ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

উড়ছে মেগ ল্যানিংয়ের অস্ট্রেলিয়া

প্রকাশিত: ০১:১১, ১৪ অক্টোবর ২০২০

উড়ছে মেগ ল্যানিংয়ের অস্ট্রেলিয়া

এটা সত্যি বিশেষ চেষ্টার ফসল, বিশেষ করে এতটা লম্বা সময় ধরে লক্ষ্য ঠিক রাখা। টানা ২১ জয় নিঃসন্দেহে দারুণ প্রচেষ্টার ফল। এটা নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি।- বলছিলেন মেগ ল্যানিং। অস্ট্রেলিয়া নারী দলের এই সাফল্য নিয়ে আসলে পুরো দেশই গর্ব করতে পারে। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেটের এই যুগে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, ম্যাচের পর ম্যাচ সাফল্যে ধরে রেখে এগিয়ে চলা চাট্টিখানি কথা নয়। আর সেই কাজটাই করেছে অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা। ঘরের মাটিতে করোনাকালের ওয়ানডে সিরিজে প্রতিবেশী নিউল্যিান্ডকে ৩-০’ ব্যবধানে উড়িয়ে দেয়ার পথে অনন্য এ অর্জনে নাম লিখিয়েছে ল্যানিং-এ্যালিসা হিলি-বেথ মুনির দল। কেবল নারীদের নয়, সর্বোপরি ওয়ানডে ক্রিকেটের দীর্ঘ ইতিহাসে এমনটা আর মাত্র একবারই দেখা গিয়েছিল। ২০০৩ সালে রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়াও জিতেছিল টানা ২১ ওয়ানডে। এ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথু হেইডেন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, শেন ওয়ার্ন- আরও কত বড় নাম যে ছিল পন্টিংয়ের স্কোয়াডে। ক্রিকেটের রেকর্ডে বইয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা ওই কীর্তিতে কখনও কেউ ভাগ বসাবে, ভাবাটাই ছিল কঠিন। তবে সেই অস্ট্রেলিয়াই অসাধ্য কাজটি করে দেখালো। এবারের অপ্রতিরোধ্য যাত্রাটা তাদের মেয়েদের। ২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর শেষবার ৫০ ওভারের ক্রিকেটে হেরেছিল তারা ইংল্যান্ডের কাছে। এরপর থেকে ছুটছে জয়রথ। শুরুটা ২০১৮ সালের মার্চে ভারতের বিপক্ষে। টানা ২১ জয়ের পথে অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা সিরিজ জিতেছে পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। অস্ট্রেলিয়ার মেয়েদের এই সাফল্যের নেতৃত্বে মেগ ল্যানিং। দলকে একসুতোয় বেঁধে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন অস্ট্রেলিয়ার নারী ক্রিকেটকে। পন্টিংয়ের সেই ভয়ঙ্কর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন একই উঁচুতে। ব্রিসবেনের এ্যালান বোর্ডার ফিল্ডে রেকর্ডে ভাগ বসানো সিরিজের শেষ ম্যাচটিতে অবশ্য খেলতে পারেননি ল্যানিং। আগের ম্যাচে অপরাজিত সেঞ্চুরির ইনিংস খেলা এই ব্যাটার হ্যামস্টিং চোটে ছিটকে যান। এরপরও রিচেল হেইন্সের নেতৃত্বে নিউজল্যান্ডকে ২৩২ রানে হারিয়ে নতুন কীর্তি গড়ে অসি-নারীরা। ছেলেবেলায় রিকি পন্টিংয়ের বড় ভক্ত ছিলেন মেগ ল্যানিং। টেলিভিশনে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ককে দেখে স্বপ্ন দেখতেন ‘একদিন আমিও!’ ল্যানিংয়ের সেই স্বপ্ন এখন সত্যি। অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা ছুঁয়ে ফেলল রিকি পন্টিংয়ের ‘অজেয়’ অস্ট্রেলিয়ার বড় এক কীর্তি। টানা দুই জয়ে সিরিজ নিশ্চিত করা দ্বিতীয় ম্যাচেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ল্যানিং। মেয়েদের ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিক ল্যানিং সেদিন তুলে নেন ক্যারিয়ারের ১৪তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। তাও আবার মাত্র ৮২ ইনিংসে। সর্বোপরি ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে ১৪ সেঞ্চুরিতে সবচেয়ে দ্রুততম ল্যানিংই। ছেলেদের ক্রিকেটে রেকর্ডটির মালিক হাশিম আমলা। দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানকে খেলতে হয়েছিল ৮৪ ইনিংস। সেদিন ওয়ানডের আরেকটি রেকর্ডও ভেঙেছেন ল্যানিং। মেয়েদের ক্রিকেটে রান তাড়ায় সবচেয়ে বেশি রান এখন ২৮ বছর বয়সী ব্যাটারের। অস্ট্রেলিয়া জিতেছে এমন ওয়ানডেতে ল্যানিংয়ের রান ২১২৫। ভারতের মিতালি রাজের ২০৩৬ রানকে পেছনে ফেলেছেন তিনি। রেকর্ড ভাঙতে মিতালির চেয়ে ১৪ ইনিংস কম খেলতে হয়েছে ল্যানিংকে। ল্যানিং খেলেছেন ৩৮ ইনিংস, মিতালির রান ৫২ ইনিংসে। ১৪টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির ৯টিই ল্যানিং পেয়েছেন দলের জয়ে রান তাড়ায়। মেয়েদের ওয়ানডেতে সফল রান তাড়ায় সেঞ্চুরি-সংখ্যায় ল্যানিংয়ে ধারেকাছেও নেই কেউ। সফল রান তাড়ায় ৩টি করে সেঞ্চুরি নিয়ে যৌথভাবে দুইয়ে অস্ট্রেলিয়ার কারেন রোল্টন ও নিউজিল্যান্ডার সুজি বেটস এবং এ্যামি স্যাটারওয়েট। ‘আমরা সব ম্যাচেই জয়ের জন্য খেলতে নামি। বুধবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। বোঝাই যাচ্ছে আমরা দারুণ এক অবস্থানে আছি। রিকি পন্টিং ছিলেন আমার ছেলেবেলার নায়ক। আমি তাঁকে বিশ্বকাপে খেলতে দেখেছি। আর তা দেখে দেখেই তাঁর মতো হতে চেয়েছি।’ সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে দুর্দান্ত সেঞ্চুরির পর বলছিলেন ল্যানিং। এখনকার অস্ট্রেলিয়া নারী দল যেন পন্টিংদের বিশ্বজয়ী দলকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওয়ানডেতে টানা জয়ের রেকর্ড ২০০৩ সালের পন্টিং-গিলক্রিস্টদের অস্ট্রেলিয়াকে ছুঁয়ে ফেলেছে মেগ লেনিংয়ের দল। টানা ২১ ওয়ানডে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া নারী দলকে হারাতে পারেনি কেউই। এই দলটাকে চোখ বন্ধ করে নারী ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দল বলা যায়। অথচ চার বছর আগেও অস্ট্রেলিয়া নারী দলটা এম ব্যাটিং গড় ও স্ট্রাইক রেট মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাকি দলের পার্থক্যটা দিবারাত্রির। অস্ট্রেলিয়া এক পাশে, আরেক পাশে ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ভারতরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছে। ওয়ানডেতে ২০১৭ সালের শুরু থেকে র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রথম পাঁচ দলের চার দলের ব্যাটারদের গড় ৩০-এর আশপাশে। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের গড় ৪০ এর ওপর। ব্যাটিং স্ট্রাইকরেটেও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে সাড়ে ৬ ব্যবধানে এগিয়ে আছে। ওয়ানডেতে যার মানে অন্তত ২০ রান এগিয়ে থাকা। বোলিং ইকোনমি ও গড়েও একই চিত্র। অস্ট্রেলিয়ার মেয়েদের সঙ্গে অন্যদের তুলনা টানা বেশ কঠিন। আর ব্যাটিং ও বোলিংয়ের মিলিত ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়া ২০ রান এগিয়ে থাকে। শীর্ষ পাঁচের অন্য দলগুলোর যেখানে সম্বল থাকে ৩/৪ এর মতো। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্ষেত্রে তো সে ব্যবধান ঋণাত্মক ঘরে। তবে মেয়েদের ওয়ানডে বোলিং বাংলাদেশ বেশ ভাল অবস্থানে আছে। মাঝারি মানের দল বোলিং দল বলা যায় বাংলাদেশকে। বোলিং গড় ও ইকোনমিতে বাংলাদেশ শীর্ষ দশের পাঁচে আছে। আইসিসি ওয়ানডে এবং টি২০ দুই ফরমেটেই র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে অস্ট্রেলিয়ার নারী দল। করোনায় বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন থমকে যাওয়ার ঠিক আগে গত মার্চে ঘরের মাঠে ফাইনালে ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে নারী টি২০ বিশ্বকাপের রেকর্ড পঞ্চম শিরোপা জেতে ল্যানিংয়ের দল। রেকর্ড ছয় শিরোপায় যারা ওয়ানডের বিশ্বাকাপটাকেও পৈত্রিক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে আগেই।
×