যাবত এদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সামগ্রিক আচরণ সৌন্দর্যলীলার কেন্দ্রস্থল কক্সবাজারে সৃষ্ট মারাত্মক পরিবেশ দূষণ, বেপরোয়া চোরাকারবারি, অস্ত্র ও মাদক আমদানির ভয়াবহতা এবং ব্যাপক সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে একটি বিশেষ ষড়যন্ত্র সফল করার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে তাদের অবাধ বিচরণ, কিছুতেই মিয়ানমারে না ফেরা এবং বাংলাদেশে, বিশেষ করে কক্সবাজার ও তার চতুর্দিককার সীমান্ত এলাকায় থাকার জিদে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গী-উৎপাদনের লীলাভূমিতে ওই বিশাল এলাকাকে পরিণত করা, কক্সবাজারের আদি অধিবাসীদের শুধু সংখ্যালঘুতে পরিণত করাই নয়, তাদের উৎখাত করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা, দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট প্রভৃতি সংগ্রহ করে দেশ-বিদেশে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেয়া- প্রভৃতি হেন অপকর্ম নেই যার সঙ্গে এদেশে ‘অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নেতৃস্থানীয় অংশ জড়িত নয়। যতটুকু লক্ষ্য করেছি, আমাদের সরকার মানবতার নামে যে উদারতা দেখিয়ে তাদের অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ দিতে সীমান্ত এলাকা উন্মুক্ত করে দিয়ে ‘১৬ কোটি মানুষ না হয় এক বেলা খাব তবুও রোহিঙ্গাদের অনাহারে থাকতে দেব না’ বলে সীমাহীন দয়া-দাক্ষিণ্য দেখিয়েছিলেন, রোহিঙ্গারা তাকে তাদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণ বলেই ধরে নিয়েছিল এবং সেই ধারণা থেকেই তারা নির্বিবাদে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। বাঙালীর জীবনেও নির্বিচারে ভয়াবহ বর্বর সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। যে কোন বিবেচনায় সে নির্যাতন রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন কম নয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৯৭১-এ বাঙালীর হেন বাড়ি ছিল না যা জ্বালিয়ে দেয়নি। তারা ভিন্ন ভাষার হলেও বাঙালীদের পাকিস্তানী নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছে। বাঙালীরা খাঁটি পাকিস্তানী নয়, তারা হিন্দু, তারা ভারতের প্রতি আনুগত্যশীল। তার ফলে এক কোটি বাঙালী ভারতে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, স্রেফ জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে। যে এক কোটি বাঙালী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা কেউ সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হননি। কেউ চোরাকারবারি, অস্ত্রের চোরাচালানি, মাদক পাচার, ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণের সামান্যতম চেষ্টা বা প্রয়োজনের চাইতে একদিনও বিদেশের মাটিতে থাকতে চাননি। অজস্র শরণার্থী শিবির ভারতের পূর্বাঞ্চলজুড়ে ভারত সরকার গড়ে ওই দেশত্যাগী বাঙালীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন যেমন, বাঙালীরাও তেমন নানা কষ্ট সহ্য করে সেগুলোতে অবস্থান করে কদাপি কেউ ভারতের কোন আইন লঙ্ঘন করেননি। ক্যাম্পের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় করে, মানুষ হত্যার মাধ্যমে মাদক ব্যবসা করে ক্যাম্পের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাও কেউ করেননি। মিয়ানমার সরকার যেমন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী নয়, পাকিস্তান সরকারও তেমনি দেশত্যাগী বাঙালীদের দেশে ফেরত নিতে চায়নি। বাঙালী কোনদিন দেশে নিজভূমে থাকার অধিকার পরিত্যাগ করেনি। বরং দেশে ফেরার প্রত্যয় নিয়ে নয় মাস ধরে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে নির্মমভাবে পরাজিত করে বীরের মতো দেশে ফিরে এসে দেশের জাতীয় পরিচয়পত্র, দেশের সরকারের ইস্যু করা পাসপোর্ট গ্রহণ করেছেন। