ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভাসানচর এখন বাসযোগ্য দ্বীপ

নির্জন হলেও সাধারণ নয়, সাগরের বুকে এক টুকরো শহর

প্রকাশিত: ২২:১৮, ১৭ অক্টোবর ২০২০

নির্জন হলেও সাধারণ নয়, সাগরের বুকে এক টুকরো শহর

হাসান নাসির, ভাসানচর থেকে ফিরে ॥ ভাসানচর। নির্জন হলেও সাধারণ কোন দ্বীপ নয়। এ যেন সাগরের বুকে এক টুকরো শহর। মাত্র ত্রিশ বছর আগেও যে দ্বীপের ওপর দিয়ে জাহাজসহ বিভিন্ন ধরনের জলযান চলাচল করেছে, সেই দ্বীপ এখন বাসযোগ্য। শুধু কোনরকমে বসবাস নয়- সুউচ্চ বেড়িবাঁধে সুরক্ষিত দ্বীপটিতে জাহাজ ভেড়াবার জেটি, সুুবিন্যস্ত সড়ক, সারিসারি ঘর, নান্দনিক নকশার দালান, পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার, চাষাবাদের উপযোগী ভূমি আর রাতে আলোর ঝলকানি- কি নেই সেখানে। হ্যাঁ, নেই শুধু মানুষ। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ভাসান চর। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয়ণের জন্য এই প্রকল্প যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মানবিক পদক্ষেপ। ভাসানচর বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন একটি দ্বীপ যা এখনও লোকালয় হিসেবে স্বীকৃত নয়। কিন্তু লোকালয়সমৃদ্ধ দ্বীপগুলো শত বছরেও যে আধুনিক চেহারা পায়নি, ভাসানচর তারচেয়েও বেশি পেয়েছে মাত্র দুই বছরে। দেশের লাখো পর্যটক মুখিয়ে আছে দ্বীপটিকে একনজরে দেখবার জন্য। কিন্তু যাদের জন্য এ আবাসন প্রকল্প তারা কি আসছে? তবে সরকারী সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের আশাবাদ- দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও কিছু রোহিঙ্গা অবশ্যই আসবে। কারণ কক্সবাজারের সেই অপরিসর ক্যাম্পগুলোর চেয়ে অনেক উন্নত পরিবেশ এখানে। নৌবাহিনীও চায়, যে উদ্দেশ্যে এ মহাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন তা যেন বাস্তবে রূপ পায়। রোহিঙ্গাদের এ আশ্রয় হবে সাময়িক। প্রত্যাবাসিত হয়ে গেলে সেখানে আশ্রয় পাবে এদেশের দুস্থ গৃহহীন মানুষ। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কল্পনার চেয়েও সুন্দর এ ভাসান চর। সদ্য জেগে ওঠা দ্বীপ এমন দৃষ্টিনন্দন চেহারায় উদ্ভাসিত হতে পারে তা অকল্পনীয়। আর এমন হয়েছে নৌবাহিনীর সরাসরি তদারকিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার কর্মীর দিনরাত পরিশ্রমে। দ্বীপটি এখনই ১ লাখ রোহিঙ্গা ধারণের জন্য প্রস্তুত। পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে আরও ৩ লাখ মানুষের আবাসন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কমডোর এ.এ.মামুন চৌধুরী ভাসান চরের এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, দ্বীপের ১৩ হাজার একর ভূমির মধ্যে ৬ হাজার ৪২৭ একর জায়গা কখনও ডোবে না। এ স্থানটুকু থেকে নির্বাচন করা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩ এর ভূমি। ভাসান চরে প্রথম এসে আমরা কিছু মহিষ আর পাখি ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। পরে সড়ক সম্প্রসারণ, বেড়িবাঁধ উঁচুকরণ এবং কাজ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্প ব্যয় ৭৮২ কোটি টাকা বেড়ে উন্নীত হয় ৩ হাজার ৯৪ কোটি টাকায়। কাজ প্রায় ৯৯ ভাগই শেষ। এখন পেইন্টিং এবং সৌন্দর্যবর্ধনের কিছু কাজ বাকি। যেটুকু হয়েছে তাতে ১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করতে পারবে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতার পাশাপাশি কৃষি কাজ ও গবাদিপশু পালন করে তারা বাড়তি আয় করতে পারবে। গড়ে উঠতে পারে দুগ্ধ খামার। তিনি জানান, এ চ্যানেল দিয়েই চলাচল করে সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও ঢাকামুখী জাহাজগুলো। কোন একপর্যায়ে বাংলাদেশী দুস্থ ও গৃহহীন