ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এসেছে হেমন্তলক্ষ্মী

ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে

প্রকাশিত: ২১:৫৩, ১৭ অক্টোবর ২০২০

ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে

মোরসালিন মিজান ॥ সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন্ পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে...। প্রকৃতির আহ্বানে আবারও এসেছে হেমন্ত। আজ শনিবার ১ কার্তিক, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। প্রিয় ঋতু শুরুর দিন। নতুন ঋতুর আগমনে এরই মাঝে রূপ বদলাতে শুরু করেছে প্রকৃতি। হেমন্তের রঙে সাজছে। কবিগুরুর ভাষায় : হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা-/হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা।/সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,/কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।/ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে...। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। এখানে দুই মাস পর পর রূপ বদলায় প্রকৃতি। সেই ধারাবাহিকতায় এসেছে কার্তিক। কার্তিক অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। শীতের বাহন বলা হয় হেমন্তকে। আবহাওয়াবিদদের মতে, এখন থেকে যত দিন যাবে ততই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমতে থাকবে। পার্থক্য যত কমবে তত শীত বাড়তে থাকবে। নবেম্বরের পুরোটা এভাবে যাবে। ডিসেম্বর থেকে জোরে বইবে শীতের হাওয়া। এখন অল্পস্বল্প শিশির ঝরছে। বাইরের জেলাগুলোতে এর প্রভাব স্পষ্ট। ঢাকায়ও দেখা যাচ্ছে শিশির। রাত একটু বাড়লে বিশেষ অনুভব করা যায়। আর ভোর বেলাটা কুয়াশায় মোড়ানো থাকে। সবুজ পাতার গায়ে জমে থাকা শিশির বিন্দু স্বাগত জানাচ্ছে হেমন্তকে। জীবনানন্দ দাশের বলাটি এরকম: পা-ুলিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি/নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;/শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরও...। অবশ্য হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকের এক রূপ। পরেরটির অন্য। এক সময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল ফুরিয়ে যেত এ সময়ে এসে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও সময়টি সম্পর্কে বলা হয়েছে। কবিগুরু লিখেছেন : শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে। মরা কার্তিকের সঙ্গে কৃষকের অভাব-অনটনও জড়িয়ে ছিল। এখন দিন বদলেছে। কার্তিক আর মরা কার্তিক নয়। ক্ষেত খামার গ্রাম ফসলে সমৃদ্ধ। অগ্রহায়ণের উল্টো চিত্রটি সম্পূর্ণ হয়। এই সময় সমৃদ্ধির। এ সময় মাঠের সোনালি ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ ধান শুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। তবে যত দিন যাচ্ছে ততই বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। এখন শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত থাকতে হয় কৃষককে। নানা ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও বেশ। পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মহাধুমধামে চলছে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। বগুড়া, রংপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকরা যারপরনাই ব্যস্ত। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। এত যে দেখা, তবু চোখ সরানো যায় না! অদ্ভুত ছন্দ তুলে সরু আইল মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরেন কৃষক। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কিষানি। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যায় তাদের। দ্বিতীয় মাসটি অগ্রহায়ণ। এ মাসের পুরোটাজুড়ে সারা বাংলায় চলবে নবান্ন উৎসব। বাঙালীর প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। এ সময় আমন ধান কাটা শুরু হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদনের সময় এটি। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমন উৎপাদন হয় এ সময়। নতুন ধানে চলে নবান্ন উৎসব। আমন ধানের চালে প্রথম রান্না হয়। এ উপলক্ষে চলে আনন্দঘন উদযাপন। কোন কোন অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে চলে পায়েস রান্না। এভাবে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় নবান্ন উৎসব। শুধু গ্রামে নয়, এখন শহরেরও থাকে নানা আয়োজন। গ্রামের মতো না হলেও প্রতিবছর ১ অগ্রহায়ণ রাজধানী ঢাকায় প্রতীকী নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। এভাবে শেকড়ের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার অনুপ্রেরণা হয়ে আসে হেমন্ত। হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে...। আজ থেকে হেমন্তের হিম শীতল আঁচলে বাঁধা পড়ল বাংলাদেশ।
×