ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমি নারীবাদী নই আমি মানবতাবাদী প্রশ্ন ওঠে...

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ১৮ অক্টোবর ২০২০

আমি নারীবাদী নই আমি মানবতাবাদী প্রশ্ন ওঠে...

মোরসালিন মিজান ॥ পৃথিবী এগিয়ে চলেছে। সামনের দিকে তাকিয়ে সবাই। কিন্তু একই সময়ে অবাক করছে বাংলাদেশ। এখানে নারীরা ভাল নেই। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে হঠাৎই বেড়ে গেছে ধর্ষণ। ঘটছে ভয়াবহ সব নির্যাতনের ঘটনা। কী গ্রাম, কী শহর সর্বত্রই পুরুষ হয়ে উঠছে নিষ্ঠুর। নারীকে আগলে রাখার পরিবর্তে তাদের সঙ্গে হিংস্র আচরণ করছে। এ অবস্থায় বিবেকবান মানুষ মর্মাহত। কষ্টে কাতর। একই সঙ্গে চলছে জোর প্রতিবাদ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে হলো গান, কবিতা ও নাটক। শিল্পের ভাষায় ধর্ষণের শিকার নারীর আর্তনাদ যেমনি তুলে ধরা হলো তেমনি পুনর্ব্যক্ত করা হলো বিচারের দাবি। করোনা প্রাদুর্ভাবেরকালে দীর্ঘ বিরতির পর এদিনই প্রথম শহীদ মিনারের প্রশস্ত খোলা সিঁড়িতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ক’দিন আগে বৃক্ষশোভিত প্রান্তরে দুটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো গতকালই। বিকেলের আয়োজন শুরু হয় আলোচনা দিয়ে। এ সময় আয়োজকদের পক্ষে জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, দেশে সম্প্রতি লাগাতারভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা এতে ক্ষুব্ধ। এ অন্যায় যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে। এ জন্য ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সকলকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এককভাবে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা শ্রেণী দ্বারা এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে প্রথম দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রের ওপর। রাষ্ট্রের প্রতিটি অর্গানকে সক্রিয় হতে হবে। আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের আলাদা আলাদা দায়িত্ব রয়েছে। যার যার দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করার কোন বিকল্প নেই। ধর্ষণ প্রতিরোধে ব্যক্তি ও সমাজের দায় সম্পর্কেও সচেতন করার চেষ্টা করেন তিনি। স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রের ভূমিকার যেমন সমালোচনা করব তেমনি নিজের দায়ও অস্বীকার করা চলবে না। প্রত্যেক বাবা-মাকে নিজের সন্তানের খোঁজ রাখতে হবে। পারিবারিক মূল্যবোধ শেখাতে হবে তাদের। মানবিক মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। যে কোন বয়সী ছেলে-মেয়ের হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন তুলে দেয়ারও সমালোচনা করেন তিনি। বলেন, সবদিক থেকে প্রস্তুত না করে বাচ্চাদের হাতে এন্ড্রয়েড ফোন তুলে দেয়ার কারণে তারা ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। সমাজবদ্ধ মানুষের প্রতিরোধও খুব জরুরী। নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যসূচী পরিবর্তনেরও আহ্বান জানান তিনি। অনুষ্ঠানে আবৃত্তি শিল্পী মাসুদ্দুজ্জামান বলেন, আমি যখন আমার মাতৃস্থানীয় কন্যা বা ভগ্নিস্থানীয় কারও দিকে তাকাই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এই কি কাম্য ছিল? প্রতিনিয়ত ধর্ষণের মতো বর্বর ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। এ অবস্থায় আজ ভাবতে হবে, আসলে আমরা কি করতে পারি? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে হবে। তা না হলে শুধু প্রতিবাদী অনুষ্ঠান করে সুফল পাওয়া যাবে না। দাবির মুখে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে নতুন আইন করেছে। কিন্তু তাতেই কি অপরাধ কমবে? আইন কার্যকর করা ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সকলকে সামাজিকভাবে, পারিবারিকভাবে, মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। অনুষ্ঠানে বেশ কয়েক বাচিক শিল্পী কবিতার ভাষায় নারীর অন্তর্দহন ও অবদমিত হওয়ার চিত্র তুলে ধরেন। খ্যাতিমান কবি শঙ্খ ঘোষ থেকে আবৃত্তি করেন শিল্পী সুরাইয়া ইসলাম। তার কণ্ঠে একটু আনন্দে বাঁচার আকুতি। সে আকুতি জানিয়ে শিল্পীর উচ্চারণ : ‘নিভন্ত এই চুল্লীতে মা/একটু আগুন দে/আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি/বাঁচার আনন্দে...। নূরজাহান আক্তার কেয়া মানুষ হয়ে ওঠার ওপর জোর দেন। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় : ‘আমি নারীবাদী নই/আমি মানবতাবাদী/।’ একক সঙ্গীতেও পরিস্ফুট হয় প্রতিবাদ। আবিদা রহমান সেতু গেয়ে শোনান ‘ইতিহাস আমাদের লড়বার...আমরা তো থামবো না থামবো না’ গানটি। এভাবে গান, কবিতায় এগিয়ে চলা অনুষ্ঠান শেষ হয় নাট্য প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। নাটনন্দন পরিবেশন করে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বিরোধী নাটক ‘দেয়ালের কান্না।’ রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন আসমা আক্তার লিজা। মাত্র ১২ মিনিটের প্রযোজনা উপস্থিত দর্শকদের আপ্লুত করে। এদিন ধর্ষণের প্রতিবাদে প্রতি শনিবার এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণাও দেয় সাংস্কৃতিক জোট।
×