ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বিকার সমাজ ও আমাদের দুঃস্বপ্ন

প্রকাশিত: ২০:১৩, ১৭ অক্টোবর ২০২০

নির্বিকার সমাজ ও আমাদের দুঃস্বপ্ন

হয়ত, নিষ্প্রভ সমাজের বীভৎস চেহারা দেখে আমার এক বন্ধু লিখেছে, ‘আজকাল আর আফসোস হয় না কন্যাসন্তান নেই বলে, বরং সৌভাগ্যবতী বলেই মনে হয়।’ কথাটির মাঝে ভাবগাম্ভীর্যের কমতি ছিল না। তার হতবিহ্বল মলিন চেহারাটা কল্পনা করেছি আর ভাবছি হয়ত সমাজ থেকে হারিয়ে ফেলেছে ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। হতাশাগ্রস্ত জীবনবোধের মাঝেই অসহায়ত্বের চাহনি। শঙ্কিত চিত্তে নিমজ্জিত হয়ে আসে আঁধারের ঘনঘটা। ভাবি, ভাগ্য বিধাতা এভাবেই আমাদের লজ্জিত করলেন! হয়ত সে তুলে ধরতে চেয়েছে একটি নিষ্ঠুর সমাজের একাংশের বাস্তবতা। যে সমাজে অবলীলায় ঘটে যায় ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট কিছু ঘটনা। আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। অসমতার এই পৃথিবীতে অর্ধেক আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে আলোকিত জগত অপ্রকাশিতই থেকে যাবে। বুঝে নিতে হয়, অবক্ষয়ে নিমজ্জিত মানুষগুলো আসলে এই স্বার্থপর নিষ্ঠুর সমাজেরই উৎপাদন। তাই সেই নিষ্ঠুর মানুষগুলো থেকে শিষ্টাচারসম্মত আচরণ সবসময় সমাজ নাও পেতে পারে। নির্মম পরিহাসে সমাজের এসব মানুষ রং বদলায়। সভ্য সমাজের মাঝে দুই একজন নিষ্ঠুরতার ডাক দিতেই পারে। তারপরও আমাদের একটা ইচ্ছা থাকে, সে ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চাই ইতিবাচক ঘটনার মধ্য দিয়ে। সমাজ আমাদের উত্তরণের পথ দেখায়। কখনও পিছপা হওয়ার বিমুখতা শেখায় না। মনের মাঝে জেগে থাকা ঈপ্সিত স্বপ্নগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে কেউ যদি শিহরণ জাগানো সমাজ ব্যবস্থার মাঝে নির্ভরতার জায়গাটুকু হারিয়ে ফেলে বুঝতে হবে সেখানে নেতিবাচক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এমনকি নির্যাতনের ভয়াবহতাও চরম পর্যায়ে চলে আসে। ফলে বীভৎস সমাজব্যবস্থা জানান দেয়। স্তম্ভিত হয়ে আসে সামগ্রিক জীবনের গতিধারা। সেখানে বিরাজ করে বীভৎসতার শত রূপ, শত আঙিনা। বীভৎসতা যখন ধেয়ে আসে সমাজ তখন স্তম্ভিত হয়ে আসে। স্তব্ধতা তাদের পিছু টানে, আষ্টেপৃষ্ঠে বিরাজ করে নির্মমতা। আমরা আমাদের আদিম সমাজকে নষ্ট সমাজের সঙ্গে তুলনা করি। বর্বরতার চরম মুহূর্তে বর্তমান এই সমাজও আদিম সমাজের ভাবাবেগে নিয়ে আসে। সেখানে বিবেকের আত্মতুষ্টি বলতে কিছু থাকে না। আত্মশ্লাঘা এসব লোক সমাজকে এভাবেই বিষিয়ে তুলে। যখন সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাঝেও একটি শিশু নির্যাতিত হয় কিংবা পিতা তার কন্যাকে নিয়ে দায়গ্রস্ত হিসেবে সময় পার করেন, তখন তার মনে নিষ্ঠুরতার গ্লানি বিঁধে। পরিবারের মাঝেই বেড়ে ওঠা কন্যাটি সামাজিকভাবে এখনও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের পথটি বেছে নিতে পারে না। সদা ভয়ার্ত হৃদয়ে পথচলা শুরুর রাস্তাটিও শেষ করতে হয় শঙ্কিত চিত্তে। মানবিকতার দ্বার সেখানে রুদ্ধ থাকে। হঠাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নষ্ট সমাজের ছত্রছায়া। দুই একটি নেতিবাচক ঘটনা শঙ্কিত করে তুলে। সমাজে দেখা দেয় ছন্দপতন। ফলে কেউ বা অহায়ত্বের গ্লানিতে ভুগে, কেউ নিজের সম্ভ্রম দিতে বাধ্য হয়। সেখানে পুরুষ এবং নারীর মাঝে দেয়াল তৈরি করলে আরও শঙ্কিত হয়ে উঠে সমাজব্যবস্থা। ফলে অসহায়ত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে কেউ বা হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে। ভালবাসার আত্মিক বন্ধনে জড়ানো সমাজের মাঝে কিছু অন্ধশ্লাঘা লোক তাদের দীর্ঘদিনের প্রয়াস পূরণে জেগে উঠে। ফলে সমাজের মানুষ দুশ্চিন্তার আঁধারে নিমজ্জিত হয়। মাঝে মাঝে অসহায়ত্ব থেকে রক্ষা পেতে কারও কারও করুণা দাক্ষিণ্য করে। তাদের অসহায়ত্বের করুণ দৃষ্টি কাউকে ভাবায় না। নিভৃতে সমাজের এক কোণে ঠাঁই হয়। সারাটা জীবন তাদের এভাবেই নির্বাহ করতে হয়। রহস্যময় পরিবেশে কেউ কেউ খাপ খেয়ে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কেউ বা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। নিয়তি এখানে ভাগ্য নির্বাহক। আবার যারা নির্বিকার তাদের উপর নির্যাতনের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। তাদের প্রতি সংক্ষুব্ধতার প্রকাশ সমাজ থেকে আসে। কিন্তু যে সমাজব্যবস্থায় যারা নিজেদের প্রাধান্য দিয়ে আত্মিক স্তুতি সাপেক্ষে এ ধরনের পাশবিক কাজ করতে পারে তারা নগ্ন চিন্তারই বহির্প্রকাশ করে। তারই প্রতিফলনে ঘটে কোন একটি বিবেক বর্জিত কাজ। গর্হিত কাজের জন্য কখনও সমাজব্যবস্থাকে কেউ দায়ী করে, কেউ বা সামগ্রিক পরিবেশকেই স্তম্ভিত করে রাখে। ইদানীং আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের মতো নেতিবাচক ঘটনা আমাদের আরও শঙ্কিত করে তুলে। ফলে সমাজে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। নারীদের অবস্থান সুদৃঢ় হওয়ার বদলে সীমাবদ্ধতায় কড়া নাড়ে। তাই এ দেশের সরকারকে নারী নির্যাতন রোধে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে হয়। অবশ্যই সরকারী এসব উদ্যোগ প্রশংসনীয় বটে। কিন্তু আমাদের সমাজের সদিচ্ছা যতদিন না স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠবে ততদিন এই ধরনের বিরূপ বা নেতিবাচক অবস্থান থেকে আমাদের উত্তরণ সম্ভব নয়। বিষণ্ণ মন শঙ্কিত হয়ে ভাবিয়ে তুলে বর্তমান সমাজের গতি প্রকৃতি। কখনও ভাবি, এ সমাজটাই আমাদের আগলে রাখে, আবার এ সমাজেরই দুই একজন নিকৃষ্ট কাজে সায় দিয়ে আতঙ্কিত করে তুলে। আমাদের সমাজটাকে আমরা এখনও নষ্ট বলতে পারি না। এই সমাজে এখনও ভাল মানুষ আছে যাদের আমরা সবাই সুন্দর মনের অভিসারী মনে করি। তারাই হয়ত এ সমাজকে পিছুটান থেকে রক্ষা করবে। আশার কথা এই যে, বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা এসব অনৈতিক কিংবা নেতিবাচক কাজ মানতে নারাজ। তারা স্তব্ধ সমাজে খুঁজে ফিরে প্রাণের পরশ। তাই বলি, আগামীতে শ্বাপদসঙ্কুলমুক্ত এক সুন্দর সমাজের রূপের স্বপ্ন কি আমরা দেখতে পারি না? লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা [email protected]
×