ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মীম মিজান

পঙ্ক্তিতে প্রাণ পায় প্রেম-প্রকৃতি

প্রকাশিত: ০০:২০, ১৬ অক্টোবর ২০২০

পঙ্ক্তিতে প্রাণ পায় প্রেম-প্রকৃতি

কবিতাই মানুষকে আলোড়িত করে দ্রুত। কেননা স্বল্পায়তনে যত কথা গেথে দেয়া যায় তত কথা উপন্যাসে লিখতে গেলে প্রায় উপসংহারে উপনীত হতে হয়। আর সাহিত্যের আদি উৎসও তো কবিতা। এই কবিতার জয়জয়কার ছিল, আছে থাকবে। কথাসাহিত্য যদিও এখন নিজের অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে তবুও কবিতার আসন মুকুটের মতোই। সেটাই এবার প্রমাণিত হলো সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার ঘোষণায়। অসংখ্য কথাসাহিত্য ও অন্যান্য অনুষঙ্গের মধ্যে লুইস গ্লিকের নাম বিজয়ী ঘোষণা করায়। লুইস যেমনই কবিতার ঝা-া ওড়ালেন তেমনই নারীদের এক মর্যাদাপূর্ণ আসন দান করলেন নোবেল বিজয়ীদের তালিকায়। তিনিসহ মাত্র ষোলোজন হলেন নারী বিজয়ী। কাব্য ও প্রবন্ধ লিখা ছাড়াও তিনি কানেকটিকাটের নিউ হেভেনের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। বাস করছেন ম্যাসাচুসেটস এর ক্যাম্ব্রিজ শহরে। এ পর্যন্ত তাঁর ১২টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। সেগুলো হচ্ছে : ফার্স্টবর্ন (১৯৬৮), দ্য হাউস অন মার্শল্যান্ড (১৯৭৫), দ্য গার্ডেন (১৯৭৬), ডিসেনডিং ফিগার (১৯৮০), দ্য ট্রায়াম্ফ অব এ্যাকিলিস (১৯৮৫), অ্যারার‌্যাট (১৯৯০), দ্য ওয়াইল্ড আইরিশ (১৯৯২), দ্য ফার্স্ট ফোর বুকস অফ পোয়েমস (১৯৯৫), মিডোল্যান্ডস (১৯৯৬), ভিটা নোভা (১৯৯৯), দ্য সেভেন এইজেস (২০০১), অক্টোবর (২০০৪), অ্যাভার্নো (২০০৬), অ্যা ভিলেজ লাইফ (২০০৯), পোয়েমস ১৯৬২-২০১২ (২০১২) এবং ফেইথফুল এ্যান্ড ভার্চুয়াস নাইট (২০১৪)। রাইনার মারিয়া রিলকে, এমিলি ডিকিনসন ও রবার্ট ডোওয়েল এর উত্তরাধিকারিনী বলা হয় তাকে। তিনি গীতি কবিতার ধাঁচে কখনোই কাব্য করতে প্রয়াস করেননি। নারীবাদী লেখিকা হিসেবে তকমা দিলে তিনি কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধে সে অভিধাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মিথের ব্যবহার, পৌরাণিক কাহিনী, উপকথা, জীবন, মৃত্যু, হাতাশা, প্রেম, বিরহ, উদাসীনতা, প্রকৃতি ইত্যাদি তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু। মূলত তাঁর কবিতায় থাকে সরল স্বীকারোক্তি, আপোসহীন উচ্চারণ ও ভাষার সারল্য। তাঁর কবিতার ভবনের অসংখ্য বিষয়াবলী, শব্দের খেলা ইত্যাদি পাঠককে করে মোহিত। নতুন ভাষা তিনি আবিষ্কার করতে পারেননি। তাই বলে প্রাঞ্জল ভাষায় সহজ শব্দে যে কবিতা লিখেছেন তা কিন্তু শক্তিশালী। এমনই শক্তিশালী যে মানুষের মনকে নাড়া দেয় ভাবায়। চকিতে বিস্মিত করে ভাব ও বিষয়বস্তুর সাবলীল ব্যতিক্রমী বর্ণনায়। তাঁর কবিতা সাগর