ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সৈয়দপুরে অবাঙালী ক্যাম্পে নষ্ট মিটারে প্রতি মাসে কোটি টাকা আদায়

বিদ্যুত বিলে তেলেসমাতি

প্রকাশিত: ২০:২৬, ১৭ অক্টোবর ২০২০

বিদ্যুত বিলে তেলেসমাতি

সংবাদদাতা, সৈয়দপুর, নীলফামারী, ১৬ অক্টোবর ॥ স্থানীয় অবাঙালী ক্যাম্পগুলোর বিদ্যুত বিল নিয়ে শুরু হয়েছে তেলেসমাতি কারবার। এসব ক্যাম্পের নষ্ট মিটারে বিদ্যুত বিল বাবদ সরকারের কাছ থেকে প্রতিমাসে কোটি টাকা আদায়ের জন্য ভুয়া বিল প্রদান করা হচ্ছে। এতে সরকারী কোষাগারের বিশাল অঙ্কের টাকা নেসকোর পকেটে গেলেও নজর নেই কারও। জানা যায়, এ শহর আটক অবাঙালীদের ক্যাম্প রয়েছে ২৪ টি। এসবে বসবাস করে প্রায় তিন হাজার ৯ শ’ ৩৭ দুস্থ পরিবার। তাদের অন্যান্য সুবিধার পাশাপাশি সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নেসকোকে বিল পরিশোধ করে। কোন নজরদারি না থাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে নেসকো কোম্পানির সৈয়দপুর বিতরণ ও বিক্রয় কেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রকরা। তারা চলতি বছর জুলাই মাসে এসব পরিবারের ব্যবহৃত বিদ্যুত বিল প্রদান করেছে ৯৯ লাখ ২৫ হাজার ২৫৪ টাকার। পূর্বের বকেয়াসহ ৩৮ কোটি ১৬ লাখ ৫৩১ টাকা দেখানো হয়েছে মোট বকেয়া। এছাড়া চলতি বছর আগস্ট মাসে ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৯০ ইউনিট ব্যবহৃত দেখিয়ে বিল করা হয়েছে। যার মূল্য এক কোটি ৯ হাজার ৬৬৫ টাকা। মিটার নষ্ট কিংবা না থাকলেও প্রতিমাসে ধাপে ধাপে বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুত বিল। তবে এ ২৪ ক্যাম্পের বিদ্যুত বিল পর্যালোচনায় অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। নেসকো কোম্পানি তাদের দেয়া চলতি বছর জুলাই মাসের ২৪টি ক্যাম্পের ২৪টি বিলে মোট ব্যবহৃত ইউনিট ১৪ লাখ ৮৫ হাজার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে অবাঙালী ক্যাম্প চামড়া গুদাম (কনজুমার নং- ৫৬৩৪১০১৭) হিসাব নং ২/ডি-তে দেখানো হয়েছে বর্তমান রিডিং ৬৬ হাজার ৪ শ’ ৭০। পূর্বের রিডিং ২৬ হাজার ৪ শ’ ৭০। এতে বর্তমান ব্যবহৃত ইউনিট দাঁড়ায় ৪০ হাজার। তবে বিলে ২০ হাজার বৃদ্ধি করে লেখা হয়েছে ৬০ হাজার ইউনিট। একই ঘটনা ঘটানো হয়েছে চামড়া গুদাম ক্যাম্প-৫ (কনজুমার নং- ৫৬৩৪১০২১) ক্যাম্পে। এ ক্যাম্পে বর্তমান রিডিং ৮৫ হাজার ৯ শ’ ৩৫, পূর্বের রিডিং ৫১ হাজার ৯শ’ ৩৫ ইউনিট। এতে ব্যবহৃত ইউনিট হওয়ার কথা ছিল ৩৪ হাজার। তবে এ বিলে ৩২ হাজার ইউনিট বাড়িয়ে ৬৬ হাজার ব্যবহৃত ইউনিট দেখানো হয়েছে। মিটার না থাকলেও এভাবে ইচ্ছে করে ভুলে ৩০ হাজার বেশি ইউনিট বিল করা হয়েছে অবাঙালী ক্যাম্প-২ (কনজুমার নং-৫৬৩৪১০৪০) তে। ধর্মশালা ক্যাম্প (কনজুমার নং- ৫৬৩৪০৯৫১) ২৮ হাজার, গোলাহাট জয়নাল ওয়েল মিল ক্যাম্পে (কনজুমার নং-৫৬৩৪১২৬৭) ৩০ হাজার, পৌরসভা পানির পাম্প ক্যাম্পে (কনজুমার নং-৫৬৩৪১০৬১) ১৩ হাজার, রেল ম্যাচ ক্যাম্পে (কনজুমার নং-৫৬৩৪০৯৭৯) ২৮ হাজার ইউনিট, হাতিখানা ক্যাম্পে (কনজুমার নং-৫৬৩৪৩৫৪৫) ৩৪ হাজার, হাতিখানা ক্যাম্প-২(কনজুমার