ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দিপা সিনহা

করোনার প্রভাবে পাল্টে যাবে ভবিষ্যতের পৃথিবী

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ১৮ অক্টোবর ২০২০

করোনার প্রভাবে পাল্টে যাবে ভবিষ্যতের পৃথিবী

নভেল কোভিড-১৯। যার অদৃশ্য মরণ ফাঁদে গোটা পৃথিবীর মানুষ আজ আতঙ্কিত-স্তম্ভিত। কোভিড-১৯ এর কাছে কোন ক্ষমতাধরের ক্ষমতা প্রয়োগের কোন সুযোগ নেই। সকলেই আজ পরাস্থ, পর্যুদস্ত। তবে এই মহামারীর ওষুধ ও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের যুদ্ধে জয়ের আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সবাই কিছুটা হলেও স্বস্থিবোধ করছে, যদিও তা এখনও সময়সাপেক্ষ। তবে মহামারী করোনার উর্ধমুখী গতি থামছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে করোনার সময়কাল আরও দীর্ঘায়িত হবে। এদিকে জীবনযুদ্ধে চিকিৎসার সব পথ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কোভিড-১৯ এর টেস্ট, অক্সিজেন ও অন্যান্য প্রতিরোধ সামগ্রী নিয়ে শুরু হয়ে গেছে ‘বাণিজ্যের তুফান’। অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে যোগ হয়েছে এখন দৃশ্যবান শত্রু। এসব দৃশ্যবান শত্রু মানুষের মৃত্যু আতঙ্কে বড়ই আনন্দিত ও উল্লসিত। নিজেদের জীবন নিয়ে তারা মোটেও শঙ্কিত নয়। এই পৃথিবীর বুকে বহু মানুষ আছেÑযাদের ভেতর শুধুই অহমিকা, দাম্ভিকতা ও ক্ষমতা জাহিরের মতো একটা যুদ্ধাংদেহী ডাক সর্বক্ষণ বিরাজ করত। আজকের এই পাল্টে যাওয়া পৃথিবীতে সেই সব দাপুটে মানুষের অন্তরাত্মাও কোভিড-১৯ এর দাপটের কাছে কুপোকাত। অনিশ্চিত জীবনের এমন অসহায় মুহুর্তে সৃষ্টির্কতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া কোন পথ নেই। তবে একটা বিষয় আজ স্পষ্ট যে, করোনার ‘ভয়াল থাবা’ আমাদের সমাজের নষ্ট মানুষের বুকে এতটুকুও কম্পন সৃষ্টি করতে পারেনি। আমাদের দেশটা যখন প্রায় সম্পূর্ণ ‘লকডাউন’ অবস্থায় ছিল চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল, ঘরে বসে আমাদের যখন শুধুই দেখতে হয়েছিল উন্নত বিশ্বের ‘গণকবর’, এমন দুঃসময়েও আমাদের দেখতে হয়েছিল খুন-ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন আর চালচুরি, গম চুরির মতো সব ঘটনা। এমন শুনশান নীরবতাতেও খুন হওয়া লাশের খ-িত এক একটি টুকরো বা অঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এদিকে মহামারী ব্যপক আকার ধারণ করেছে। রোগীর চিকিৎসা তো পরের কথা ‘করোনা উপসর্গ’ নিয়ে পথের মধ্যেই মানুষের মৃত্যু ঘটছে। জীবনই যেখানে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সেখানে কিসের লোভ-লালসা আর হিংসা-বিদ্বেষ? অথচ এসব মানুষ এতটাই অমানবিক যে সময়কাল পরিস্থিতি, আইন সব কিছুই এদের কাছে তুচ্ছ। জীবন আর জীবিকার কষাঘাতে মানুষ যেন দিশেহারা। মানুষের জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গণমাধ্যম-কর্মীর অনেককেই আকস্মিক জীবন দিতে হয়েছে। দেশের সরকার এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞ ব্যক্তিরা এই ভঙ্গুর অর্থনীতিতে মানুষের জীবিকার তাগিদে, কর্মসংস্থানকে টিকিয়ে রাখতে যেখানে রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়েও সমাজের নির্বোধ কিছু পশু সমতুল্য মানুষ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে চলেছে। বড় দুর্ভাগ্য আমাদের যে, এমন দুঃসময়েও ওদের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই আজ মনে হচ্ছে, ওদের মানসিকতার এতটা বিকৃতি ঘটল কি করে? ওদের মস্তিষ্কটা কি জং ধরে গেছে? এদের তো এক প্রকার মানসিক রোগগ্রস্তই বলা যায়। আজ মানুষের মনোবলকে অক্ষুণœ ও স্বতঃর্স্ফূত রাখতে মনোচিকিৎসকগণ পর্যন্ত মিডিয়ার মাধ্যমে নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন। সকল বয়সী মানুষেরই পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তারা। যে কারণে, মনে প্রশ্ন জাগছে যে, এসব পশুতুল্য মানুষের ‘মস্তিষ্কের অনুভূতি শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে কোন ব্যবস্থাপত্রই কি কারও হাতে নেই? পথে ফেরানোর কোন পথই কি ওদের জন্য নেই? ওদের জন্য কি শুধুই, জেল, হাজত আর ফাঁসির মঞ্চ? এমন অনিশ্চিত সুখের পেছনে ছুটে লাভ কি? মুখোশটা তো এক দিন খুলেও যেতে পারে অতিলোভের চাপে। তবে, আজকের এই করোনাভাইরাস ভবিষ্যত পৃথিবীকে যে অনেকটা পাল্টে দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। জীবনের তাগিদে মানুষ নতুন করে বাঁচতে শিখবে। জীবন যত কঠিন হবে, মানুষের লড়াইয়ের ক্ষমতাও ততটাই শক্তিশালী হবে। আজকের দিনে ত্রাণের চুরি হওয়া চালের ট্রাকের পেছনে ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন ছুটছে, ঠিক তেমনি আগামীতেও ছুটবে। মানুষের কষ্টার্জিত অর্থকে প্রতারণার মাধ্যমে নিজের পকেট বন্দীর দিন শেষ হয়ে আসছে। কারণ পৃথিবী আজ ছোট হয়ে আসছে, বিদেশ এখন আর সেই বহুদূর পথ নয়Ñটাকার নেশায় মাতোয়ারা হয়ে দেশের মানুষের সব কিছু লুটেপুটে নিয়ে উর্ধগগনে উড়াল দেয়ার প্রস্তুতির দিন শেষ। বাকি জীবনটা নিশ্চিন্তে বিদেশের মাটিতে কাটিয়ে দেয়ার ধ্যান-ধারণা থেকে আজ বেরিয়ে আসতে হবে। নভেল করোনার ভয়াল থাবার মতোই কোন দেশে গিয়েই নিজেকে রক্ষা করা যাবে না। মানুষকে আজ মানুষের চরিত্রে ফিরে আসতেই হবে, সময় এখন সে শিক্ষাই দিচ্ছে। তবে এদের শিক্ষা আদৌ হবে কিনা সন্দিহান। অবস্থাদৃষ্টে তো মনে হচ্ছে জীবনের অন্তিমকালেও ওরা অন্যের টুঁটি চেপে ধরেই মরবে। করোনার ভবিষ্যত কি তা আমরা এখনও জানি না। তবে জীবিকার তাগিদে করোনার সঙ্গেই আমাদের পথ চলতে হচ্ছে। জীবনের নিশ্চয়তা যেন আরও কমে এসেছে। অথচ এখনও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু মানুষের অমানবিক কর্মকা-ের ঘটনার বিবরণ শুনলে চমকে উঠতে হয়। ‘সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘অপরাধ জানা মাত্রই এদের ওপর স্টিম রোলার চালাতে হবে।’ যথার্থই বলেছেন। দৃশ্যত শত্রুদের হার মানাতে না পারলে অর্থনীতির এমন দুঃসময়ে ওদের দৌড়াত্ম্যে মানুষের জীবন আরও অসহনীয় হয়ে উঠবে। জীবন আজ যেমন পাল্টে ল-ভ- হয়ে গেছে, আমাদের মানসিকতায়ও তেমনি আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। নিজেদের আরও দৃঢ়চেতা হতে হবে। মনের সব শঙ্কা আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে উপরে ফেলে দলমত নির্বিশেষে সব কিছুর উর্ধে থেকে অপরাধীকে কঠিন হস্তে দমন করতে হবে। তৃণমূল পর্যায় থেকেই স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অপরাধ দমনে শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ছোট বড় সব ধরণের অপরাধকেই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। তবে তা অনেক মানুষের সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার পরে নয়। অপরাধের শুরুতেই স্থানীয় পর্যায় থেকে ওদের গর্জে ওঠা মস্তিষ্ককে ছেঁটে ফেলতে হবে। যাতে করে কোনভাবেই ওরা শস্য থেকে বেলে পরিণত না হয়। নইলে বেল পুড়ায়ে শেষ করা যাবে না। সময়ের দৌরাত্ম্যে নিজেদেরও সর্বশক্তি দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তবে শত্রুকে চিহ্নিত করতে জনগণকে সজাগ রাখতে শক্তিশালী মিডিয়ার বিকল্প নেই। এই অর্থনীতির মন্দায় গণমাধ্যমগুলোও সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছে। ‘লকডাউন ডাউন’ অবস্থাতে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে অনেক স্থানীয় সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ কোন প্রতিষ্ঠানই বিজ্ঞাপন দেয়ার মতো অবস্থাতে ছিল না। যে কোন উপায়ই হোক মিডিয়াগুলোকে সর্বদা সরব রাখতেই হবে। মিডিয়ার সংখ্যাকে কোনভাবেই সঙ্কুচিত করা যাবে না। তাহলে অনেক খবরই লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে যাবে। কোভিড-১৯ এর নিকট জিম্মি হয়ে তো মানুষ পুরোপুরি মিডিয়া নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ফলে গণমাধ্যমের ওপর কোন খড়গই কারও কাম্য নয়। গণমাধ্যমের ভূমিকা ছাড়া রাষ্ট্র, সরকার, জনগণ কেউই জয়ী হতে পারবে না। লেখক : সাহিত্যসেবী
×