ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান হত্যা ॥ পিবিআইর দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ

এখনও উত্তাল সিলেট, নগরবাসীর প্রশ্ন এসআই আকবর কোথায়

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ১৮ অক্টোবর ২০২০

এখনও উত্তাল সিলেট, নগরবাসীর প্রশ্ন এসআই আকবর কোথায়

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ পুলিশী নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু ঘটনার সাতদিনে পেরিয়ে গেলেও এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। রায়হান হত্যার ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (বরখাস্ত) এসআই আকবর হোসেন ভূইয়ার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক হিসেবে দেখছেন সচেতনমহল। তার পালিয়ে যাওয়ার পেছনে কারা সহযোগিতা করেছে সেটাও আলোচনা আসছে। ঘটনার পর থেকে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হওয়া দুই এএসআই এবং চার কনস্টেবল পুলিশের পাহারায় সিলেট পুলিশ লাইন্সে রয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য ইতোমধ্যে কাষ্টঘর এলাকার সুইপার কলোনির সুলাই লালসহ দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। হোতা এসআই আকবর হোসেনসহ জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে এখন উত্তাল সিলেট। বিক্ষোভ প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। সবার কাছে এখন প্রশ্ন আকবর হোসেন ভূইয়া কোথায়? সিলেট মহানগর পুলিশের লাপাত্তা এই অফিসারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। সিলেটে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি। রায়হান আহমদ হত্যার দায়ে প্রধান অভিযুক্ত ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এস আই আকবরের নানান কুকর্ম নগরীতে আলোচিত হচ্ছে। এবার নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে এসআই শাহিন মিয়ার নাম। আকবর বরখাস্ত হওয়ার পর বন্দরবাজার ফাঁড়ির দায়িত্ব দেয়া হয় এসআই শাহিন মিয়াকে। এসআই শাহিন মিয়াকে বন্দরবাজার ফাঁড়ির দায়িত্ব প্রদানের পর থেকেই শুরু হয় সমালোচনা। এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-জোয়া খেলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। শাহিনের জোয়া খেলার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় সমালোচনা। এর প্রেক্ষিতে এসআই শাহিনকে বন্দরবাজার ফাঁড়ির দায়িত্ব থেকে শুক্রবার অব্যাহতি দেয়া হয়। তবে শাহিন মিয়াকে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্ব প্রদানের বিষয়টি অস্বীকার করে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, শাহিনকে বন্দরবাজার ফাঁড়ির দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এখনও এই ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এসআই শাহিনকে বিমানবন্দর থানায় বদলি করা হয়েছে। জানা যায়, শাহিন মিয়ার বিরুদ্ধে জুয়া, মাদক ও চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ থাকাকালে তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে শাহিনকে প্রত্যাহার করে কোতোয়ালি থানায় নেয়া হয়। এরপর দক্ষিণ সুরমা থানার কদমতলী বাস টার্মিনাল ফাঁড়িতে বদলি হন তিনি। সেখানে দায়িত্ব পালনকালে শাহিন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কদমতলীতে এক বছর দায়িত্ব পালন শেষে বদলি হন নগরীর শাহপরান থানায়। দায়িত্ব নেন উপশহর পুলিশ ফাঁড়ির। এরপর বদলি হয়ে যান এসএমপির মোগলাবাজার থানাতে। সেখানে গিয়ে আলমপুর পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্ব পান তিনি। এর ৫-৬ দিন পরই বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের ফলে নগরীর আখালিয়া নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান আহমদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার মূল অভিযুক্ত ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর। যিনি বরখাস্ত হয়ে পলাতক রয়েছেন। এরপর বুধবার বিকেলে এসআই শাহিনকে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্ব দেয়া হয়। সিলেটে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে দায়িত্ব পালন করে এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া। বিশাল অর্থের মালিক হয়েছেন। টাকা কামিয়েছেন দুই হাতে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ইনচার্জ হিসেবে আসেন এক বছর ২ মাস আগে। এই ১৪ মাসে নিজ এলাকায় নামে-বেনামে অনেক জায়গা কিনেছেন আকবর। ফাঁড়িতে নির্মমভাবে নির্যাতনের ফলে যুবক রাহয়হানের মৃত্যুর পরই একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে আকবরের অর্থ রোজগার আর অত্যাচরের অজানা কাহিনী। এতদিন আকবরের ভয়ে তটস্থ থাকলেও তার পলায়নের পর থেকে মুখ খুলতে শুরু করেন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার অনেক মানুষ। করোনাকালেও এসআই আকবরের জুলুম, নির্যাতন ও চাঁদাবাজি অব্যাহত ছিল। হাসান আহমেদ চৌধুরী নামের এক ব্যবসায়ী জানান, ‘লালদীঘি (পুরাতন) হকার্স মার্কেট’র নাফিসা এ্যান্ড তায়্যিবা শাড়িঘর নামে তার কাপড়ের দোকান রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে লকডাইন চলাকালীন তিনি তার ছোট ভাইকে দোকানের মালামাল মুছে ঠিকঠাক করে রাখতে একদিন দোকানে পাঠান। তার ছোট ভাই মার্কেটে গিয়ে দোকান খোলার আগেই আকবর মোটরসাইকেলযোগে এসে হাসানের ছোট ভাইকে ধরে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যান। খবর পেয়ে হাসান ফাঁড়িতে গেলে তাকেও আটকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেন আকবর। এ সময় আকবর ও তার ফাঁড়ির অন্য এক পুলিশ ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। ২০ হাজার টাকা না দিলে বিভিন্ন মামলায় ঢুকিয়ে তাদের দুই ভাইকে কোর্টে চালান করে দেবেন বলে হুমকি দেন আকবর। পরে হাসান আহমদ অনেক অনুনয় করে ৫ হাজার টাকা দিয়ে আকবরের হাত থেকে মুক্তি পান। লালদীঘিরপার পুরাতন হকার্স মার্কেটের ৪ নং গলির দোকান সিয়াম কালেকশনের স্বত্বাধিকারী এনামুল হক বলেন, এ মার্কেটের প্রায় সব ব্যবসায়ীকে (লকডাউন ছাড়া) করোনাকালীন সময়েও এসআই আকবরকে টাকা দিয়েই দোকান খুলতে হতো। এ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আকবর নিজে গিয়ে চাঁদা তুলতো। পুরো ‘লালদীঘি (পুরাতন) হকার্স মার্কেট’র ব্যবসায়ীদের কাছে এক মূর্তিমান ত্রাস ছিলেন খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা আকবর। এনামুল হক জানান, মার্কেটের এক ব্যবসায়ীকে কয়েকদিন আগে মজলিস রেন্টুরেন্টের সামনে থেকে ধরে ফাঁড়িতে নিয়ে যান আকবর। পরে এক নিশিকন্যাকে দিয়ে মামলার হুমকি দিয়ে ওই ব্যবসায়ীর কাছে আকবর ৮ হাজার টাকা দাবি করেন। ওই ব্যবসায়ী তখন দোকান থেকে কর্মচারীর মাধ্যমে ৮ হাজার টাকা নিয়ে আকবরকে দিয়ে তার হাত থেকে ছাড়া পান। এর আগে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরও রাখেন আকবর। ব্যবসায়ী এনামুল হক আরও বলেন, নিরীহ ব্যবসায়ীদের বৈধ মালামালের গাড়ি আকবর ধরে নিয়ে যেতেন ফাঁড়িতে। পরে টাকা দিয়ে মালামাল ছাড়িয়ে আনতেন ব্যবসায়ীরা।
×