নং- ৫৬৩৪৩৫৫১) তে ২০ হাজার, হাতিখানা ক্যাম্প-৩(কনজুমার নং- ৫৬৩৪৩৫৬৪) তে ২৮ হাজার, নয়াটোলা ক্যাম্প-২২/ডি (কনজুমার নং- ৫৬৩৪২১১৯) তে ২২ হাজার ইউনিট মিলে ২ লাখ ৮৫ হাজার ইউনিট বেশি দেখানো হয়েছে। লেখার ভুলে সরকারী দফতরকে এ বিশাল ইউনিটের বিলও পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া যেখানে মিটার নেই সেখানে কিভাবে গ্রাহকের নাম, ঠিকানা, হিসাব নং, লোড,মিটার নং, পূর্ববর্তী রিডিং, বর্তমান রিডিং, ব্যবহৃত ইউনিট, পূর্বের বকেয়া, মোট বকেয়া লেখা সংবলিত বিদ্যুত বিল প্রদান করা হচ্ছে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে তা কেউ বলতে পারছে না। জানা যায়, নেসকো সৈয়দপুর বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের অধীনে প্রায় ৫৭ হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছে। এসব গ্রাহকের মধ্যে আবাসিক, বাণিজ্যিক, উচ্চ চাপ, মধ্যম চাপ, সেচ পাম্প, স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও মাদ্রাসা। এ বিশাল গ্রাহকের জন্য প্রতিমাসে প্রায় ৮৫ লাখ থেকে ৯৫ লাখ ইউনিট আমদানি করা হয়। এখান থেকে কৌশলে অর্থের বিনিময়ে কতিপয় কর্মকর্তা গ্রাহকদের বিদ্যুত প্রদান করেন। এতে আমদানিকৃত বিদ্যুত বিক্রির পর ঘাটতি দেখা দিলে ব্যাপক সিস্টেম লসের কবলে পড়ে। তাই সিস্টেম লসের পরিমাণ কমাতে একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে সৈয়দপুরের ২৩টি অবাঙালী ক্যাম্প। স্থানীয় দফতরটির এলাকাভিক্তিক দায়িত্বে থাকা সহকারী ও উপসহকারী প্রকৌশলীরা মিটার ছাড়াই বেহিসাবী ইউনিট উপস্থাপন করে ক্যাম্পবাসীর কাঁধে চাপিয়ে সরকারী দফতরে বিল প্রদান করছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পের নামে বিদ্যুতের পুকুর চুরির ঘটনা ঘটলেও কোন দায়বদ্ধতা নেই সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের। তারা নীরবেই নেসকো সৈয়দপুরের অনিয়ম মেনে নিচ্ছেন। সরেজমিনে ক্যাম্পগুলো ঘুরে পাওয়া তথ্য মতে, এসব পরিবারকে মাসে গড়ে আড়াই হাজার টাকার বিদ্যুত বিল চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে এর বাস্তব চিত্র উল্টো। ঘিঞ্জি বসতির এসব পরিবার ৬৪ বর্গফুটের একটি ঘরে বসবাস করছেন। সারাদিন বাইরে কাজ শেষে ফেরার পর বিশ্রামের সময় একটি ফ্যান, একটি বাতি ও একটি টেলিভিশন কিংবা অনেকে বৈদুতিক চুলা ব্যবহার করলেও সংখ্যায় কম। রয়েছে কেবল একটি বাতি, একটি ফ্যান ও একটি টেলিভিশন। এ নিয়েই তারা ক্যাম্পে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করছেন। এছাড়া বিদ্যুত অপচয়ের ফ্রিজ, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন কিংবা অন্যান্য বৈদ্যুতিক সামগ্রী নেই। বাঁশবাড়ি ক্যাম্প, মিস্ত্রিপাড়া ক্যাম্প, আমেরিকান ক্যাম্প, গোলাহাট ক্যাম্প,হাতিখানা ক্যাম্প, আউট হাউস ক্যাম্প, ইসলামবাগ ক্যাম্প, শহীদ আজমল ক্যাম্প, রসুলপুর ক্যাম্প, ধর্মশালা ক্যাম্প, টিনাবাড়ি ক্যাম্প, বারু রেশ ক্যাম্প, বাঙালীপুর ক্যাম্প, চামড়া গুদাম ক্যাম্প মিলে ২০ টিতে মিটার নেই। অধিকাংশে দৃশ্যমান