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে গিয়ে ৩০ লাখ বাঙালী প্রাণ হারিয়েছেন, চার-পাঁচ লাখ নারী তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, লাখ লাখ বাড়িঘর, দোকানপাট, জমির ফসল পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছে। সে তুলনায় রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন কি কোনক্রমে বেশি? মিয়ানমার সরকার যে অভিযোগ বারংবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করে দাবি করেছে যে, রোহিঙ্গারা আরসা (AARSA) নামে সশস্ত্র জঙ্গী বাহিনী গঠন করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছিল তা কি পুরোপুরি মিথ্যা? আজ আমরা কক্সবাজারের কুতুপালং-এ রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, গোলাগুলি, জঙ্গী উৎপাদন, মাদক ও অস্ত্রের চোরাকারবারি প্রভৃতি দুর্নীতির মাধ্যমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের পাসপোর্ট অফিসগুলোকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বেআইনীভাবে সংগ্রহ করেনি? তারা আমাদের সীমান্ত বাহিনীর একাংশকে একইভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে অস্ত্র, মাদক প্রভৃতি পাচার করছে না? তারা সামগ্রিকভাবেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবনের প্রতি হুমকি। তাই দেশের স্বার্থেই যে কোন মূল্যে তাদের সকলকে দেশে ফিরতে বাধ্য করার বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। যাচ্ছে না নানা কারণে। ওখানে গেলে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশে আছে, দেশে ফিরলে খেটে খেতে হবে। এখানে বিনা পরিশ্রমে, বিনামূল্যে খাবার পাওয়া যাচ্ছে। ওখানে গেলে সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষার দায়িত্ব স্ব স্ব পরিবার প্রধানকে নিতে হবে। এখানে ওইসব দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার নিজ কাঁধে স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছে। তাদের জন্য বাড়ি, রাস্তা, স্কুল, মসজিদ-সবকিছু নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আর কি চাই? তারা এমনকি ভাসানচরেও যাবে না। বাংলাদেশ সরকারের খরচে তাদের এক বিশাল দলকে নিয়ে দেখানো হয়েছে ভাসানচরে নির্মিত তাদের আশ্রয়স্থল এবং অন্য যা কিছু স্থাপন করে একটি গ্রামীণ শহরে পরিণত করা হয়েছে। দেখে গ্রুপের সকল সদস্য সন্তোষই শুধু প্রকাশ করেনি, ওখানে যেতে তারা প্রস্তুত বলেও জানিয়েছে। পরবর্তীতে তাদের দেশী-বিদেশী মুরব্বিদের পরামর্শে ভাসানচরে যেতে অস্বীকার করেছে। ওখানে অনেক এনজিও কাজ করছে। সহায়তাও দিচ্ছে বটে। কিন্তু তারাও গোপনে উস্কানি দিচ্ছে- তারা যেন কেউ বাংলাদেশ ছেড়ে মিয়ানমার প্রত্যাবর্তন না করে। কেউ যেন কক্সবাজার ছেড়ে ভাসানচরে না যায়। তাদের স্বার্থ স্পষ্ট, রোহিঙ্গারা চলে গেলে তাদের চাকরি থাকার গ্যারান্টি থাকবে না। যে দামী দামী হোটেলে তারা বাংলাদেশে থাকছে, সেই আরাম-আয়েশ থেকে তারা বঞ্চিত হবে...ইত্যাদি। বিদেশী রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পাওয়ার পরেও কেন উদ্যোগ নিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে উদ্যোগী হচ্ছে না তাও খতিয়ে দেখা জরুরী হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাহুলাংশে থিতিয়ে পড়েছে। একে চাঙ্গা করা এবং মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তিন থেকে ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া প্রয়োজন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। রোহিঙ্গাদেরও জানানো প্রয়োজন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে যে, নির্দিষ্ট ওই সময়সীমার পর বাংলাদেশ সরকার আর একদিনও তাদের বাংলাদেশের মাটিতে অবস্থান করতে দেবে না। রোহিঙ্গারা সরকারের এমন ভূমিকা না দেখে ধরেই নিয়েছে যে, তারা চিরকাল এদেশে থাকতে পারবে। তাই তারা এমনকি ভাসানচরে যেতেও অস্বীকৃতি জানানোর ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় সুপারিশ করব- এক. আপাতত প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানো হোক অস্থায়ীভাবে। দুই. সরকার যে সময়সীমা বেঁধে দেবে তার একদিনও বেশি কোন রোহিঙ্গাকে এদেশে কোনক্রমেই থাকতে দেয়া যাবে না। এই কথা স্পষ্টভাবে মিয়ানমার সরকার ও রোহিঙ্গাদের জানিয়ে দেয়া হোক। তিন. যারাই রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরতে বা ভাসানচরে যেতে বাধা দিচ্ছে অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে রেখে ক্যাম্প থেকে বিচ্ছিন্ন করা হোক। চার. নির্দিষ্ট সময়সীমার পরে সংশ্লিষ্ট কোন এনজিওকে বাংলাদেশে বা কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম এলাকায় কাজ করতে দেয়া যাবে না। পাঁচ. ২০২১ সালের জুলাই-আগস্ট থেকে বিদেশী পর্যটকদের ব্যাপকহারে কক্সবাজার-রাঙ্গামাটির নানা স্থান পর্যটন করতে আসতে বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। ছয়. সরকারের এই স্থির সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও জানিয়ে দেয়া হোক। লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত [email protected]
×