ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী

এদেশে আর কোনদিন কেউ না খেয়ে থাকবে না

প্রকাশিত: ২১:৫১, ১৭ অক্টোবর ২০২০

এদেশে আর কোনদিন কেউ না খেয়ে থাকবে না

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, বর্তমান সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। কাজেই এদেশে আর কোনদিন কেউ না খেয়ে থাকবে না। খাদ্য নিরাপত্তাটা যেন নিশ্চিত থাকে এবং প্রতিটি মানুষের ঘরে যেন খাবার পৌঁছায় সেজন্য হতদরিদ্রের মাঝে আমরা বিনে পয়সায় খাবার দিয়ে যাচ্ছি এবং এটা আমরা সব সময় অব্যাহত রাখব। একটি মানুষও যেন না খেয়ে কষ্ট না পায়। আর একটি মানুষও আর গৃহহীন থাকবে না। শুক্রবার বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২০ উপলক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রত্যেকটি মানুষ যাতে চিকিৎসাসেবা পায় সেজন্য তাদের দোরগোড়ায় আমরা চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিচ্ছি। কেউ পুষ্টিহীনতায়ও ভুগবে না, সেজন্য মায়েদেরও আমরা মাতৃত্বকালীন আর্থিক সাহায্য দিচ্ছি, সদ্য প্রসূত মা বা যারা ব্রেস্ট ফিডিং করান তাদেরও আমরা আর্থিক সহায়তা দিচ্ছি। বিশাল সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের যে কর্মসূচী রয়েছে তার মাধ্যমেও আমরা আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে যাতে পুষ্টির নিশ্চয়তা হয় এবং মানুষ যেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়- সেটাই আমাদের লক্ষ্য।’ বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসুন এই বিশ্বকে আমরা ক্ষুধামুক্ত করি। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের একটাই চিন্তা যে, জাতির পিতা চেয়েছিলেন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইনশাল্লাহ আমরা তা অর্জন করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে মূল অনুষ্ঠানস্থল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম মতিয়া চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক কিউ ডংইউর পূর্বে ধারণকৃত একটি ভাষণ প্রচার করা হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মেসবাউল হাসান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রের সাফল্যের ওপর একটি ভিডিও চিত্রও প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত সাহসী এবং তারা যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা রাখে। এই করোনার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়, বন্যা-সবই আমরা মোকাবেলা করে যাচ্ছি। এভাবে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বাঁচতে হবে। তার সরকারের প্রতিটি কাজের লক্ষ্য কৃষকদের সুবিধা প্রদান করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাজেই যখনই বিশ্বে করেনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে তখনই আমরা খাদ্য উৎপাদনে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিশ্চয়তা বিধানের উদ্যোগ নিয়েছি। ‘বাংলাদেশের মানুষ যেন কোন কষ্ট ভোগ না করে সেজন্য তাঁর সরকার নানা প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে’- উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রণোদনার প্যাকেজ অনুযায়ী কৃষকদেরই সবথেকে বেশি সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। যাতে তারা তাদের সাধারণ কাজগুলো (কৃষিকাজ) ভালভাবে চালাতে পারে। তিনি করোনাকালীন তাঁর সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই দেশের দরিদ্র জনগণ যারা করোনার জন্য কোন কাজ করতে পারেনি, তাদের জন্য ২ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করে যাচ্ছি। যারা হাত পেতে টাকা নেবে না, কিনে খেতে চায় অথচ বেশি টাকাও নেই তাদের জন্য আমরা ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহের ব্যবস্থা হিসেবে ২৫১ কোটি টাকা খরচ করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষকরা উৎপাদিত পণ্য যাতে বাজারজাত করতে পারে সেজন্য আমরা ৮৬০ কোটি টাকার সহায়তা দিচ্ছি। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের উৎপাদিত ধান-চাল ক্রয় করেও আমরা তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। কৃষির যান্ত্রিকীকরণকে তাঁর সরকার বিশেষভাবে উৎসাহিত করছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছি যাতে কৃষকরা অল্পমূল্যে কৃষিযান্ত্রিকীকরণ করতে পারে। বাকী অর্থ সরকারের পক্ষ থেকেই দেয়া হচ্ছে। তাছাড়াও, কৃষির জন্য কৃষি সহায়তা হিসেবে আমরা ৯ হাজার ৫শ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ রেখেছি। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই এক ইঞ্চি জমিও কেউ ফেলে না রেখে বৃক্ষ, ফলমূল, তরি-তরকারি যা কিছুই হোক না কেন যেন উৎপাদন করেন। সরকার করোনার জন্য জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ প্রণোদণা প্রদান করছে এবং করোনাকালীন কেবল কৃষির জন্যই ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য খাদ্যকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে তিনি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কৃষকদের ধান কাটায় সহযোগিতা করায় ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, যুব মহিলা লীগসহ আওয়ামী লীগের সকল সহযোগী সংগঠন এবং মূল সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের ছাত্ররা (ছাত্রলীগ কর্মী) কাজকে গুরুত্ব দিয়ে মাঠে ছুটে গিয়েছে এবং ধান কেটে কৃষকের গোলায় দিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ১ লাখ ১২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়ে করোনার মাঝেও অর্থনীতির চাকা যাতে সচল থাকে সেই ব্যবস্থা করেছি। জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এসে ঐতিহাসিক রেসকোর্সের (৭ মার্চের ভাষণের স্থান এবং বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে যে ভাষণ দেন তার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পদক্ষেপের চৌম্বক অংশ আলোচনায় তুলে আনেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁর পিতার উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, ‘জাতির পিতা বলেছিলেন, আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, আশ্রয় পায়, উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ তিনি বলেন, জাতির পিতা এই লক্ষ্য নিয়েই যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ছিল জাতির পিতার একমাত্র লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই বক্তব্যের স্বপক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ দিয়ে জাতির পিতা প্রদত্ত অপর ভাষণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরেন। যেখানে জাতির পিতা বলেছিলেন-‘দেশে কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য প্রতিটি কৃষককেই কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখা যাবে না।’ শেখ হাসিনা বলেন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সেসময় ৫শ’ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ১০১ কোটি টাকাই তিনি (বঙ্গবন্ধু) রেখেছিলেন কৃষি উন্নয়নের জন্য। কারণ, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য এবং ১৯৭৩ সালেই তিনি কৃষি পুরস্কার তহবিলও গঠন করেন এবং মাত্র ৯ মাসে আমাদের যে সংবিধান উপহার দেন সেখানেও সকল মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষিকেও তিনি গুরুত্ব প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার পদাংক অনুসরণ করেই এই ছোট্ট ভূখন্ডের অধিক জনসংখ্যার দেশে তাঁর সরকারও জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই কাজ করে যাচ্ছে। তিনি এ সময় তাঁর সরকারের খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যের পেছনে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার প্রতিশ্রুত সহযোগিতার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানান এবং একইসঙ্গে খাদ্য উৎপাদনে বিএনপি’র ব্যর্থতার খতিয়ান তুলে ধরে তাদের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘একুশ বছর পর ’৯৬ সালে তিনি যখন প্রথম সরকার গঠন করেন সে সময় ২৪ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতির দেশ ছিল বাংলাদেশ। সেই দেশে খাদ্য উৎপাদন করে ২০০১ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হয় তখন ২৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য তাঁর সরকার উদ্বৃত্ত রেখে যায়। তাঁর সরকারের ২ কোটি ১০ লাখ কৃষি উপকরণ কার্ড বিতরণ, কৃষিভাতা, কৃষকবন্ধু সেবা ‘৩৩৩১’, কৃষি জানালা বা কৃষি কল সেন্টার ‘১৬১২৩’ চালু, ১০ টাকায় ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ, জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ২০২০ প্রণয়ন, নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ প্রণয়নসহ খাদ্যের সঙ্গে জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানেও তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন এবং সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের মূল্য কৃষকদের নাগালের মধ্যে রেখে তা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগও তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) প্রতি বছর এই দিবসটি উদযাপন করে থাকলেও সংস্থাটির ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আজকের দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্ব খাদ্য দিবসে আমি তাঁদের অভিন্দন জানাই। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হওয়ায় সংস্থাটিকেও প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী এ সময় করোনাভাইরাসের কারণে চলমান মুজিববর্ষ কাঙ্খিতভাবে উদযাপন করতে না পারার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাঁর সরকারের ডিজিটালাইজেশনের সুবাদে ভার্চুয়াল এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় আমরা নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলাম, আজকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে বলেই এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এবং কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি।
×