সেচলে পাওয়া যায় নানা মণিমুক্তা। নানা আদরণীয় উচ্চাঙ্গের অনুষঙ্গ। তেমনই দুটো প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রকৃতি ও প্রেম। আসলে প্রকৃতির বাইরে কিছু নেই। এই প্রকৃতির কোলে হাসি, খেলি, ঘুমাই। আবার প্রকৃতিকে বিষাক্ত করতে আমরাই বদ্ধ পরিকর। প্রেমে মজে যাই প্রকৃতির বা তারই কোনও অনুষঙ্গের। প্রেম আছে বলে পৃথিবী এত সুন্দর। প্রেম দ্বারাই সভ্যতার জন্ম। আবার প্রেমহীনতায় সভ্যতার বিনাশ। এই দুটো প্রধান বিষয় লুইসের কবিতায় বাঙময় হয়ে ওঠে। আমাদের পাঠক চোখ তাদের দেখতে পাই প্রাণবন্ত হতে। যারা কথা বলতে পারি তারা কী চমৎকারভাবে তাদের সঙ্গে কথোপকথনে মত্ত হই! ২. গবেষকগণ অনেকেই মনে করেন যে, মিথ, মোটিভ, পারিবারিক জীবন ইত্যাদি নিয়ে লুইসের কাব্যমালা অন্যের থেকে পৃথক। আমার দৃষ্টিতে অবশ্যই তাঁর কবিতা অন্যদের থেকে পৃথক। কিন্তু যে কুটিল ভাষা ও ভাবের প্যাঁচানোতে পাঠককে ধন্দে ফেলে দিয়ে অনেক পাঠকের বিরক্তির কারণ হয় কাব্য, সেদিকে এগোননি তিনি। তিনি আমাদের পল্লীকবি জসীমউদদীনের মতো। পল্লীকবি যেমন সরল ভাষায় পল্লী বালার কানের দুল, প্রকৃতিকে ঝংকৃত করেছেন আর হয়ে উঠেছেন প্রাতিস্বিক কবি। তেমনি লুইসও সরল ভাষায় প্রকৃতিকে কাব্য তুলির সূক্ষ্ম টানে দিয়েছেন অনন্যসাধারণ ঢঙ। জসীম উদদীন যখন বলে ওঠেন: “আম-কাঁঠালের বনের ধারে শুয়ো আঁচল পাতি, গাছের শাখা দুলিয়ে বাতাস করব সারা রাতি। চাঁদমুখে তোর চাঁদের চুমো মাখিয়ে দেব সুখে, তারা ফুলের মালা গাঁথি, জড়িয়ে দেব বুকে।” (আমার বাড়ি) তখন কি পাঠকের আর কঠিন শব্দের মারপ্যাঁচে ঘুরপাক খেতে হয়? পাঠকের চোখে ভাসে পল্লী বালার দৃশ্য। রাতের নাতিশীতোষ্ণ চাঁদের আলো। অনুরূপ লুইস যখন বলেন: “পরিচ্ছন্ন গগন, মেঘেরাও যেন সফেদ পেজা তুলো। তারই নিচে ছোট্ট মেটে ঘর, ফুটন্ত ফুল- লোহিত, গোলাপী টকটকে।” (দ্য আনট্রাস্টওরদি স্পিকার) তখন আমরা এক শরৎকালীন আবহে গ্রামীণ দৃশ্য দেখি। ফুল দেখি বাহারি। বাহারি ফুল দেখতে দেখতে আমরা যদি বাংলাদেশে মাঠঘাট, প্রান্তর ঘুরে দেখি তাহলে কত্ত কত্ত গাছ দেখি। ফলের গাছ, ঔষধি গাছ, দৃষ্টিনন্দন শৌখিন বাগান। আমেরিকা শিল্পোন্নত দেশ হলেও সেখানে আছে প্রকৃতির নানা গাছ। এমনই এক চমৎকার ফুল ও ফলের গাছের নাম ‘শ্যাড-ব্লো’ গাছ। সে গাছের শীতকালীন অবয়ব কেমন তা লুইস বুনছেন: “শ্যাড-ব্লোটি পাতা নাড়ায় তার নিজ খেয়ালে, শীতকাল পর্বতমালার মধ্যে এরকম জমে যাওয়া রীতিতে যেনো তারা প্রশিক্ষিত দ্রাক্ষারস হয়ে যায়, মূল, পাথর, আর সবকিছুই বিনাশ হচ্ছে” (শ্যাড-ব্লো গাছটি) এরকম গাছ বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। সূর্যের আলো ওক পত্রের ওপর পতিত হয় তখন এক ধরনের আকর্ষণীয় দৃশ্যের অবতারণা করে। ওক গাছের পাতায় যখন পীত আলো পতিত হয় তখনকার দৃশ্যের