ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

লুইস গ্লুক ॥ কাছ থেকে দেখা

প্রকাশিত: ০০:১৮, ১৬ অক্টোবর ২০২০

লুইস গ্লুক ॥ কাছ থেকে দেখা

লুইস গ্লুকের লেখায় স্বচ্ছতা রেখে আর কৈশোর জীবন ও পারিবারিক বন্ধনের চরিত্রগুলো উন্মোচন করার সচেষ্ট প্রয়াস রাখা হয়েছে, বলছিলেন নোবেল পুরস্কার প্রদায়ক কমিটির চেয়ারম্যান আঁদ্রে ওলসন। তাঁর এ কথাটি নোবেলবিজয়ী লুইস গ্লুক-এর (এভাবেই নামটি ঘোষক উচারণ করছিলেন) সঙ্গে যে কত নির্ভুল বর্ণনা দেয় তা আমরা কিছু পরে বুঝতে পারব, আপাতত বিজয়ীর কিছুটা পরিচয় জেনে নিই। লুইস গ্লুক ২২ এপ্রিল, ১৯৪৩ সালে নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন, বেড়ে ওঠেন লং আয়ল্যান্ডে। পুরো নাম লুইস এলিজাবেথ গ্লুক, সাহিত্যে পরিচিত লুইস গ্লুক নামে। তাঁর মা রুশ-প্রজন্ম ঈহুদী বশোংদ্ভূতদের একজন যারা পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে হাঙ্গেরী ছেড়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রে আবাস গাড়ে। বাবা মা দুজনই বেশ শিক্ষিত। ছেলেবেলাতেই তাঁরা তাঁকে গ্রীক মিথগুলো পড়তে দেন। তখন থেকেই তাঁর লেখালেখি শুরু। কৈশোরে অসুস্থতার জন্য কয়েকবার তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বিঘিœত হয়। পরবর্তীতে সাত বছর ক্রমাগত থেরাপি নিতে হয়, এজন্য লেখাপড়া ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, তবে তিনি এ সময়টিকে ধন্যবাদ দিতে চান এ জন্য যে, এ সময়েই তিনি তাঁর কবিতা লেখার ছন্দ খুঁজে পান। যদিও পুরোপুরি নিয়মিত ছাত্র হতে পারেননি তবু তিনি সারাহ লরেন্স মহাবিদ্যালয়ে কবিতার ওপর কয়েক সপ্তাহ একটি ক্লাস করেন। ১৯৬৬ সাল অব্দি কলম্বিয়ার স্কুল অব জেনারেল স্টাডিজের কর্মশালায় নিজের নাম লেখান। অপ্রচলিত শিক্ষার্থীদের জন্য যারা ডিগ্রী দিয়ে থাকে। তিনি তা অর্জন করেন। নোবেল পুরস্কারের আগেই তিনি পাঠপ্রিয়তা অর্জন করেন। ¯েœাড্রপস্ (ঝহড়ফিৎড়ঢ়ং) কাব্য সংহিতাটির জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৪ সালের কাজটি, ফেইথফুল এ্যান্ড ভার্চুয়াস নাইট (ঋধরঃযভঁষ ধহফ ঠরৎঃঁড়ঁং ঘরমযঃ)-এর জন্য তিনি ন্যাশনাল বুক এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০১৫ সালে বারাক ওবামা তাঁকে জাতীয় মানবিক পদক প্রদান করেন। সব মিলিয়ে ডজনখানেক পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এ পর্যন্ত ১২টি কাব্যগ্রন্থসহ অন্যান্য রচনার আরো কয়েকটি বই বাজারে এসেছে। সুইডেনের নোবেল কমিটি যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের প্রার্থী হিসেবে লুইস গ্লুককে ঘোষণা দিলেন তখন টুইটারে সাহিত্য সমালোচক ড্যান চিয়াসন তার বন্ধুকে বললেন, নামটি শুনে আমার মাথায় ১৫ মিনিট ধরে মাছির ভন ভন শব্দ হচ্ছিল! অনেক খ্যাতনামা মার্কিন ঔপন্যাসিক, অনেক লেখক বিভিন্নভাবে অনুভুতি প্রকাশ করছিলেন। দু’একজন প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন। বলতে গেলে এটি ওই সমালোচকের সবার অনুভূতিরই একটি প্রকাশ। তবে আনন্দের কারণগুলো সহজ ও গভীর এ জন্য যে লুইস গ্লুক একজন দুর্দান্ত লেখক যিনি এ পুরস্কারের দাবীদার। তাঁর লেখামালা রোমাঞ্চকর আর অবাক করা। এটি বেশ অন্তরঙ্গ এবং সার্বজনীন। তাঁর কাব্যিক আবেদন তাঁদের জন্য যারা কবিতা পড়ে এমনকি তাঁদের জন্যও যারা কবিতা প্রায় পড়েনই না। এটি প্রায় পুরো কবিতাজুড়ে সব স্বভাবের মানুষের কাছে আবেদন করার জন্য যথেষ্ট; এখানে সংশয়ীদের জন্য একটি চরণ, ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয় যারা তাদের জন্য। যদি কেউ জানতে চায় কবিতায় প্রেমে পড়া, গর্ভপাত হওয়া, সন্তান ধারণ করা, গুরুতর অসুস্থ হওয়া, তালাকপ্রাপ্ত হওয়া, পনির কেনা, আগাছা করা, বৃক্ষ রোপণ করা, বাবা মা ও শিক্ষকদের জন্য শোক প্রকাশ করা; তাহলে সে এটি গ্লুকের কবিতায় খুঁজে পাবে। তাঁর কবিতাগুলো সহজে প্রশান্তি লাভের জন্য এক ধরনের এ্যানাথেমা (গীর্জায় অভিসম্পাতগ্রস্ত ব্যক্তি বা বস্তু) যেগুলো চলমান এবং প্রচলিত মানসিক যুক্তি দিয়ে বারণ বা নিষিদ্ধ। তবু মানুষ এগুলো পড়ে নিজের ব্যক্তিজীবনের সারমর্মগুলো জানতে পারে। আমি গ্লুক সম্পর্কে দীর্ঘ লেখা লিখেছি। এখানে তাঁর কবিতা কি করতে পারে সে সম্পর্কে গভীর রাতের একটি সংক্ষিপ্ত তথ্যমূলক লেখা লিখছি মাত্র। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বিশাল কাব্যগ্রন্থ ‘ভিটা নোভা’ (ঠরঃধ ঘড়াধ) বইয়ের স্বতন্ত্র কয়েকটি কবিতার শিরোনাম দান্তের কাছ থেকে ধার করা শিরোনাম বহন করে যেখানে নিজস্ব ‘নতুন জীবন’ শুরু হয়েছিল যখন তিনি বিট্রিসকে তার মহান প্রেমের প্রথম ঝলক দেখিয়েছিলেন। বইয়ের শেষের কবিতায় গ্লুক একটি স্বপ্নময় কুকুরের হাস্যকর পাশবিক আটক অবস্থার বর্ণনা কল্পনা করেছেন। স্বপ্ন টুকরো টুকরো করে আমরা ঝগড়া করছিলাম কে নেবে কুকুরটি বা বরফ ঝড় বাবার রয়েছে দরকার তোমাকে মা বাবার হৃদয় শূন্য মাকে ছেড়ে যাচ্ছে বলে নয় তিনি যেমনটি ভালবাসা চাইছেন সেটি নেই মাম্মীর হৃদয়ে মা ছিলেন অন্য বাস্তবতা নিয়ে ব্যস্ত মা রাম্ভা করতেন না ড্রাইভওয়েতে কিংবা তা ছিল কী ভুলে ভরা। আমি কেমন যেন হয়ে যাই শৈশবের কুকুর আমার ঘরের এক তাকে কিন্তু এসব কী অবিচ্ছিন্ন গল্প শুধু শুধুই মৌখিক কলকথা? এ্যানোরেক্সিয়ায় সব ভরা? হে বরফ ঝড় হয়ে ওঠো তুমি এক সাহসী কুকুর এখানে সবই বস্তুবাদ তুমি ভিন্ন এক অন্য জগতে উঠবে জেগে তুমি আবারো খাবার খাবে তোমার মাঝে জেগে উঠবে এক কবি ‘এখানে সবই বস্তুবাদ’ কথাটি ব্যথিত শিল্পী ও লেখকদের, উভয়ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর সান্ত¡Íনা। কারণ, এ শব্দাবলীতে রয়েছে এক নিরেট সত্য। এমনকি এ্যানোরেক্সিয়া যা কী না যুবতী গ্লুককে হত্যা করতে চাচ্ছিল, সেটির ওপর একটি চপেটাঘাত হতে পারে। কবিতাটির অন্য কোথাও কুকুরটি একটি গ্রানোলা, যেমন একজন উপপতœী রম্বা করে। সে উপপতœী কুকুরের খাবার থালায় হাম্মাসকে স্পর্শ করবে না। কবি হয়ে বেড়ে ওঠা কি ভাল বা খারাপ জিনিস? (আজ এটি অবশ্যই একটি ভাল জিনিস মনে হচ্ছে।) কিন্তু কবিতাটি এখানেই থেমে যায় না। কবিতাটির চূড়ান্ত চরণগুলো অবশ্যই একটি তিক্ত রোমান্টিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে বেরিয়ে আসা চমৎকার কিছু সংবেদন বা অনুভূতি হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। জীবনটা খুব বিস্ময়ের, তা সে যেভাবেই হোক না নিঃশেষ কিন্তু অজ¯্র স্বপনে ভরা, কখনই না আমি তোমার মুখটি ভুলে যাব তোমার মানস চোখ অশ্রু দিয়ে ফোলা। আমি ভেবেছিলাম আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে আর হৃদয় ভেঙে গেছে। এর পর আমি ক্যামব্রিজে চলে যাই। গ্লুকের কবিতাটি নিয়ে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্তে যেতে না পারলেও কবিতাটি বিচিত্র চিন্তাগ্রন্থিকে সংযোজন করে চলে। ঋতুগুলো পরিবর্তিত হয়ে হঠাৎ আবারও সংযোজিত হয়ে একটি মডেল এনে দেয় আমাদের। শীত আমাদের ধ্বংস করে দেয় আর পথ করে দেয় বসন্তের যেন সব ভুলে গিয়ে এ উৎসবে আমরা মত্ত হয়ে উঠি। যেন, পেছনের অপ্রিয় দিনগুলো পেছনে ফেলে আসি। তাঁর নির্ভুল কাব্যিক কণ্ঠের জন্য যা কঠোর সৌন্দর্যকে ধারণ করেছে সেগুলো ব্যক্তিত্বের অস্তিত্বকে সর্বজনীন করে তোলে। এ কারণে হয়ত তাঁর কবিতা এতো বেশি প্রিয় হয়ে উঠবে সবার মাঝে। (আলোচনাটি দ্য নিউইয়র্কার-য়ে ড্যান চিসন-এর আলোচনার ছায়া অবলম্বনে লেখা)
×