ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘ধর্ষিতা বোনের শাড়ি’ গাথার কবির জন্য স্বীকৃতি

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ১৮ অক্টোবর ২০২০

‘ধর্ষিতা বোনের শাড়ি’ গাথার কবির জন্য স্বীকৃতি

১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তিকামী বাংলাদেশের নারীদের সম্মান নষ্ট করে এদেশকে একটি সম্ভ্রম-লুণ্ঠিত সমাজ উপহার দিতে চেয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশের প্রধান অর্জনগুলো ধ্বংসের সকল আয়োজন বাস্তবায়ন শুরু হয়। সে গ্লানি থেকে নিজেদের গৌরব ও অমরত্ব অর্জনের এক মহিমাময় কাব্য রচনা করেছিলেন ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ২১ বছর বয়সী কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, লিখেছিলেন, ‘ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা’ (বাতাসে লাশের গন্ধ)। ১৬ অক্টোবর এই অকাল প্রয়াত কবির জন্মদিন। আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাদের কালের সবচেয়ে বেশি ভালবাসা পাওয়া এই তরুণ কবির স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাচ্ছি যিনি আমাদের নারীর সম্মান আর জাতির পতাকাকে মূর্ত করেছিলেন একটি অমর কাব্য-প্রতীকের মাধ্যমে। যারা ’৭১ সালে যুদ্ধরত বাঙালী সমাজের নারীদের সম্মানহানি করেছে তাদের বংশধরেরা এখনও সেই একই কাজ করছে যাদের এই দেশের স্বাধীনতা, এই দেশের নারীর সম্মান আর এই দেশের অর্জনের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান নেই কারণ এরা পাকিস্তানী বর্বর সৈন্য ও তাদের দোসরদের একই চেতনায় বিশ্বাসী। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাঁর কিশোর বয়স থেকেই এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন যার প্রমাণ তাঁর কবিতা আর গানের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। বাতাসে লাশের গন্ধ কবিতায়’ ’৭৫-এর পরের পরিস্থিতিতে ’৭১ সালের সেইসব দিনের কথা আক্ষেপ করে তিনি লিখেছিলেন, ‘তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,/নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ/মু-হীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর/ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে/আমি ঘুমুতে পারি না, আমি ঘুমুতে পারি না’। বাংলাদেশের মানুষের ঘুম নষ্ট করে দেবার যে সংস্কৃতি চালু করা হয়েছিল তা থেকে কবে মুক্ত হব তা আমরা তখন জানতাম না। তরুণ রুদ্র একই কবিতায় আমাদের জানালেন, ‘রক্তের কাফনে মোড়াÑ কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে/সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।/স্বাধীনতা, সে আমার– স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-/স্বাধীনতা– আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।’ এই অমূল্য স্বাধীনতাকে আমরা হেরে যেতে দিতে পারি না সে আহ্বান এই তরুণ কবির কবিতায় সারা দেশে তখন আলোড়ন তুলেছিল। আমরা এখন এই কবিকে নিয়ে এখন আর তেমন আলোচনা করি না। যদিও বাঙালী বিস্মৃতমুখী জাতি নয় বরং ইতিহাসমুখী, অন্তত শেখ হাসিনার এই দেশে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে কার কি অবদান আর এই দেশটাকে ব্যর্থ করে রাখার ষড়যন্ত্রে কারা লিপ্ত তাঁর ইতিহাসও সুরক্ষিত লিপিবদ্ধ থাকছে, ফলে আমরা বিশেষ চিন্তিত নই তবে সময়ের কাজ সময়ে হলেই ভাল। যে কাজটা আমাদের হয়নি কিন্তু করতে হবে তা হলো রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে অধ্যয়ন। যদি এই কাজ আমরা ঠিকঠাক মতো করতে পারি তাহলে জানতে পারব ’৭৫ পরের দেশটা কেমন ছিল আর সে পরিস্থিতি একজন ধীরস্থির কিন্তু প্রতিবাদী তরুণ কবিকে কেমন করে নাড়া দিয়েছিল। আর সে অধ্যয়নের দায়িত্ব এখন নবীন তরুণ সমজের উপরেই বর্তায়। আমরা যারা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সমসাময়িক, বন্ধু বা সতীর্থ বা সহযোগী হিসেবে যেমন পেয়েছি সে সবের মধ্যে তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় এ কথা স্বীকার করতে অন্তত আমার কোন দ্বিধা নেই। ফলে আমাদের বন্ধুদের অসুবিধা হলো রুদ্রের জন্য আমাদের অতিমাত্রার আবেগ যা বন্ধুপক্ষের চক্র থেকে আমাদের বেরুতে দেয় না। কিন্তু ইতিহাস ও সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মাত্র কুড়ি বছরের সাহিত্য সাধনায় বাংলাদেশকে একটি মানবিক দেশ গঠনের জন্য সংগ্রাম চালিয়েছেন আর তা বুঝতে আমাদের কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবেই। যেমন রুদ্রের কবিতায় অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও অমূল্য করে ধরে রাখতে সংগ্রামের চিত্র আছে যেসবের ’৭৫ পরের এক ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে, সেসবের কাব্য রূপকার ছিলেন রুদ্র ‘জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’; আমাদের বুঝতে হবে এই ছত্রে একটি দেশের ইতিহাসকে উলটোরথে পরিচালিত করার বিরুদ্ধে ২১ বছর বয়সে এই কবি কেমন করে কলম ধরেছিলেন। দ্বিতীয়ত: আমাদের ভেবে দেখা দরকার ’৭৫ পরের কালে যতগুলো প্রতিবাদ ও সাংগঠনিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে প্রায় সবগুলো আয়োজনের মধ্যমণি ছিলেন এই রুদ্র, সমসাময়িক কবি ও বন্ধুদের নিয়ে গঠিত ‘রাখাল’ ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’, ‘বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়ন’, ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’ সকল ক্ষেত্রে রুদ্রের ছিল সরব উপস্থিতি ও রেখেছেন সাংগঠনিক নেতৃত্ব-নৈপুণের স্বাক্ষর। তৃতীয়ত : আমাদের জানা ও অন্বেষণ করা দরকার রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাঁর কাব্য-দর্শনে গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ধারণ করে তাঁর রচনায় শহুরে নাগরিক জীবনকে পুনর্বিন্যাস করেছেন যার সাহিত্যমূল্য অসীম। তাঁর রচিত গান দ্রুত বাঙালী সমাজে জনপ্রিয় হবার প্রধান কারণ সাধারণের জীবনের সুখ-দুঃখকে উপজীব্য করার এক অসাধারণ ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা তাঁকে দিয়েছিলেন। আমরা জানি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের নানা অধ্যায়ে ঠাঁই পেয়েছেন কিন্তু তাঁর সৃজনশীল ক্ষমতা না বুঝে বা অনাবিষ্কৃত রেখে ও তাঁর সাহিত্যকর্মের অন্তর্গত অন্বেষণ ছাড়া কেবলমাত্র স্মরণ-আয়োজনের মধ্যে তাঁকে সীমিত না রেখে আমাদের উচিত হবে একটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এই কবিকে দেবার ব্যবস্থা করা। বেঁচে থাকলে রুদ্র কখনও কোন পুরস্কার বা পদকের ধার ধারতেন না একথা আমি হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও ’৭৫ পরবর্তী সমাজ-দর্শনের সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংগ্রামের সম্পর্ক স্থাপনে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ঐতিহাসিক কারণেই দিতে হবে। না হলে সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের একটি মূল্যবান দিক অনুন্মোচিত ও ভুল থেকে যাবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×