ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে কারা অন্তরায়

প্রকাশিত: ১৯:৫৪, ১৯ অক্টোবর ২০২০

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে কারা অন্তরায়

একটি দেশের উন্নয়ন যেমন সরকারের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, তেমনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নাগরিকদের টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতকরণ সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা ছুটে চলেছে অবাধ গতিতে। সারা বিশ্ব যখন করোনা যুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে এই যুদ্ধ সফলভাবে মোকাবেলা করে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এটা অবশ্যই সরকারের বিশেষ সাফল্য। তবে সমাজের সর্বস্তরে নীতি আদর্শের বিচ্যুতি ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি দক্ষতা ও কঠোরতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে উন্নয়নের প্রলেপে আবৃত সাজানো ঘর ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যাবে। মাদকের বিস্তার, সহজলভ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল ভিডিওর ছড়াছড়ি, আইনের প্রতি উদাসীনতা ও যথার্থ প্রয়োগের অভাবের কারণে ধর্ষণ হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধ চরম আকার ধারণ করেছে। মাঝে মধ্যে জাতীয় পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে হত্যা বা ধর্ষণের ঘটনা উঠে এলেই তখন সবার নজরে আসে এবং প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে সংক্ষুব্ধরা বিচার পায়। তা না হলে এ ধরনের অধিকাংশ ঘটনা বা মামলা লালফিতায় আবদ্ধ হয়ে বছর/যুগ পেরিয়ে গেলেও বিচারের মুখ দেখে না। একেবারে উপজেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত স্থানীয় প্রশাসন, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা গ্রাম পর্যায়ের টাউট, রাজনৈতিক লেবাস পরিহিত কিছু তথাকথিত নেতা, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের কিছু ডাক্তার, স্থানীয় বিচার বিভাগের অনেকে, আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা ও সর্বোপরি সরকারের মূল কেন্দ্রের আশপাশের কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তির সম্মিলিত প্রয়াসে অনৈতিক কার্যক্রম নির্র্দ্বিধায় চলমান আছে। আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে উদাহরণ হিসেবে নাম উল্লেখ না করে একটি জেলার কিছু তথ্য তুলে ধরলাম। একটি গ্রামে স্থানীয় দুই দলের সংঘর্ষ ও পরবর্তীতে থানায় দুই পক্ষের মামলা। মামলাকে কেন্দ্র করে নাম অন্তর্ভুক্তি ও অব্যাহতি বাণিজ্যে কখনও কখনও ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা লেনদেন হয়। একটি মামলায় দুই পক্ষে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ জন আসামি হয়। উল্লেখ্য, মামলার ধারা জামিন অযোগ্য করার জন্য মহৎ পেশায় নিয়োজিত ডাক্তার সাহেবদের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। অনেক ডাক্তার এক্ষেত্রে চড়া অর্থের বিনিময়ে রিপোর্ট এ ‘ধারালো অস্ত্র ব্যবহার’ এবং ‘গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত’ লিখে দেয়। যার ফলে মামলার ধারাগুলো জামিন অযোগ্য হয়ে পড়ে। এরপর আসি এক পক্ষের বিরুদ্ধে অন্য পক্ষের মামলা আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বাদী পক্ষ তাদের পক্ষের মহিলা/পুরুষদের, ডাক্তারদের সহযোগিতায় এনেসথেসিয়া ব্যবহার করে মাথার চামড়া হাল্কা করে কেটে আবার সেলাই করে দেয়। প্রথম পর্বের এখানেই শেষ। দ্বিতীয় পর্ব এবার আদালত। অনেক ক্ষেত্রে জামিন অযোগ্য ওভারটেকের আসামিদের অর্থাৎ, সরাসরি অস্ত্র দিয়ে আঘাতকারীদের প্রথম আবেদনেই জামিন মঞ্জুর, হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত করা কিংবা হত্যা মামলা এমনকি ধর্ষণ মামলাসহ সব মামলার আসামি পর্যায়ক্রমে জামিন পেয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে লেনদেন অথবা সরাসরি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ আছে। এসব আসামি জামিন পেয়ে অবাধ বিচরণের কারণে আইনের প্রতি জনগণের আস্থায় দিন দিন চিড় ধরছে এবং এর কারণে মানুষ আরও সহিংস হয়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে মাদক, সন্ত্রাস ও অনৈতিক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স চলছে। অন্যদিকে ওই জেলায় জুয়ার বোর্ড নিয়ন্ত্রণকারী জুয়াড়ি স¤্রাটবিরোধী দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে আছেন। এমনকি তার অবৈধ অর্থের দাপটে স্থানীয় সরকারী দলের নেতারা কোণঠাসা। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ভাতা দিচ্ছেন, গৃহহীনকে ঘর দিচ্ছেন, বিনে পয়সায় খাদ্য দিচ্ছেন। এর সুফল সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না সর্বক্ষেত্রে। কারণ উপকারভোগী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে সেই উপকারটা কিনে নিচ্ছেন। এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় সৌরবিদ্যুত স্থাপনে দুর্নীতি, এডিবির অর্থের সঠিক ব্যবহারে ত্রুটি এবং উপজেলাভিত্তিক ধান-চাল সংগ্রহে ব্যাপক দুর্নীতি বিদ্যমান। ২-৩টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সারাদেশে এর নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রকৃত কৃষক ১০ থেকে ২০% এর অধিক ধান বা চাল দিতে পারছে না বলে অভিযোগ আছে। এ ক্রয় প্রক্রিয়ায় ২-৩টি প্রতিষ্ঠান তাদের ধান-চাল ক্রয় বাণিজ্য অভিনব কায়দায় চালিয়ে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। সারা দেশে যা সার আমদানি হয় তার নিয়ন্ত্রণ করে হাতেগোনা দু’একজন এবং প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে এসবের তদন্ত প্রয়োজন। দুর্নীতির কিছুটা হাল টেনে ধরতে পারলে ১০-২০টি পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করা কোন ব্যাপার নয়। একই জেলার অধীনে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স এ রোগীদের খাদ্য সরবরাহের কাজ করে যাচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১২ বছর ধরে। সম্প্রতি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সহযোগিতায় জেলার সিভিল সার্জনের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একই সরবরাহকারীকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির এটি আরেকটি খন্ড চিত্র মাত্র। উপরে উল্লিখিত জেলার অধীনে একই উপজেলার একজন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্থানীয় সাংসদ (যিনি দল ও সংসদে উচ্চ পদে আসীন) লিখিত অভিযোগ করেছেন এবং পরবর্তীতে আরও কিছু অভিযোগ, যা বিভাগীয় ব্যবস্থার পর্যায়ে পড়ার কথা। তিনি নিউক্লিয়াসকে আবর্তনকারী কক্ষপথের শক্তিধর কর্মকর্তার সরাসরি হস্তক্ষেপে বহাল তবিয়তে তার কার্যস্থলে বসে রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। এভাবে প্রতিটি পর্যায়ে অরাজকতা চললে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দানে প্রধানমন্ত্রীর সব উদ্যোগ বালির বাঁধের মতো ভেসে যেতে পারে। এখনই প্রয়োজন সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে অন্যায়কারীদের দৃষ্ঠান্তমূলক বিচার এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানে চেন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা। বঙ্গবন্ধু আমাদের শৃঙ্খলমুক্ত করেছেন আর প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন অর্থনৈতিক মুক্তি। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ ও জাতি সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ইস্পাতদৃঢ় বলিষ্ঠ পদক্ষেপই পারে সমাজে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×