ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্র-লালনের পথে একদিন

প্রকাশিত: ০০:০৬, ১৮ অক্টোবর ২০২০

রবীন্দ্র-লালনের পথে একদিন

দিনটি ছিল শনিবার। ক্যাম্পাস জীবনের প্রথম শিক্ষাসফর। খুব সকালে অনেক আবেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। কিছুটা শীত শীত ভাব। গোসল করব? না করব না এমন একটা অবস্থা। তাও পরে গোসল করে নিলাম। এক বড় ভাইয়ের ফোন আসল, ‘লাবু রেডি হয়েছ তো? হ্যাঁ, ভাই আমি রেডি। ও আচ্ছা, ভাল। তোমার সহপাঠীদেরও ফোন দিয়ে রেডি হতে বল, ঠিক আছে ভাই।’ আমি আমাদের শ্রেণী প্রতিনিধি ছিলাম, তাই সবাইকে জানিয়ে দিলাম। যে বাসায় ভাড়া থাকতাম সেখান থেকে ক্যাম্পাস প্রায় দু-কিলোমিটারের পথ। ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম। তখনও আবছা আবছা অন্ধকার চারদিকে। রিক্সা না পেয়ে হেঁটেই চলতে শুরু করলাম। একা হাঁটছি। রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা দুই একটা কুকুর আঁড় চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। কুকুরকে অনেক ভয় পাই তাও সেদিন কেন যেন ভয় লাগছিল না। এদিকে শুরু হলো শীতের সকালে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। কাপড়-চোপড় হালকা ভিজেই গেল। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তাও ক্যাম্পাসে গিয়ে পৌঁছালাম। গিয়ে দেখি, আমার আগেই আরও কয়েকজন এসেছে, গাড়িও চলে এসেছে। ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে, একে একে সবাই জড়ো হলাম বড় ভাই আপুরা এলো, একটু পরে স্যারও এলো। আমরা একে একে চাল, ডাল, ডেকচি-পাতিল, জ্বালানি কাঠসহ সকল মালপত্র গাড়িতে তুললাম। পরে সবাই যার যার জায়গা মতো বসলাম। গাড়ি ছাড়ল। উফ্! অনেকদিন পর যেন কোন এক বন্দনগর থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি পেলাম। সবাই গান শুরু করল, কেউ গাইছে আবার কেউ তালে তাল মিলিয়ে নাচছে। আর আমি জানালা দিয়ে সবুজ মাঠ দেখছি। শহরে অনেক দিনধরে থাকায় সবুজ মাঠ দেখি হয়নি বেশ কিছুদিন। আমি গ্রামে বড় হয়েছি, সবুজ মাঠ দেখতেই অভ্যস্ত আমি। গাড়ি থেকে রাস্তার ধারে দেখি অনেক কৃষক জমিতে রোপা গাড়ছেন। এসব দেখে নিজেকে অনেক ভাললাগছে। যেন চিরচেনা গ্রামের আমেজ পাচ্ছি। আমাদের সকালের নাস্তা দেয়া হলো। ডিম, কলা আর বিস্কিট দিয়ে নাস্তা করলাম। খাওয়া শেষে আবারও সকলে মিলে গান শুরু করলাম। আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল আমরা তিন জায়গায় ভ্রমণ করব। প্রথমত রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি, তারপর লালন শাহ্ মাজার, আর হার্ডিঞ্জ সেতু। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে যখন আমরা তখন এক বড় ভাই আমাদের বলল ওই যে দেখ হার্ডিঞ্জ সেতু, সকলেই নাচ-গান বাদ দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে জানালার পাশে উঁকি দিয়ে গাড়ি থেকেই দেখতে লাগলাম হার্ডিঞ্জ সেতু, দেখলাম সত্যিই এর বিশালতা অনেক। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম রেলসেতু হিসেবে পরিচিত। পাবনা জেলার পাকশী রেলস্টেশনের দক্ষিণে পদ্মা নদীর ওপর এই সেতুটির অবস্থান। দেখতে দেখতে সেতু এক সময় শেষ হয়ে গেল, আবারও সবাই যার যার আসনে বসে পরলাম। তখন দুপুর ১২টা। আরেক বড় ভাই সবাইকে জানিয়ে দিল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা কুঠিবাড়িতে পৌঁছাব। শুনে সবাই তখন আরও বেশি আনন্দিত হয়ে উঠল, নাচা-গাওয়ার পরিমাণ তখন আরও বেশি বেড়ে গেল। দুপুর ১টা। গাড়ি রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে পৌঁছাল। দীর্ঘ ভ্রমণের পর সকলে নিজেদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছালাম। সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। তারপর আমাদের জিনিসপত্র একে একে গাড়ি থেকে নামালাম। তারপর সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলাম তাঁবু স্থাপন করার কাজে। তাঁবু স্থাপন করলাম কুঠিবাড়ি থেকে একটু সামনে। তাঁবু স্থাপন শেষে সবাই মিলে গেলাম রবীন্দ্রনাথের অমর কীর্তি সেই কুঠিবাড়ি দর্শন করতে। প্রথমে টিকেট কাটা হলো, পনেরো টাকা করে টিকেট। আমাদের শিক্ষক একসঙ্গে সকলের টিকেট কেটে নিল। ৫৪ জনের মতো হয়ত ছিলাম, ঠিক মনে করতে পারছি না। গেটম্যান আমাদের গুনে গুনে ভেতরে প্রবেশ করতে দিল। শিলাইদহে রবিঠাকুরের বাড়িটা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। বাড়িটা দেখতে অনেকটা বাংলো টাইপের। তবে সেটা তিন তলা পর্যন্ত লম্বা। ইট-কাঠ আর টিন দিয়ে বানানো বাংলোটা কিন্তু অবিকল আগের মতোই আছে। কুঠিবাড়িটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে বিবেচিত। তাই আমিও সেটাকে জাদুঘরই বলব। ভেতরে প্রবেশ করে গুনে দেখলাম পুরো জাদুঘরটিতে প্রায় আঠারটি কক্ষ, সতেরোটি দরজা ও ত্রিশটি জানালা আছে। জাদুঘরটির নিচতলা আর দ্বিতীয়তলা মিলে দেখলাম ষোলোটি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখলাম, রবিঠাকুরের নানা বয়সের বিচিত্র ভঙ্গির ছবি দিয়ে ছবি সজ্জিত ছিল প্রতিটি কক্ষ। একেবারে বাল্যকাল থেকে শুরু করে মৃত্যুসজ্জার ছবি পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে। সেখানে রবিঠাকুরের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র। তিনি কোথায় বসে লিখতেন, কোন পালঙ্কে ঘুমাতেন। এমনকি কোন থালায় খাবার খেতেন, তাও দেখলাম সেখানে। ব্যবহার্য জিনিসগুলোর ভেতর দেখলাম সেখানে আছে চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটো স্পিডবোট,পল্টুন, আট বেহারার পালকি, কাঠের চেয়ার, টি টেবিল, সোফাসেট, আরাম চেয়ার, পালংকসহ আরও অনেক কিছু, যেগুলোর নাম আমি মনে করতে পারছি না। জাদুঘরটির তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখলাম একটি কামড়া, শুনলাম সেই কামড়াটিতে নাকি রবিঠাকুর বসে বসে লেখা-লেখির কাজ করতেন। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, প্রায় ১১ একর জায়গার উপরে আম-কাঁঠাল আর নানা জাতের ফলের গাছের বাগান। দেখলাম বিশাল বড় এক ফুলের বাগান। আরও দেখলাম বেশ বড়সড় ২টি পুকুর। পুকুর পাড়ে গিয়ে সবাই মিলে আমরা বসলাম, স্যার-ম্যাম ও আমাদের সঙ্গ দিল। সবাই মিলে বসে বসে সেখানে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফি খেলাম। কুলফি খাওয়া শেষে সবাই মিলে ফিরে আসলাম নিজেদের তাঁবুতে। যখন সবাই আনন্দে মেতে আছে, তখন ঘটল আরেক ঘটনা! আমাদের এক বান্ধবীর মোবাইল ফোন হারিয়ে গেল। শুনে সবাই কিছুটা বিষণœতায় ভুগতে লাগল। কিছু খেলাধুলা নির্ধারিত করা ছিল। ছেলেদের বেলুন ফোটানো আর মেয়েদের বল বদল। মেয়েদের খেলাতে রেফারি থাকার জন্য আমার চোখ বেঁধে দেয়া হলো। খেলা পরিচালনা করলাম। ছেলেদের খেলাতেও আমাকেই রেফারি রাখা হলো। যেখানে আমি খেলোয়ার হিসেবে থাকার কথা সেখানে হলাম রেফারি! যাহোক তাও ভালই লাগছিল। খেলাধুলা শেষে বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করা হলো। সবাই দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া শেষে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে গেলাম ঘোড়ার পিঠে উঠতে। ঘোড়ার পিঠে আমরা না উঠে, উঠালাম আমাদের এক বান্ধবীকে। ভাবছিলাম সে ভয় করবে, ভয়ে কেঁদে দেবে, কিন্তু আমাদের আশা পূর্ণ হলো না। সে অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিল। তারপর আবার আমরা ফিরে আসলাম তাঁবুতে। ততক্ষণে তাঁবু গাড়িতে তুলে ফেলা হয়ে গেছে। সবাই গাড়িতে উঠেও পড়েছে। আমরাও গাড়িতে উঠলাম। স্যার বলল সময় বেশি নাই আমরা লালন শাহ্ মাজারেও যাব। ফেরার পথে আমরা লালন শাহ্র মাজার পরিদর্শন করলাম। পরিদর্শন শেষে বাসার দিকে রওনা দিলাম। আর সেখানে রেখে আসলাম কিছু স্মৃতি, যা কখনোই ভোলার নয়।
×