এ চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন লুইস। গ্রান্ডমাদার ইন দ্য গার্ডেন কবিতার সেই চৌম্বকীয় অংশ: “পীত বরণের দিবালোক ওক পাতার উপর রেখাপাত করেছে আর দ্রাক্ষালতার গুনা অপরিবর্তিত পরিবর্তনের সাথে গলে যাচ্ছে” এই গলে যাওয়া যেমনটি উপমা, তেমনটি উপমা দিয়েছেন মানুষের জীবনকে পানিবন্দী দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে। যদিও উপমা তবুও তা প্রকৃতিকে বাঙময় করেছে অসাধারণভাবে। জীবনকে দ্বীপাকারে চিত্রায়ণ করতেছেন এভাবে: “আমরা প্রচ- সূর্যরশ্মির মধ্যে এসেছি, দ্বীপ হতে পরিত্রাণ, পানিতে আটকানো। এটাই আমাদের পথ হয়েছে। একাদশতম মাসে আমরা তাড়িত হয়েছি, দ্বাদশের দিকে শান্ত সাগর দেখে আশ্চর্য হয়েছি, একটি পোতাশ্রয়। আমরা শান্তির জন্য প্রস্তুত।” (দ্য আর্কিপিলাগো) ৩. প্রেমকে কাব্যের অন্যতম অনুষঙ্গ বানিয়ে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে লুইস ভালো থাকার দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। এবং আমাদের প্রেমাস্পদের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হবে তাও শিখিয়েছেন। নিজেকে কতটা সংযমী হতে হবে তাও কাব্যের পঙক্তিতে লিখেছেন। যেমন: ‘আমার হাত তোমার উপর সতর্কভাবে চললো।’ অথচ তার আগের লাইনগুলোতে কবি তাঁর প্রেমিকের উপর ভয়ানকভাবে আকর্ষণ অনুভব করছিলেন? কবি বলছেন: ‘খুবই আগ্রাসী; ক্ষমা কোরো আমার পশুত্ব।’ (ডেড ইন্ড) প্রেম বাঙময়ী এ কবির কবিতায় প্রেমের আবেদন যেমনটি আছে তেমনি আমরা দেখতে পাই বিরহ বা বিচ্ছেদ। হয়তো তাঁর প্রেমিকের ওপর প্রেম প্রায় উঠেই গেছে তাই কাব্য করে বলছেন পৃথক হতে। কবির পদ্যের পঙক্তি: আমি বললাম, “ফেরেশতা শোনো, এই যাতনা থেকে আমার মাই ছাড়িয়ে নাও।” আমি বললাম, “এই নিকৃষ্ট লোক থেকে আমাকে পৃথক করো, এই এক ঘেয়েমি শষ্যদানার অপব্যাবহৃত খাদ্য, ভদকা ও টমেটো রসের অপব্যবহার, তোমার লেখা প্রণয় লিপির টুকরো-টাকরার মধ্যে।” (দ্য আনট্রাস্টওরদি স্পিকার) অন্যের প্রতি ভালোবাসা কমে গেলে গলগ্রহ না হয়ে সমঝোতার সাথে পৃথক হয়ে যাওয়াই শ্রেয়। এরকম প্রেম-বিরহের নানা শব্দ, বাক্য, আবহ আমরা দেখতে পাই লুইসের কাব্যের পরতে পরতে। ৪. প্রকৃত বিষয় হলো তাঁর কাব্যসত্তা গঠিত হয়েছে স্বদেশী ভাবধারায়। স্বদেশী ভাবধারায় গঠিত হলেও প্রকাশ মাধ্যম ও ঢঙ এমনই হৃদয়গ্রাহী যে পাঠককে সম্মোহন করে। আর পাঠক যেহেতু প্রকৃতি ঘেরা এবং মন থাকার দরুন প্রেমিক সেহেতু পাঠক নিজেকে খুঁজে পায় লুইসের কবিতায়। আর লুইসও হয়ে ওঠেন পাঠকের। নোট: কবি সম্পর্কে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে উইকিপিডিয়া মুক্তকোষ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট থেকে। কবির কাব্যালোচনায় ব্যবহৃত কবিতার বাঙলায়ন লেখকের।
×