মানুষের বসবাসে লোকালয় গড়ে উঠলে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রীবাহী জাহাজগুলোর জন্য জেটি গড়ে উঠতে পারে। প্রকল্প পরিচালক কমডোর মামুন বলেন, নৌবাহিনী কেবলই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সে প্রকল্পের কাজ শেষ করেছি। এখন শুধু হস্তান্তর করার অপেক্ষায়। সবচেয়ে ভাল হয় মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা যদি প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত সাময়িক আশ্রয়ের জন্য এখানে আসে। তা না হলে সরকার অন্য যে কোন কাজে ভাসান চরকে ব্যবহার করতে পারে। ভাসান চরে আছে ৩০৬ রোহিঙ্গা ॥ এক লাখ রোহিঙ্গার সাময়িক আশ্রয়ের জন্য পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এ ভাসান চরে এখন রয়েছে মাত্র ৩০৬ জন রোহিঙ্গা। এরা কেউ স্বইচ্ছায় আসেনি। অবৈধভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়ার সময় তারা ধরা পড়ে। টেকনাফের আশ্রয় শিবিরের পরিবর্তে তাদের রাখা হয়েছে ভাসান চরে। এরমধ্যে ৯৭ জন পুরুষ, ১৭৬ জন নারী এবং ৩৩ জন শিশু রয়েছে। তবে পুরো পরিবার রয়েছে এমন নয়। তাদের স্বজনদের মধ্যে কেউ বা রয়েছে টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্পে আবার কেউ বা রয়েছে বিদেশে। একাকীত্বের কারণে তারা ফিরতে চায় স্বজনদের কাছে। পরিবারের অন্যরা এলে অনেকেই থাকতে রাজি বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র। ভাসান চরে যা গড়ে উঠেছে ॥ ভাসান চর দ্বীপটি এমন সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ হয়েছে যা শতবছরের দ্বীপগুলোতেও নেই। দ্বীপের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে সুউচ্চ একটি লাইট হাউস, যার মাধ্যমে ওই চ্যানেলে চলাচলকারী জাহাজগুলো পথের দিশা পায়। এক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয়ণের জন্য তৈরি হয়েছে ১২০টি ক্লাস্টার। প্রতিটি ক্লাস্টারে ১২টি হাউস, একটি সাইক্লোন শেল্টার, একটি পুকুর ও খেলার মাঠ নিয়ে একটি গুচ্ছগ্রাম। এভাবে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে নির্মিত হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি আবাসন ঘর। লাল রঙের ছাউনিতে এ ঘরগুলো বেশ দৃষ্টিনন্দন যা অনেকদূর থেকে দৃশ্যমান হয়। প্রতিটি অলিগলি ইট ও কংক্রিটের সমন্বয়ে পাকা করা। কোন ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হলে বসবাসকারীরা দ্রুতই আশ্রয় নিতে পারবে শেল্টারে। রয়েছে দুটি ২০ শয্যার হাসপাতাল, ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী। বসবাসকারীদের জন্য আছে রান্নাঘর, শৌচাগার ও পানীয় জলের সুবিধা। অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে দুটি ফায়ার জিপসহ একটি ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ব্যারাক হাউসসমূহে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংযোজন করা হয়েছে। প্রতি ক্লাস্টারে নির্মিত পুকুরের পানিও অগ্নিনির্বাপন কাজে ব্যবহার করা যাবে। প্রতিটি শেডেই রয়েছে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা। এছাড়া নৌবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিতি থাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সৃদৃঢ়। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা এলে যাতে থাকতে পারেন সে জন্য নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ভবন। ভাসান চর যে কারণে হাতিয়ার ॥ ভাসান চরের অবস্থান সন্দ্বীপের কাছাকাছি। শুষ্ক মওসুমে ভাটার সময় চরের মাধ্যমে দ্বীপটি অনেকটা যুক্ত হয়ে যায় সন্দ্বীপের সঙ্গে। কিন্তু এ দ্বীপটি কিভাবে নোয়াখালীর হাতিয়া থানার হয়ে গেল তা নিয়ে নানা প্রশ্ন। বিশেষ করে সন্দ্বীপবাসীদের আপত্তি অনেকটা প্রকাশ্য। এ নিয়ে আন্দোলনও হয়েছিল। এ ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাসান চরের ওপর দিয়ে ১৯৯০ সালেও বর্ষাকালে জাহাজ ও নৌকা চলাচল করেছে। শীত মওসুমে দ্বীপটি দৃশ্যমান হয়। জোয়ারের সময় ডুবে যেত আর ভাটার সময় জেগে উঠত। নতুন এ দ্বীপ প্রথম চোখে পড়ে হাতিয়ার জেলেদের। তারা সেখানে মাছ ধরতে শুরু করে। ইলিশসহ প্রচুর সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ত ওই জলসীমায়। একপর্যায়ে ১৯৯৫ সালে এসে হাতিয়ার বন বিভাগ এই চরে কয়েক লাখ গাছের চারা রোপণ করে। পর্যায়ক্রমে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে উপজেলা ও নোয়াখালীর জেলা প্রশাসন। দীর্ঘ তত্ত্বাবধান ও পরিচর্যায় গাছ-গাছালিতে শোভিত হয় দ্বীপটি। সন্দ্বীপের সঙ্গে অনেকটা যুক্ত হলেও এ দ্বীপের উন্নয়নে তেমন কোন ভূমিকাই পালন করেনি সন্দ্বীপ উপজেলা প্রশাসন। এর ফলে দাবি থাকলেও চূড়ান্ত বিচারে সন্দ্বীপ ভাসান চরের ওপর অধিকার হারায়। শুরুতে যখন দ্বীপটি নজরে এসেছিল তাতে মূলত জেলেদের বিচরণই ছিল। সে কারণে এর নামকরণ হয় জালিয়ার চর। সেখানে গাছ-গাছালি হওয়ার পর মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত কাঠের টুকরোও পাওয়া যেত যথেষ্ট পরিমাণে। নোয়াখালীর ভাষায় গাছের টুকরোকে বলা হয় ঠ্যাঙ্গা। ফলে এর নাম ঠেঙ্গার চর হিসেবে পরিচিতি পায়। পরে নতুন নামকরণ হয় ‘ভাসান চর।’ নৌবাহিনীর ঘাঁটি যে কারণে ॥ সমুদ্র রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ নৌবাহিনী। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এই দ্বীপ। দ্বীপটি জেগে ওঠার পর সেখানে জনবসতি না থাকায় অনেকটা জলদস্যুদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। জলসীমার ওই এলাকায় প্রায়ই দস্যুদের কবলে পড়ত জাহাজগুলো। এ অবস্থায় সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে সেখানে একটি নৌঘাঁটি করার প্রস্তাব এলে সরকার তা অনুমোদন করে। ২০১৭ সালের প্রথমদিকে এ চরে নৌবাহিনীর ফরওয়ার্ড বেইজ স্থাপন ও ল্যান্ডিং ক্রাফট মোতায়েনের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটলে তাদের স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে আলাদা রাখতে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে সরকার। বিশেষ করে তারা যেন কিছুটা হলেও উন্নত জীবন পায় সেজন্য মানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উদ্যোগী হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই ইচ্ছায় সেখানে অস্থায়ী আশ্রয়ণের সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিমত, রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয়ণের জন্য গড়ে তোলা এ স্থাপনায় যদি তাদের আনা যায় তাহলেই উদ্দেশ্য সফল। নানাভাবে সে চেষ্টাই চলছে। তাছাড়া যত দ্রুত সম্ভব স্থাপনাগুলোর ব্যবহার প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় অব্যবহৃত থাকলে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হাজারও কোটি টাকার প্রকল্প বিনষ্ট হতে পারে। রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে রাজি না হলে দেশের গৃহহীনদের হলেও বসবাসের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এদিকে ৩০৬ জন রোহিঙ্গা এখন বসবাস করলেও আরও রোহিঙ্গা আসবে কিনা তা নির্ভর করছে জাতিসংঘসহ শরণার্থী বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকার ওপর। কারণ এ সংস্থাগুলো উদ্যোগী হলেই নিশ্চিত হয় রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহ নানা সহায়তা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা না থাকায় সেখানে বর্তমানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রতিদিনের খাদ্যের সংস্থান করতে হচ্ছে নৌবাহিনীকে।
×