থাকলেও তা নষ্ট। বাকি দুর্গামিল ক্যাম্প, ইসলাম বাগ ক্যাম্প ও রেলওয়ে মেস ক্যাম্প মিলে ৩ টিতে সচল মিটার রয়েছে। এর মধ্যে নিজ বাড়ি নামে একটি ক্যাম্প ১২ বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে। তার পরও বিদ্যুত বিল দেখানো হয়েছে ক্যাম্পটির নামে। এ নিয়ে কথা হয় সব ক্যাম্পের সভাপতির সঙ্গে। তারা বলেন, মিটারগুলো ২ বছর আগে শটসার্কিট কিংবা নানা কারণে পুড়ে গেছে। ততক্ষণাৎ নেসকো সৈয়দপুর বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রকে অবহিত করা হয়েছে। তারা মিটার স্থাপনের কোন উদ্যোগ নেয়নি। তাই বাঁচার জন্য মিটার ছাড়াই প্রধান তারে সংযোগ নিয়ে বিদ্যুত ব্যবহার করা হচ্ছে। হাতিখানা ৩টি ক্যাম্পের সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আমার সব ক্যাম্পের মিটার নষ্ট। ওভাবেই চলছে। বিষয়টি নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানালেও কোন লাভ হয়নি। রসুলপুর ক্যাম্পের সভাপতি শাহাজাদা বলেন, আমাদের মিটারহীন তার দিয়ে বিদ্যুত অফিসের কর্মচারীরা বহিরাগত ৬০ পরিবারকে সংযোগ দিয়েছে। তারা কোন বিল না দিয়েই চলছে। একই কথা বলেন, ওই সকল ক্যাম্পের সভাপতি মোঃ ইলিয়াস, আলাউদ্দিন, মমতাজ, আজগর, শাহাজাদা, মাহাবুব, শাহাবুদ্দিন, মিষ্টার, গোলাম, বাট্টু, হামিদা খাতুন, জামাল উদ্দিন, আকবর হোসেন ও ওয়াকিল। তবে দুর্গামিল ক্যাম্পের সভাপতি মোঃ আলী বলেন, আমাদের মিটার সচল হলেও কখনই মিটার রিডার আসে না। এসব ক্যাম্পের বিলের পরিমাণ কত? বা কিভাবে পরিশোধ করা হয়। এর প্রক্রিয়া জানেন না কেউই। তাই এই ভুতুড়ে বিলের বিশাল অঙ্ক শুনে সব ক্যাম্প সভাপতি বিস্ময় প্রকাশ করেন। সৈয়দপুর উর্দুভাষী ক্যাম্পের উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মোঃ মাজিদ ইকবাল বলেন, আমাদের ক্যাম্পের একটি ঘরে একটি বাতি, একটি ফ্যান ও একটি টিভি চলে। এতে কিভাবে মাসে ৯৯ লাখ বা এক কোটি টাকা কখনই আসবে না। এতে স্থানীয় নেসকো অফিস আমাদের ভাবমূর্তি সরকারের কাছে নষ্ট করছে। তারা ইচ্ছে মতো বিল বানিয়ে সরকারের কাছে আদায় করছে। তাই এ ভুয়া বিদ্যুত বিল বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। নষ্ট মিটার বা মিটার ছাড়াই বিশাল এ বিদ্যুত বিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নেসকো সৈয়দপুর বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ তানজিমুল হক বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি তাচ্ছিল্যর সঙ্গে বলেন, আপনার যা খুশি লিখতে পারেন। আমার বলার কিছুই নেই। এ নিয়ে প্রধান প্রকৌশলী বিতরণ অঞ্চল রংপুর মোঃ শাহাদাত হোসাইন সরকার বলেন, যেহেতু তারা বিদ্যুত ব্যবহার করছে। এতে বিল আসবেই। হয়ত কম বা বেশি হচ্ছে। তাই বিষয়টি দেখা হবে। এ নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মহসিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে (০১৭১৩০৪৩৪১৯) কথা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি জানতাম না। এখন জানালাম। অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×