ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমালোচকের মন্তব্যে লুইস গ্লুক

প্রকাশিত: ০০:২০, ১৬ অক্টোবর ২০২০

সমালোচকের মন্তব্যে লুইস গ্লুক

১৯৯৩ সালে আমেরিকান নারী ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ের ২৭ বছর পর এই প্রথম আমেরিকান নারী সাহিত্যিক লুইজ ব্লুক ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছেন। অনেকে তাঁকে আমেরিকার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান কবি হিসেবে বিশেষভাবে বিবেচনা করে থাকেন। গ্লুক তাঁর কবিতায় পরিভাষাগত স্পষ্টতা, একাকীত্বের প্রতি অন্তদৃষ্টি, পারিবারিক সম্পর্ক, সংবেদনশীলতা, বিবাহ বিচ্ছেদ ও মৃত্যুর বিষয়কে অতি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে তুলে ধরেছেন। কবি রবার্ট হার্স তাঁকে ‘এখনকার সবচেয়ে অকৃত্রিম ও সিদ্ধ গীতিকার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ‘তাঁর সুস্পষ্ট কাব্যিক স্বরের জন্য যা নিরাভরণ সৌন্দের্যে বিশেষ অস্তিত্বকে বিশ^জনীন করে তোলে’, সুইডিস একাডেমি প্রাথমিকভাবে এ বক্তব্য প্রদান করে তাঁকে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর নোবেল বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে। লুইজ গ্লুক ১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল নিউইয়র্ক সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং লং আয়ল্যান্ডে বেড়ে ওঠেন। তিনি সারাহ লরেন্স কলেজ ও কলম্বিয়া বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এ পর্যন্ত গ্লুকের ১২টি বই প্রকাশ পেয়েছে, এর মধ্যে ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘ফেইথফুল এ্যান্ড ভার্চুয়ার্স’ কবিতা সংকলনটি ‘ন্যাশনাল বুক এ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার লাভ করে, ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘পয়েমস ১৯৬২-২০১২’ কবিতা গ্রন্থ এবং ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধের বই ‘আমেরিকান অরিজানিলিটি’ ‘লস এনেঞ্জলস টাইম বুক প্রইজ’ অর্জন করে। তাঁর প্রথম দিকের গ্রন্থগুলো ছিল ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের সঙ্গে ব্যর্থ ভালবাসার ভবিষ্যত ফল। সর্বনাশা পারিবারিক লড়াই, অস্তিত্বের হতাশা এবং তাঁর পরবর্তী কাজ আত্মার যন্ত্রণা অন্বেষণ করে চলছে। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ফাষ্টবর্ন (১৯৬৮), পরিভাষাগত নিয়ন্ত্রণ, বিচ্ছিন্নতার সমাহার ও বিচিত্র বর্ণনার জন্য স্বীকৃতি পেয়েছিল। গ্লুকের গল্পের ব্যবহার সম্পর্কে হেলেন ভেন্ডলার তাঁর ‘নিউ রিপাবলিক রিভিউ অব দ্য হাউজ অন মার্সল্যান্ড’ (১৯৭৫), এ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন তাঁর রহস্যময় বর্ণনা আমাদের অংশগ্রহণকে আমন্ত্রণ জানায় : পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের অবশ্যই গল্পটি পূরণ করতে হবে, কল্পিত ব্যক্তিত্বের জন্য নিজেদের প্রতিস্থাপন করতে হবে, এমন একটি দৃশ্যকল্প উদ্ভাবন করতে হবে, যা থেকে কথক তার লাইনগুলো উচ্চারণ করতে পারবে, নিহিতার্থের পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হবে ও রূপক বর্ণনাকে ‘সমাধান করবে।’ তবে তিনি আরও যোগ করে বলেছেন যে, ‘পরে, আমার মনে হয়...আমরা কবিতাটি পড়েছিলাম, পরিবর্তে, সত্য হিসেবে এটি তাঁর নিজস্ব পরিভাষা হিসেবে সম্পূর্ণ হয়ে যায়, যার মধ্যে অসংখ্য আকৃতির ঝর্ণাধারার প্রতিফলন ঘটে।’ কবি-সমালোচক রোজানা ওয়ারেনের মতে, গ্লুকের শক্তি হলো মনোযোগের বিষয়বস্তু থেকে গীতকে দূরে রাখা এবং জরুরীভাবে পার্থিব বিচ্ছিন্নতার বিষয়ের উপর শৃঙ্খলা আরোপ করা। ‘দ্য ট্রায়াম্ফথ অব একিলিস’ গ্রন্থের পর্যালোচনা করতে গিয়ে ওয়েন্ডি লেজার ‘ওয়াশিংটন পোস্ট বুক ওয়ার্ড’ এ উল্লেখ করেছেন যে, ‘প্রত্যক্ষ’ এখানে সক্রিয় শব্দ : গ্লুকের ভাষা অবিচলিতভাবে দ্বিধাহীন, তাঁর রচনাশৈলী অতিশয় সাধারণ বক্তৃতার খুব কাছাকাছি। তবুও তিনি ছন্দ ও পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক এবং এমনকী তাঁর স্বাতন্ত্রমূলক অস্পষ্ট বাক্যাংশের নির্দিষ্টতা যা গ্লুকের কবিতাকে চলিত ভাষা থেকে অনেক দূরে রেখেছে।’ লেসার আরও মন্তব্য করেছেন যে, সেই স্বর শক্তির বিশাল অংশ উদ্ভূত হয়েছে তাঁর কবিতার আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে। গ্লুকের কবিতার শব্দগুলোকে মনে হয় তাঁর নিজের কেন্দ্র থেকে এসেছে।’ নিরাশা, প্রত্যাখ্যান ও বিনাশ এবং বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে গ্লুক এত কার্যকরভাবে লিখেছেন যে, পর্যালোচকরা প্রায়শই তাঁর কবিতাকে ‘নিরানন্দ’ ও ‘অন্ধকার’ বলে উল্লেখ করেন। কবি-সমালোচক ডন বোগেন অনুভব করেছিলেন যে, গ্লুকের ‘মৌলিক উদ্বেগ’ হলো আনুগত্যহীনতা, মৃত্যুহার, ভালবাসা এবং এর সঙ্গে জড়িত ক্ষতিকর অনুভূতিÑতিনি পতিত বিশে^র কবি হিসেবে হতাশ হয়ে পড়েছেন।’ স্টেফেন বার্ট তাঁর কবিতা সংকলন ‘এভারনো’-র পর্যালোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, কিছু কবি সিলভিয়া প্লাথের গভীর হতাশবোধের ধ্বনিকে রক্ষা করেছেন, এত বিচ্ছিন্নতাবোধকে প্রায়শই তিনি নান্দনিকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন।’ পাঠক ও পর্যালোচকরা গ্লুকের স্বপ্ন গুণের মতো সৃষ্ট কবিতা উপহার পেয়ে এতটাই আশ্চর্য হয়েছে, যা একইভাবে সংবেদনশীল বাস্তবতা ও আবেগের বিষয়কে প্রচুর মাত্রা দান করে। হলি প্রাদো ‘লস এঞ্জেলস টাইম বুক রিভিউ’ পত্রিকায় ‘ট্রায়াম্ফ অব একিলিস’ এর আলোচনার একটি অংশে ঘোষণা করেছেন যে, গ্লুকের কবিতা কাজ করে, কারণ তাঁর একটি বিমূর্ত স্বর রয়েছে, যা আমাদের সমসাময়িক বিশ্বে পুরনো ধারণার অনুরণন সৃষ্টি করে এবং কবিতা ও স্বপ্নদর্শীর সঙ্গে বিজড়িত। লুইজ গ্লুকের পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত কবিতা সংকলন ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিশ’ (১৯৯২), তাঁর স্বপ্নদর্শী কবিতাগুলোকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। তিনটি বিভাগে লেখা গ্রন্থটি একটি বাগানে বিন্যস্ত করে তিনটি কন্ঠের কল্পনা করা হয়েছে: ফুলগুলো উদ্যান কবি ও অপার জ্ঞানী ঈশ^র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলছে। নিউ রিপাবলিকে হেলেন ভেন্ডলার বর্ণনা করেছেন যে, কিভাবে গ্লুকের ভাষা ডেলপিক ট্রাইপোডের (গ্রীক পুরাণে বর্ণিত তিন পা বিশিষ্ট ধর্মোপদেশের পবিত্র আসন। যেখানে বসে ডেলপিক দেবতা বানী শোনান) বিবৃতির মতো উচ্চতর সম্ভাবনাগুলো পুনরুজ্জীবিত করেছিল। বিবৃতির ভাষাগুলো যদিও প্রায়শই নগ্ন, সরল ও স্বভাবিক প্রকৃতির; এটি ছিল তাদের প্রধান পৌরহিত্য-সংক্রান্ত বিষয় ও স্বর্গীয় বাণী যা তাদেরকে স্বতন্ত্র করে তুলেছিল। এটি সামাজিক ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর আওয়াজ নয় বরং আধ্যাত্মিক ভবিষ্যদ্বাণীর এমন একটি স্বর যা অনেক মহিলাই দাবি করার সাহস পায়নি।’ ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিশ’ এর পর গ্লুকের প্রথম কবিতা গ্রন্থ হলো ‘মিডোল্যান্ডস’ (১৯৯৬), গ্রীক ও রোমান পুরাণ থেকে এর নির্দেশনা গ্রহণ করা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউতে দেবোরা গ্যারিসন বলেন, বইটিতে ‘বিবাহ-সংক্রান্ত বিষয় জানার জন্য এক ধরনের উচ্চ ও নিম্ন ‘অলংকারিক পরীক্ষা’ তৈরি করতে ওডিসিয়াস (ওডিসি গীতি কাব্যের মূল চরিত্র) ও পেনিলোপের (ওডিসিয়াসের পতিব্রতা স্ত্রী) কণ্ঠকে ব্যবহার করা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস রিভিউতে দেবোরা গ্যারিসন আরও যোগ করেছেন যে, ‘প্রাচীন ভবঘুরে স্বামী ও তার স্ত্রীর মধ্যে ‘শহরতলির পরিহাস’ এর মাধ্যমে, ‘মিডল্যান্ডস’ এ বিবাহের একটি নিজস্ব স্বর রয়েছে।’ ‘এ ভিলেজ লাইফ’ বইটি গ্লুকের একটি চিহ্নিত প্রথাগত প্রস্থান, যা উপন্যাস বা ছোট-গল্পের প্রভাব অর্জনের জন্য দীর্ঘ লাইনের মধ্যে নির্ভর করে। সমালোচক উইলিয়াম লোগান ‘এ ভিলেজ লাইফ’ গ্রন্থটিকে সাম্প্রতিক কালের ‘স্পোন রিভার এনথোলজি’ (১৯১৫ সালে প্রকাশিত এডগার লি মাস্টার্সের কল্পিত মুক্ত স্তবক কবিতার সংকলন। যার উদ্দেশ্য হলো আমেরিকার গ্রাম ও ছোট শহরকে স্পষ্ট ও সহজভাবে বোঝা) হিসেবে দেখেছিলেন যে, এ গ্রামটিকে তাঁর জীবন যাত্রার অনুসন্ধানের জন্য একটি সুবিধাজনক দর্শন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, যা গ্লুকের ছাড়া জীবনের স্মৃতিকে প্রতিবিম্বিত করে।’ ডানা গুড ইয়ার লস এঞ্জেলস টাইমসের জন্য বইটি পর্যালোচনা করতে গিয়ে ‘এ ভিলেজ লাইফকে ‘বিদ্যুতায়িত’ হিসেবে পেয়েছেন। এটি সম্ভবত ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইটালিতে একটি ‘মৃতপ্রায় কৃষক সম্প্রদায়’ এর গল্প বলেছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ কবিতাগুলোর ঝুঁকির অংশ হল ‘সাধারণত্ব; এগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্লুকের বিপত্তি ও কৌশল এবং ভাবপ্রবণতা। কাছের গ্লুক আমাদের শিহরিত করে তোলে।’ তাঁর নির্বাচিত কবিতা সংকলন ‘১৯৬২-২০১২’ (২০১২), অত্যন্ত উঁচু মানের প্রশংসার সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের সমালোচক ডুইট গার্নারের ভাষায়, তাঁর কাজের ‘মসৃণতার নৈতিক প্রবণতা’ সম্পর্কে আলোকপাত করার সময়, পাঠকরা গ্লুকের সংগ্রহটির গুণাবলী ও বিষয়ভিত্তিক বিকাশ দেখতে পেল।’ নিউ রিপাবলিকের পর্যালোচক এডাম প্লকেট গ্লুকের উক্ত কবিতা সংকলনের আলোচনায় বলেন, ‘জলকে রক্তে পরিণত করার জন্য খুব কম সংখ্যক লেখকই তাঁর প্রতিভাকে ভাগ করে নেন।’ তবে এই নতুন থেকে উত্থিত হওয়া বিস্তৃত সংগ্রহ- যা তাঁর পুরো অভিপ্রায় থেকে ব্যাপক নিরিক্ষণের মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে- এটি এমন এক কবির প্রতিকৃতি, যিনি সম্মুখপানে প্রচুর মাত্রায় গরল নির্গত করেছেন, তবে তিনি এখন শান্ত মেজাজে দুর্দান্তভাবে লিখছেন।’ আগামী ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে কিংবদন্তি কবি লুইজ গ্লুককে নোবেল পুরস্কার প্রদান করবেন। বর্তমানে তিনি কানেটিকার্টের ইয়েল বিশ^বিদ্যালয়ে আবাসিক লেখক হিসেবে কাজ করছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্টের মেসাচুয়েটস অঙ্গরাজ্যের ক্যামব্রিজে বসবাস করেন।
×